চঞ্চল চৌধুরী এবং একদল মানুষের আকাট মূর্খতা || কুমার প্রীতীশ বল

চঞ্চল চৌধুরী এবং একদল মানুষের আকাট মূর্খতা || কুমার প্রীতীশ বল

‘আমি প্রথমে মানুষ, তারপর বাঙালি, তারপর মুসলমান।’ — বঙ্গবন্ধুর এই উক্তিটি উল্লেখের কারণ গত ৯ মে বিশ্ব মা দিবসে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী একটা ছবি পোস্ট করেছেন ফেইসবুকে মায়ের সঙ্গে। ছবি প্রকাশের পর একটি আকাট মূর্খ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে। তাদের ধারণা ছিল চঞ্চল মুসলমান। মায়ের সঙ্গে ছবি দেখে চঞ্চল চৌধুরীর ধর্মীয় পরিচয় বুঝতে পেরে তাদের আঁতে ঘা লেগেছে।

বাংলাদেশে সনাতন ধর্মের পুরুষদের পোশাক-আচার-আচরণ দেখে বোঝা না গেলেও বিবাহিত নারীদের লুকানোর অবকাশ নেই। হিন্দু বিবাহিত সধবা নারীদের মাথা এবং কপালে সিঁদুর আর হাতে সাদা শাঁখা পরিধান করা অনুশাসনের অংশ। পরিবারের মঙ্গলার্থে তারা তা পরেন। চঞ্চল চৌধুরীর মা কিংবা স্ত্রীও এর ব্যতিক্রম না। স্ত্রীর কথা উল্লেখ করলাম, কারণ চঞ্চল চৌধুরীর ছেলে এবং আমার ছেলে একই স্কুলের একই ক্লাসে পড়ে। তাঁকে দেখলেও ঐ সাম্প্রদায়িক আকাট মূর্খরা একইভাবে তোলপাড় শুরু করত।

প্রিয় মানুষ নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুভাই ফেসবুকপোস্টে লিখেছেন, ‘স্নেহের চঞ্চল চৌধুরী, কতিপয় আকাট মূর্খের সাম্প্রদায়িক উক্তিতে মনখারাপ করো না। আমরা তোমাকে ভালোবাসি।’ এছাড়াও মাসুদ হাসান উজ্জ্বল, বন্যা মির্জা, বাপ্পী চৌধুরী, রেদওয়ান রনি, অপূর্ব, মোনালিসা, শাহনাজ খুশি, সাব্বির মাহমুদ, আসিফ আকবর, মাসুম রেজা, মম, চয়নিকা চৌধুরী, নওশাবা, মিজানুর রহমান আরিয়ান, মিথিলা, আবু হেনা রনি, অরণ্য আনোয়ার, ভাবনা, রওনক হাসান, তানভির তারেক, কোনাল, সোহেল রানা, শবনম ফারিয়া, মাজনুন মিজান, মৌসুমী হামিদ, রুনা খান, শিহাব শাহীন, সাগর জাহান সহ ইন্ডাস্ট্রির অসংখ্য মানুষ ন্যাক্কারজনক এই ঘটনায় আকাট মূর্খগুলোর প্রতি ধিক্কার জানিয়েছেন এবং চঞ্চল চৌধুরীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। আর ইন্ডাস্ট্রির বাইরে সাধারণ মানুষ তো আছেনই!

চঞ্চল চৌধুরী নিজেও একটা পোস্ট দিয়ে ঐ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি লেখেন, ‘ভাই ও বোনেরা, আমি কোন ধর্মের, তাতে কী আসে যায়? সবারই সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে মানুষ । ধর্ম নিয়ে সব রুচিহীন প্রশ্ন ও বিব্রতকর আলোচনা বন্ধ হোক। আসুন সবাই মানুষ হই।’ এদেশে আকাট মূর্খরা মানুষ আর হলো কোথায়?

চঞ্চল চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। গ্রুপ থিয়েটার কর্মী, আরণ্যক থিয়েটারের মঞ্চাভিনেতা, বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটারের ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক চের সাইকেল-এর একজন সফল অভিনেতা, সংগীতশিল্পী, টেলিভিশন এবং সিনেমার একজন সফল অভিনেতা। তাঁর গান বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কণ্ঠে ভেসে বেড়ায়, আসরে-আসরে তরুণ সমাজের কণ্ঠে দোলা দেয়। গৌতম ঘোষের মনের মানুষে লালন, মনপুরা সিনেমায় সোনাই চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে আবেগাপ্লুত হয়নি এমন দর্শক কমই আছেন। একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। কিন্তু এমনই দুর্ভাগা দেশ, এতসব কিছু ছেড়ে আজ সবাই না হলেও একটি আকাট মূর্খ গোষ্ঠী তাঁর ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে তোলপাড় শুরু করেছে। কে তাদের বুঝাবে গাজির গানে গীত সেই অমর বাণী — ‘নানান বরন গাভি রে ভাই একই বরন দুধ / জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত।’

