কৌতূহল বেড়ে যায় যখন শুনি মিউজিশিয়্যান, কবি এবং দার্শনিক ম্যাক হকের সঙ্গে আসামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে। ম্যাক হক বাংলাদেশের বিখ্যাত রকতারকা, ‘মাকসুদ ও ঢাকা’ ব্যান্ডের দলপ্রধান, যিনি নিজেকে একজন ‘অহমিয়া বাংলাদেশী’ হিশেবে সবসময় চিনপরিচয় দিয়া থাকেন। পত্রিকার পক্ষ থেকে ম্যাকের সঙ্গে যখন যোগাযোগ করি সাক্ষাৎকারের জন্য সময় এবং সম্মতি চেয়ে, অবাক হই তার মুখনিঃসৃত অহমিয়া ভাষায় অনর্গল ও স্বচ্ছন্দ কথাবার্তা শুনে। যে-অতিথিনিবাসে ম্যাক উঠেছেন, নয়নভোলানো নদীকিনারে যে-অতিথিনিবাস, যখন সেখানে গেলাম ম্যাকের সাক্ষাৎ পেতে, ম্যাক এবং তার স্ত্রী লীরা ও ছোট্ট কন্যা মিহিকা আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। লম্বা ঝাকড়া চুলের শিল্পীকে কালো রঙের জামায় দেখাচ্ছিল জমকালো ও সৌম্য। কথা বলছিলেন অনর্গল স্বাচ্ছন্দে একইসঙ্গে অহমিয়ায় এবং ইংরেজিতে। যে-কারণে মুখোমুখি বসে আলাপের শুরুতেই আমি জিজ্ঞেশ না-করে পারি নাই তার এই ভাষিক পারদর্শিতা নিয়ে।
অহমিয়া ভাষায় এত চমৎকার কথা বলে যেতে দেখছি আপনাকে, এইটা কেমন করে হলো? পরিবারের আর-কেউ অহমিয়ায় এইভাবে বলতে পারেন আপনাদের মধ্যে?
হ্যাঁ, যদিও আমার জন্ম এবং বেড়ে-ওঠা বাংলাদেশে, আমার বাবা আমাদের বাড়িতে এই নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে নিজেদের মধ্যে পারিবারিক পরিমণ্ডলে অহমিয়ায় বলতে হবে। এই কড়াকড়ি নিয়মের ফলে এবং বাবার ভয়ে আমরা বাড়িতে কেবল অহমিয়া ভাষা ব্যবহার করে বেড়ে উঠেছি। ইংরেজিতে বা বাংলায় বাবাকে কোনোকিছু জিজ্ঞেশ করলে তিনি রিপ্লাই করতেন না। আর বাংলাদেশে আমাদের মতো অহমিয়াভাষী কিছু পরিবার এখনও আছে, সংখ্যায় তারা পঞ্চাশ থেকে একশ হবে সব মিলিয়ে। কিন্তু সেভাবে কেউ ব্যাপারটা জানেও না, কারণ আমরা অহমিয়া অ্যাসোসিয়েশন বা কম্যুনিটি টাইপের কোনো ফোরাম বা সমাবেশ কখনো করি নাই। তা, যা বলছিলাম, ছেলেবেলা থেকেই আমি অহমিয়ায় বলতে, পড়তে এবং এমনকি গাইতেও পারি।
মিউজিকে এলেন কীভাবে?
আমার মনে হয় মিউজিশিয়্যান হবার জন্যই আমি জন্মেছিলাম। আমার দাদি এবং নানি, ঘটনাচক্রে দুইজনে পরস্পর বোন তারা, মিউজিকে দুইজনেই ছিলেন দারুণ আগ্রহী এবং তারা আমাকে ইন্সপায়ার করেছেন মিউজিক নিয়া থাকতে। আমার মা-বাবারও সংগীতে প্রেম ছিল, গানবাজনা ভালোবাসতেন দুইজনেই খুব। রেডিও আমার গানের প্রথম শিক্ষক। ১৯৭৬ সনে সেই-যে শুরু করেছিলাম গাইতে, এখনও আছি, মিউজিকটা ছাড়ি নাই। আমার মা ছিলেন উদার, তিনি সবসময় আমায় মিউজিশিয়্যান হতে প্রেরণা দিয়েছেন। কিন্তু বাবা খানিকটা সংশয়ী ছিলেন সব ব্যাপারেই। ইংলিশ লিট্রেচারে আমি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি। কিছুদিন বাবা আমার মিউজিকের প্রতি আগ্রহ কতটা খাঁটি তা বুঝতে সময় নিয়েছেন। একটা হোটেলের রেস্তোরাঁয় এই-সময়টায় গাইয়ে হিশেবে আমি কাজ পেয়ে যাই। সেই অল্প বয়সেই আমি বেশ মোটা অঙ্কের টাকা আর্ন করতে থাকি। সেই সময়টায় আমি ভাবতাম যে ইংলিশ ছাড়া আর-কোনো ভাষায় গান গাওয়াটা ক্ষ্যাত্ একটা ব্যাপার। সব ধরনের ওয়েস্টার্ন গানই আমি গাইতাম তখন। প্যপ, রক্, রেগ্যে ইত্যাদি সবকিছু। ‘ফিডব্যাক’ ব্যান্ডে যোগ দেই। ফিডব্যাকের লিড-ভোক্যালিস্ট হবার সুবাদে এমনিতেই একটা পরিচিতি ছিল আগে থেকে। এক-সময় বুঝতে পারি যে শ্রোতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে চাইলে এবং শিল্পী হিশেবে নিজের চিন্তাভাবনা সাধারণ শ্রোতার মাঝে ছড়াতে চাইলে লোকসাধারণ যেই ভাষায় যেই বুলিতে তাদের দৈনন্দিন ভাব প্রকাশ করে সেই ভাষায় সেই বুলিতে শিল্পীর গান গাওয়া জরুরি। কাজেই, বাংলায় গাইতে শুরু করি সিরিয়াসলি। এবং বাংলায় গাওয়ার পরেই ডিফ্রেন্সটা টের পাই। ফিডব্যাকের ব্যাপক জনসমাদৃত অ্যালবাম ‘উল্লাস’ বেরোনোর পরে ব্যান্ড এবং আমার খ্যাতি দুইই আগের চেয়ে বেড়ে যায়। যারা আমাকে চেনে না বা দেখে নাই জীবনে, তারা আমার গানের সঙ্গে ঠিকই পরিচিত। পরে ‘মেলা’ অ্যালবাম যখন বেরোয়, ‘মেলায় যাই রে’ গানটা বাংলাদেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাভাষীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। ব্লকবাস্টার হিট বলতে যা বোঝায়, ‘মেলায় যাই রে’ গানটা তা-ই অর্জন করে রিলিজের সঙ্গে সঙ্গেই। এরপর ১৯৯৪ সনে বেরোয় ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’, যেইটা বাংলা গানের স্টুডিয়োঅ্যালবামের মধ্যে সে-বছর বেস্ট নির্বাচিত হয় একটা বাংলা সাপ্তাহিকের পাঠকজরিপে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
আপনি বাউল মিউজিকে আগ্রহী হলেন কীভাবে?
বাংলাদেশ তো লোকসংগীতের সমুদ্র একটা। প্রায় দুইশ সংগীতধারা আজও পাওয়া যায় এত অযত্ন অবহেলার পরেও। সংগীতের চেয়েও বেশি ফিলোসোফির কারণে আমি বাউলসংগীতে এসেছি। বাউলদর্শন সব-ধরনের ধর্ম ও জনপদের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে একটা ব্যাপ্ত গভীরের দর্শন। এইটা আমার আত্মপরিচয়ের বোধটা জাগায়, ‘আমি কে’ এই প্রশ্নের উত্তর যোগায়। আমরা বাউলরা আত্মপরিচয়ের রাজনীতি বিশ্বাস করি না। বাউলদর্শন মানবতার সারবত্তার কথা বলে যায়, মানবতার সারবত্তায় বিশ্বাস করে। যতটা আমার জানাশোনা আমার খোঁজপাত্তা তাতে বুঝি যে বাউলদর্শনের ধারাটা এসেছে এবং বিবর্তিত হয়েছে বৌদ্ধবাদ থেকে। এতদঞ্চলের ভক্তিবাদ এবং সুফিবাদ এই দর্শনের সঙ্গে মিশেছে। এই বাউললিপ্ততার সময়টায় ‘বাউলিয়ানা’ অ্যালবামটা আমরা বার করি যেইটা বাংলায় এ-ধরনের পয়লা কাজ এবং ফিডব্যাকের সঙ্গে এইটাই ছিল আমার শেষ কাজ।
এখন আপনি জীবনটাকে কীভাবে দেখেন?
আমার জীবনে ১৯৯০ বছরটা ছিল একটা ক্রান্তিকাল। এতদিন জীবনটাকে যেভাবে দেখে আসছিলাম, এই বছরে এসে সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টে যেতে শুরু করে। এই সময়েই আমি বাউল মিউজিক নিয়া ভাবা শুরু করি, রিসার্চ শুরু করি, বুঝতে পারি যে বাউল মিউজিক হচ্ছে মানবতার মিউজিক, এই সময়েই আমি লালন ফকিরের গানে মগ্ন হই। একইসঙ্গে এইটাও বলব যে এই সময়টাতেই কোরান আমাকে মুক্তির দিশা দিতে থাকে, বেশিরভাগের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আবদ্ধ করে ফেলবার বিপদ থাকলেও কোরান আমাকে মুক্তির দিশা দেখায়েছে। এই-রকম একটা পরিপ্রেক্ষিতে বাউলদের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নানান অনুষঙ্গ ধরে রেখেছে। এইটা এ-ও সাক্ষ্য দেয় যে আমরা বাংলাদেশীরা সাংস্কৃতিকভাবেই উদার। এইটা ভাবতে গেলে আশ্চর্য হতে হয় যে একটা গরিব মানুষে ভরা দেশে বাউল পন্থা এত জনপ্রিয়। বাউলদের চারটা তরিকার মধ্যে আমি কালো তরিকা নিয়েছি নিজের জন্য। পরে শাদায় যাব মনোবাঞ্ছা আছে। অবশ্য যদি নিজের মানসিক শক্তি এবং স্থৈর্য ওই পর্যন্ত নিয়া যাইতে পারি তবেই শাদা তরিকা নেয়া সম্ভব।
‘দি থাম্ব প্রিন্ট’ পত্রিকায় লেখাটা ২০১৫ জানুয়ারিতে প্রকাশিত। গানপার ট্র্যান্সল্যাশন ডেস্কে অনূদিত
- সাক্ষাৎকারে ম্যাক || অনিন্দিতা দাস - September 16, 2017
COMMENTS