মুজিব মেহদী : কথার সংবেদন ও শানবিদ্যা || আহমদ মিনহাজ

মুজিব মেহদী : কথার সংবেদন ও শানবিদ্যা || আহমদ মিনহাজ

সময়-স্বকীয়তার গহিনে বিগত তিন দশক ধরে সাঁতারপটু মুজিব মেহদীর ‘মমি উপত্যকা’ ‘ময়দানের হাওয়া’ ও ‘চিরপুষ্প একাকী ফুটেছে’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পাওয়া কবিতারা দশকি ভাষা যাপনের অভিজ্ঞতা চিনে উঠতে পাঠককে সাহায্য করে :—

স্তূপ স্তূপ এত-যে ভস্মগিরি ছড়ানো হাওয়ায়
এসব আমার — আমাদের সময়ঘটিত
বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার থকথকে যেন কোনো অনিবার ক্ষত

ক্লেদ-গ্লানি রূপভেদে এইমতো লভিয়াছে আর্ত-অবয়ব…
(নোনাধ্বনিকথা)


বিদেশ-বিভুঁইয়ে এই লাভ হলো — গর্জনশীলা এক সমুদ্র পেয়েছি বুকে, তার ওপরে হাওয়া, অফুরান শিৎকার

আদি পৃথিবীর স্যুভেনির বয়ে আনে এই বিশালতা, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে সেসব জমা করে রেখে দিই বিশাল তোমার নামে, বিশালের নামে নিবেদিত এইসব ভালো, এই মন্দ, সূর্য সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বহুকাল নৃত্য করে যাবে…
(সমুদ্রে)


কথার শক্তি বিষয়ে আমার ধারণা জন্মেছিল বেশ বালক বয়সে, কথাদের কলা হয়ে উঠতে যে অস্ত্রশস্ত্র লাগে, লাগে যে শানবিদ্যা, বাতাসের চেয়েও ওটা কম আয়ত্তে ছিল, এমনকি জানতাম না যে আয়রনি কাকে বলে, ঘৃণাকে ঘৃণার অধিক কিছু কখনো ভাবি নি

বহু তিতিক্ষা তরণি বেয়ে মতিফুল ফুটল এবার, রূপকাহিনির ভিড়ে ঢাকের বাদ্যের নিচে প্রকাশ্য শব্দ পেলাম মন খুলবার, সাক্ষী হয়ে মাথা নাড়ল শস্যসুরভি…
(মন খুলবার শব্দ)

মিতকথনে স্বচ্ছন্দ কবির টুকরো কাহিনি দিয়ে মোড়ানো অনুষঙ্গ তাঁর ভাষাঅঙ্গে অণুগল্পের রেশ রেখে যায়। নব্বইয়ের কবিতায় স্টোরিটেলিং বিচিত্র পথে ঘটলেও মুজিব মেহদীর গল্পবলা ও সেখান থেকে এক্সিট নেওয়ার কুশলতা তাঁকে অন্যদের থেকে পৃথক রাখে। টুকরো ঘটনা দিয়ে গাঁথা বয়ান লঘুচিত্ত ও দ্রুতগামী মনে হলেও অন্তরালে যেসব পরিহাস ও চাপা বেদনা ফেলে ছড়িয়ে যায় পাঠকের অনুভবে শান দেওয়ার জন্য সেগুলো উত্তম খোরাকি বটে :—

নতুন ভাড়াটে এল পাশের বাড়িতে
মালামাল সব উঠছে ওপরে
ট্রাকভর্তি অনেক প্যাকেট
আসবাবের সাথে একটা বিষাদ উঠছে
হাঁড়িপাতিলের সাথে একটা কান্না
পালঙ্কের সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস
ওয়ার্ডরোবের সাথে একটা অভিমান
পোশাকের সাথে একটা অপমানবোধ
মাত্র তিন রুমের ফ্ল্যাট
এত সব জিনিস কী আঁটবে ওখানে!
(ভাড়াটে)

এই বয়ান-আঙ্গিকে শঙ্খ ঘোষ ও রণজিৎ দাশ পাঠকমনে চকিত হানা দিলেও যে-গল্পটি এখানে বলা হয়েছে তার কন্ট্রাস্ট বাকি সবকিছু ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে। স্থানান্তর মুজিব মেহদীর কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। স্থানান্তর মানে কেবল জায়গা বদল এমন তো নয়, তার সঙ্গে অভ্যাসের রদবদল সেখানে বিবেচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। অভ্যাস হলো যাপিত জীবনকে ঘিরে থাকা খুঁটিনাটি যা হয়তো কোনোদিন ফেরত আসবে না! প্রতিটি স্থানান্তরের সঙ্গে মানুষ এমন কিছু পেছনে ফেলে আসতে বাধ্য হয় যাকে ফিরে পাওয়ার উপায় থাকে না। বিচিত্র অনুষঙ্গে যাপনের সুবাদে মানুষের জীবনে যেসব অভ্যাস প্রাত্যহিক হয়ে ওঠে তাদেরকে ইচ্ছা করলেই ফিরিয়ে আনা যায় না। স্থানবদল বা অবস্থান্তরের মতো মুহূর্ত যখন অমোঘ হয়, অভ্যাস যাপন থেকে জন্ম নেওয়া মায়ার মূল্য মানুষের কাছে দামি হয়ে ওঠে। স্থানান্তর অগত্যা মনে করিয়ে দেয় জীবন আসলে পদ্মপাতার জল! অভ্যাস থেকে জন্ম নেওয়া স্মৃতিরা চিরস্থায়ী নয় কারণ জীবন নিজে অচিরস্থায়ী! ‘ময়দানের হাওয়া’ কাব্যগ্রন্থে বাড়ি-বদলের (দ্রষ্টব্য : বিড়ালটি) ঘটনায় কাজলা বিড়ালকে ঘিরে যে-মায়া জন্ম নিয়েছিল তাকে পেছনে ফেলে আসতে হয়েছে। ‘ভাড়াটে’ কবিতায় নতুন ভাড়াটে এমন কোনো অভ্যাস হয়তো পেছনে রেখে আসে যাকে তিনরুমের ছোট্ট পরিসরে আঁটানোর নয়! ভাড়াটের সঙ্গে আসা মালামালের প্রাচুর্য মনে করিয়ে দিচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্য এক ক্ষণস্থায়ী অভ্যাস বটে। হাইকু অঙ্গের কবিতায় মহার্ঘ হয়ে ওঠা কাহিনির আড়ালে কাহিনি আর ‘সর্ব্বম ক্ষণিকম’-র অনুভূতি মুজিব মেহদীর ভাষাঅঙ্গে নীরব ছায়াপাত ঘটায়। যারপরনাই তাঁর অণুগল্পসদৃশ বয়নকুশলতাকে সংবেদী অনুভব সহ পাঠে পাঠকের আটকায় না।

এই সংবেদন নব্বইয়ের কবিতার বড়ো বাঁক হওয়ার কথা ছিল, যদিও তিন দশকের অন্তে এসে কতটা প্রভাববিস্তারী হতে পেরেছে তার অনুসন্ধান কেউ হয়তো একদিন করবেন। কবিতায় হিউমার ও আয়রনির প্রয়োগ বিষয়ে হাইকুভক্ত কবির ভাবনা সতীর্থদের থেকে ভিন্ন। নব্বইয়ের কবিমহলে কথাবার্তা হয় কি না জানা নেই তবে সরস জীবনরস মুজিব মেহদীর কবিতায় প্রায়শ চুঁইয়ে পড়ে। ঘূর্ণিসঙ্কুল ত্রিশ বছরের জার্নি স্মরণ করলে এই রিলিফ পাঠকের জন্য প্রাপ্তি হয়েই আসে। তাঁর কবিতা সকলে ছাপেন, সকল কবিতা নামের প্রতি সুবিচার করে এমন নয়, কিন্তু ