একটি অঞ্চলের ভাষা ও আচার-সংস্কৃতি বিষয়ে বই নিত্য প্রকাশিত না-হলেও সম্প্রতি বাংলাদেশে পেশাদার-অপেশাদার লেখকদের মধ্যে এই বিষয়ে লেখালেখি বাড়ছে। এইটা আশান্বিত হবার মতো সংবাদ আমাদের জন্য। অধুনা বাংলাদেশের সাহিত্যসৃজনে, একইসঙ্গে সৃজনশীল ও মননশীল উভয় ক্ষেত্রে, লেখ্য রচনার ব্যঞ্জনা ও বৈভব বাড়াতে লেখকেরা নানান নিরীক্ষায় ব্যপৃত হচ্ছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় এবং সম্ভ্রমও আদায় করে নিচ্ছেন মূলধারা মানভাষা-ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তদের কাছ থেকে। লেখকেরা যার যার দরকার অনুযায়ী দ্বারস্থ হচ্ছেন বহুবৈচিত্র্যবাহী উচ্চারণ, ধ্বনিবলয় এবং শব্দসম্ভারে ধনী বিভিন্ন অঞ্চলভাষা আর লোকজ কৃষ্টিগুলোর। ফলে এতদবিষয়ে লেখা বইয়ের কদরও বাড়ছে। সেই তুলনায় ভালো গবেষণাসমর্থিত বইয়ের উপস্থিতি খুব-যে বেশি নেই, বিশেষত অঞ্চলভাষা সংক্রান্ত বইপত্র অপ্রতুল বললেও কমিয়ে বলা হয়, এই বিষয়ে একমত হবেন ভুক্তভোগী ও কৌতূহলী পাঠক সকলেই।
‘সিলেট : ভাষাবৈচিত্র্য ও শব্দসম্পদ’ উপর্যুক্ত অপ্রতুলতার আক্ষেপ কিছুটা লাঘব করতে পারে বলেই মনে হয়েছে। এই বইটা হাতে নিয়ে পাঠকবর্গ অন্যান্য অনেক সমালোচ্য অনুষঙ্গ সত্ত্বেও কথাটা আলবৎ স্বীকার করবেন যে এইটা কাজের বই। স্বীকার করতে অকুণ্ঠ হবেন এই বইটার মৌলিকত্ব বিষয়ে। এটি লিখেছেন মালিক আনোয়ার। বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক ভাষাগবেষণায় এটি উল্লেখযোগ্য একটা কাজ। গ্রন্থপ্রণেতা আগেও সমগোত্রীয় অঞ্চলভাষা উপজীব্য করে গবেষণা করেছেন, গ্রন্থ প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছেন, সমাদৃত হয়েছে সেই কাজগুলো মুখ্যত অঞ্চলগবেষণাকাজে ব্যপৃত বিদ্বৎসমাজে। এই বইটি সেদিক থেকে লেখককে অনেক বেশি বিস্তৃতি দিয়েছে ব্যাপকতর প্রতিপাদ্য ধরে কাজ করার। লেখক অনেক পরিশ্রম ও প্রজ্ঞা লগ্নি করেই বইটি লিখেছেন, কথাটা বাহুল্য নয় আদৌ। বইটির সাড়ে-তিনশ পৃষ্ঠাব্যাপ্তি এবং মোটমাট বারোটি অধ্যায়ের অন্তর্ভূত পঁচিশটি উপ-অধ্যায়ে বিন্যাস্ত সজ্জা দেখলেই বোঝা যায় লেখকের সপ্রেম শ্রমের বিনিয়োগ কতদূর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত।
সরাসরি ফিল্ডওয়ার্ক গবেষকের কাজে এক-ধরনের এনথ্রোপোলোজিক্যাল্ এবং এথনোগ্র্যাফিক্ অবলোকনের অবকাশ করে দিয়েছে এখানে, যা বইটিকে এ-ধারার আর-দশটা কাজের থেকে আলাদা কাতারে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। মালিক আনোয়ার প্রণীত ‘সিলেট : ভাষাবৈচিত্র্য ও শব্দসম্পদ’ গবেষণাগ্রন্থটি দীর্ঘজীবী হবার সমস্ত চিহ্ন শরীরে রেখেছে ধরে; এবং স্বনিয়োজিত ও স্বনিষ্ঠ অনুসন্ধানী ভাষাপ্রেমী/শিক্ষার্থী কেউই বইটি হাতে নিয়ে নিরাশ হবেন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে যেমনটা হামেশা দেখা যায় রিসার্চারের অদ্ভুতুড়ে প্যাঁচপয়জারভরা আলেখ্য, যা পাঠোত্তর না পাওয়া যায় বীক্ষণের নতুন কোনো আলো অথবা অন্তর্দৃষ্টি, না পাওয়া যায় ত্রিভুবন-ধন্য-করা জ্ঞানগম্যি, এই বই তেমন কোনো দুর্ঘট নয়। এটি নয় গবেষণার নামে কোনো উদ্ধৃতিচিৎকৃত গলগণ্ডগ্রন্থ। একেবারেই দিনানুদৈনিক ব্যবহৃত কথাবার্তার ভিতর থেকে আহৃত ও সুচয়িত এর শব্দসংগ্রহ ও উদাহরণসম্ভার।
অত্যন্ত উপভোগ্য ও অনবদ্য এই বইয়ের অভিধান অংশ। সুবিস্তৃত অভিধানভাগে যেমন হয়েছে প্রচলিত শব্দসমূহের সংরক্ষণ, শব্দের ব্যুৎপত্তিঠিকানা আর তাদের ব্যাকরণশৃঙ্খলাও সমানভাবেই গৃহীত হয়েছে, তেমনি ইদানীং-লুপ্ত ও প্রয়োগবিস্মৃত তথা অপ্রচলিত শব্দাবলিও হয়েছে সমান মর্যাদায় আলোচনার উপজীব্য। গ্রন্থপ্রণেতার আলোচনা চালানোর ভঙ্গিটিও যথেষ্ট প্রাঞ্জল, সরল ও সরস।
গ্রন্থটির মুখবন্ধ লিখেছেন হায়াৎ মামুদ। দেখা যাচ্ছে, সেই মুখবন্ধে, হায়াৎ মামুদ সাক্ষ্য দিচ্ছেন এই বই :
… চরিত্রে গবেষণাগ্রন্থ হলেও ডিগ্রিপ্রত্যাশী সারস্বতচর্চা নয়। লেখার পশ্চাতে আত্মিক প্রণোদনা ক্রিয়াশীল থাকায় এর গুরুত্ব অন্য রকম। শ্রীহট্টী বাংলা ভাষার রূপ নিয়ে এত বিস্তৃত আলোচনা পূর্বে কেউ করেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই।
কিংবা হায়াৎ মামুদের মুখবন্ধ ছাড়াও স্বয়ং গ্রন্থপ্রণেতার নিবেদিত ‘লেখকের কথা’-র পাশাপাশি রয়েছে আরেকটা ভূমিকাবাচন, যেখানে একটা তাৎপর্য টুকতে যেয়ে ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ হাজির করেছেন এমন বেশকিছু শংসাবাক্য :
… গ্রন্থের আকর্ষণীয় দিক হলো নাগরী লিপি সম্পর্কিত আলোচনা। মালিক আনোয়ার সযত্ন পরিশ্রমে নাগরী লিপির নমুনা সংগ্রহের পর বাংলার সঙ্গে লিপি গঠনের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। … তিনি একজন অনুসন্ধানকারীর দৃষ্টিতে সিলেটের ভাষার বৈচিত্র্য অবলোকন করে তার একটা পূর্ণ রূপ দেবার যে চেষ্টা করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য।
বইটা এমনিতেই ভালো, কন্টেন্টের সারবত্তা থাকার কারণেই গুরুত্বপূর্ণ, তবু দু-দুটো ভূমিকাভাষ্য সংযুক্ত করে দেবার দরকার হয় কেন? অবাঞ্ছিত না-হলেও অভিপ্রেতও নয় হেন থোড়-বড়ি-খাড়া মাস্টারমশাইদিগের দিগদারি। বিশেষত সম্পন্ন গুণের এমন একটা বইয়ের শুরুতেই এহেন অন্য গোসাঁইয়ের ভূমিকাবাদ্যি জিল্লতি ছাড়া পাঠককে বেশিকিছু উপহার দ্যায় বলে মনে হয় না। তা-ও যদি ভিন্নকৌণিক কোনো দিগন্তদর্শী দিশার সঞ্চার হতো ভূমিকা আর মুখবন্ধ পড়ে সেরে, হতো যদি ভিন্নতর মূল্য সংযোজিত, মেনে নেয়া খানিকটা হলেও যেত হয়তো। রচয়িতার ভূমিকা ছাড়া আর-কোনো পুরোতব্যক্তির ভূমিকা পাঠকের সঙ্গে লেখকের সরাসরি রিলেশন বিল্ডাপ করার ক্ষেত্রে সেতু না-হয়ে অন্তরায়ও হতে পারে; কেবল অত্র মুখবন্ধ-ও-ভূমিকারচক অধ্যাপকদ্বয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এর একটা ইম্প্যাক্ট ক্রিয়া করলেও করতে পারে। পেশাদারি গবেষক নন বলেই হয়তো গ্রন্থপ্রণেতা খানিকটা আত্মবিশ্বাস অর্জন করে নিতে চেয়েছেন গ্রন্থসূচনায় শিক্ষকবাক্য সংযোজিত করে। এই বইয়ের জন্য অন্তত দরকারি ছিল না ব্যাপারটা। আদৌ কি বিদ্যায়তিক পরিমণ্ডলে, অ্যাকাডেমিয়ায়, স্পেস্ করে নেবার ক্ষেত্রে শিক্ষকবাক্য সহায়ক হয়?
অ্যানিওয়ে। পেশাদারি নয় কিন্তু পরিশ্রমী এই কাজটা, মালিক আনোয়ার প্রণীত ‘সিলেট : ভাষাবৈচিত্র্য ও শব্দসম্পদ’ বইটা, বাংলা ভাষাপ্রেমীদের যোগাবে রস এবং রসদ; সমাদরণীয় হোক বইটা, আমাদের কায়মনোবাসনা এইটুকু।
বইটার প্রচ্ছদ করেছেন আককাস খান। প্রকাশ করেছে ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’, বাংলাবাজার ঢাকা থেকে, প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে। মূল্য বাংলাদেশী মুদ্রায় ৪৫০.০০ (চারশ পঞ্চাশ টাকা) মাত্র।
বইরিভিয়্যু : তোজাম্মেল তালুকদার তোতা
… …
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS