বাংলার লাঠিয়াল || মাহফুজুল আম্বিয়া ও শহীদ মুহাম্মদ আসিফ

বাংলার লাঠিয়াল || মাহফুজুল আম্বিয়া ও শহীদ মুহাম্মদ আসিফ

থাকে দুই দল
খবরদার
এক পা এগোবি না আর

ধরুন, আপনার ঘরের দেয়ালে জেমসের একটি পোস্টার সাঁটা আছে – তখনই শুরু হবে ঝামেলা। আত্মীয়-অনাত্মীয় যে-ই আপনার ঘরটিতে পদার্পণ করুক না কেন পোস্টারটি দেখা মাত্র চোখ ছোট ছোট করে, ঠোঁট বাঁকিয়ে মুখে বেশ একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব এনে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করবেন, “এই পাগলটা কে রে?” আজকালকার ছেলেমেয়েদের কী যে অভিরুচি কিছুই বুঝি না। না আছে তালজ্ঞান, না আছে সুর – শুধু পাগলের মতো চুল নাচায় আর বিকট গলায় চ্যাঁচায় – এর ছবি ঘরে টাঙাবার মতো কী আছে বাপু? আর এখানেই সকল ঝামেলার সূত্রপাত, একদল বলছে জয়গুরু, আরেকদলের মতে ওটা একটা লোক, আর তার গানগুলোও তেমন পচা পচা। এ বিরোধ মেটাবার দায়িত্ব আমাদের নয়। কিন্তু কী আছে জেমস-এ? কিসের সম্মোহনে বশ করে রেখেছেন তিনি আমাদের?

আপনাকে ভালোবেসে আপন দেশে
কি আছে জেমসের? প্রশ্নটা অনেকের মুখেই শোনা যায়। আসলে জেমসের সবকিছু একান্তই তার। জেমসের মাঝে আর কারো ছায়া আবিষ্কার করতে না পেরে তাই জেমসবিদ্বেষীরা আজ সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত, একটা গানের সুরে হাজার তরুণের হৃদয়কে যিনি একসুতোয় বাঁধতে পারেন তিনি নিশ্চয়ই সাধারণ নন। মানিব্যাগের ভাঁজে ভাঁজে রংধনুচাদরে যার অস্তিত্ব মিশে আছে তিনিই আমাদের এই জামানার গুরু। জেমসের এই অসাধারণ এক বিচিত্র জনপ্রিয়তার কারণ কিন্তু ওই একটাই তার স্বকীয়তা। বিশুদ্ধ নিজস্বতার শক্তিই জেমসকে করেছে অপ্রতিরোধ্য।

গানের কারিগর
বাংলা গানের জগতে জেমস্ ব্যতিক্রম। পপ বা ব্যান্ড গান যা-ই বলুন না কেন, জেমস্ তাতে নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করেছেন। অষ্ট আঙুলে গিটার বাজিয়ে পয়দা করে চলেন তিনি নিত্যনতুন সুর। আর সেই সুরের আবর্তে নাজিল হয় একের পর এক গান। ডিস্টিউনড গলায়। অন্তর বাজিয়ে এ-প্রজন্মের কাছে তিনি গুরু।

একজন বিবাগী
কাঁধঝাঁকা চুল রুক্ষ। ঈষৎ লাল চোখ – কিন্তু বড্ড মায়াকাড়া। ঘামে-ভেজা শাদা পাঞ্জাবি, সাথে জিন্স আর স্যান্ডেল। কাঁধে কখনো শাল, কখনো-বা হুজুরদের মতো ওড়না। ধাঁচটা ভিন্ন হলেও ধন্বন্তরী। এই আমাদের গুরু। আমাদের জেমস্। কন্সার্টের মঞ্চে বা কোনো আনন্দসন্ধ্যায় এই আউলা চুলের বাউলা ভঙ্গিতে তিনি মাতাল করেন প্রজন্মকে। কিন্তু, কিসের নেশায়?

জেমসজামানা
জেমস্ গান করেন সেই ১৯৮১ সাল থেকেই। কিন্তু, ‘স্টেশন রোড’, ‘অনন্যা’ – এই অ্যালবামগুলোতে জেমসকে আমাদের গুরু মনে হয়নি মোটেই। ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবামটিতেই প্রথম শোনা গিয়েছিল গুরুর পদধ্বনি। এরপর ‘পালাবে কোথায়’। পুরোপুরি স্বতন্ত্র ধারায় আত্মপ্রকাশ ঘটল কর্কশ কিন্তু প্রেমিক এক বাউলের, তারপরই ‘নগরবাউল’। সুপারহিট যাকে বলে। ‘নগরবাউল’ হয়ে উঠল জেমসের ট্রেডমার্ক। এরই মাঝে এল ‘দুঃখিনী দুঃখ কোরো না’। এই অ্যালবামটি অসাধারণ ব্যবসায়িক সাফল্য পেলেও জেমস্ এটিকে তার সেরা কাজ বলে মনে করেন না। প্রতিভাবানেরা একবার পাওয়া সাফল্যের পথে বারবার হাঁটেন না, হয়তো তাই, সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে বাংলা ঘরানার গান নিয়ে জেমস্ গাইলেন ‘লেইস ফিতা লেইস’। বোদ্ধাদের মতে অত্যন্ত ম্যাচিউর্ড এক প্রভাববিস্তারী এই অ্যালবামটি বাংলা ব্যান্ডের গানে জেমসতরিকাকে প্রতিষ্ঠা করেছে দাপটের সাথে। জেমসের সোলো অ্যালবাম ‘ঠিক আছে বন্ধু’  দিয়ে আরেকবার আরেকটা ধাক্কা মেরেছেন জেমস্। ধাক্কার দিকটাও বড় জব্বর। বাংলার তরুণ প্রজন্ম যাকে খুঁজে ফিরছিল বহুদিন ধরে তাকে চিনে নিতে তারা ভুল করেনি এতটুকু। তাই তো আজ সাধন-ভজন-চিত্তরঞ্জন সর্বত্র তিনিই আমাদের গুরু।

সন্ধ্যার গুরু, গুরুর সন্ধ্যা
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল। কন্সার্ট হচ্ছে, তখন সন্ধ্যা। গাইছেন জেমস্। গুরুর সুরের সুরায় আকণ্ঠ মাতাল ভক্ত প্রেমিক। হঠাৎ গোলমাল। দুইদল তরুণের মাঝে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে তুমুল সংঘাত। এরই মাঝে গুরুর গলা – ‘তোদের মাঝে কি কেউ নেই রে বন্ধু আমার?’ আমরা সমস্বরে গলা ফাটাই, আছি গুরু! আছি! ‘তবে তোরা আজ আর কেউ বিবাদ করিস না। সব ভুলে উল্লাস কর।’  ব্যস! এক বাণীতেই সব বিষ ঝেড়ে চৈত্রের তুলোর মতো হাল্কা। আবার শুরু হয় তার ছেঁড়া গিটারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। গুরু বুঝি কাঁদছে। জাগো গুরু! আর তোমার ঝাঁকড়া চুলের ঝাঁকুনিতে জাগিয়ে তোলো আমাদের।

বেলা গেল রে ভবের মায়ায় …
ভবের পাগলামি ছেড়ে তোরা ভাবের পাগল হ। তবেই তো দীক্ষা পাবি গুরুর চরণে। একটা সুতোকাটা এতিম ঘুড়ি, বুকে চেপে ধরা বালিশ, নাজায়েজ ইচ্ছে কিংবা তিতাস মলম – এর মাঝেই হয়তো পাইবা তারে। আমরা কেবল ভালোবাসব – ভালোবেসেই যাব। আর গ্লাসভরতি অন্ধকার নিয়ে ঘুরে বেড়াব পথিকবিহীন পথে। জয় গুরু!


লেখকতথ্য :  মাহফুজুল আম্বিয়া ও শহীদ মুহাম্মদ আসিফ / ৮২১ পশ্চিম কাজীপাড়া, বেগম রোকেয়া সরণি, মিরপুর, ঢাকা ১২১৬
প্রথম-প্রকাশতথ্য : আনন্দভুবন ঈদসংখ্যা ২০০০ ।। বর্ষ ৪ সংখ্যা ১৬ ।। জানুয়ারি ২০০০ ঢাকা

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you