ধর্মনিরপেক্ষতা আর অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে ১৯৭১ সালে এদেশ স্বাধীন হলেও এর চর্চা তেমনভাবে হয়নি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হলে দেশও সাম্প্রদায়িকতার অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। এর সূত্রপাত করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানের মাথায় ধর্মের বাণী সংযোজন করে। এরপর তাঁরই উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দেন। তাই আজ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, কারণে-অকারণে সাম্প্রদায়িকতা নামের বিষধর সাপের ছোবল। এটা ১৯৯০ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় দেখেছি। ২০০১ সালে নির্বাচনের পর সিরাজগঞ্জে পূর্ণিমাকে অত্যাচারের পর দেখেছি। সম্প্রতি সুনামগঞ্জে দেখেছি। ভাবতে অবাক লাগে এমন একটি সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডলে বসবাস করে, লালিতপালিত হয়ে মনেপ্রাণে সাম্প্রদায়িকতা ধারণ করে পাশের দেশে অসাম্প্রদায়িক সরকার প্রত্যাশা করি! কী চমৎকার আব্দার!

আমাদের দেশে সরকার বদল হয় ঠিকই বারবার, কিন্তু সাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিবর্তন হয় না। বঙ্গবন্ধুপরবর্তী সময়ে এদেশে সাম্প্রদায়িকতার যে চাষাবাদ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয়, তা এখনও সরকারি না হলেও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অব্যাহত রয়েছে। ফলে তা যে-কোনো ইস্যুতে জেগে ওঠে। এর মধ্যে আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি লালন-হাসনের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে। সত্যি তখন পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, মা দিবস, ভালোবাসা দিবস, এমনকী স্বাধীনতা দিবস, শহিদ দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি আয়োজনকে হাস্যকর ঠেকে। কারণ এসব আয়োজন আমাদের দেশ থেকে বিগত ৫০ বছরেও সেই আকাট মূর্খতাকে বিনাশ করতে পারেনি। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। যদিও-বা যতীন সরকার বলেছেন, ‘লোকসংস্কৃতি হলো আমাদের শেকড়। লোকসংস্কৃতিই পারে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।’ আসলে এদেশে আকাট মূর্খ তৈরির অনেক কারখানা আর কারিগর থাকলেও মানুষ তৈরির কারখানা আর কুশীলবের বড়ই অভাব। মুক্তিযুদ্ধের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের জন্য যে স্কুলিঙের প্রয়োজন তা কী আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণে আছে?

আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সেই ধর্মনিরপেক্ষার চেতনার কোনো প্রভাব পড়েনি। যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের নামে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, মাদ্রাসার শিক্ষকের নামে ধর্ষণের অভিযোগ আসে, সেদেশে আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন অসম্ভব। সেখানে কেমন করে দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টি হবে! আমাদের দেশে এখনও একমুখী শিক্ষা চালু করা যায়নি। নাগরিকের মধ্যে দেশপ্রেম না থাকলে, সৃজনশীল চেতনাবোধ জাগ্রত করতে না পারলে চঞ্চল চৌধুরীরা বারেবারে প্রতিহিংসার শিকার হবেন। এদেশের মানুষের মধ্যে জাতিগতভাবে দেশপ্রেম বিকশিত হয়নি, যতটুকু সাম্প্রদায়িকতা বিকশিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ সেদিন লিখেছিলেন, ‘…হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করো নি।’ আজকে যদি লিখতেন তবে নিশ্চয় ‘বাঙালি’ শব্দটি ব্যবহার করতেন না। আমাদের দেশে বিগত ৫০ বছরে মানস গঠনের কাজটি একবারের জন্যও হয়নি। মানস গঠনে দরকার প্রয়োজনীয় আলো-হাওয়া — সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং পারিবারিকভাবে। নজরুলের ভাষায় বার বার বলতে হবে — ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই। নহে কিছু মহীয়ান। / নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি / সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে, তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, / এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।’  — উপলব্ধিতে এমনতর অনুভূতি জাগাতে হবেই, জাগানোর পথ সুগম করতে হবে। অন্যথায় আগামীর পথচলা আরও ভয়াবহ হবে।

১২ মে ২০২১


কুমার প্রীতীশ বল। মঞ্চনাট্যকার, উপন্যাসকার ও থিয়েটারচিন্তক। জন্মজেলা চট্টগ্রাম। নিবাস ঢাকায়  

COMMENTS

error: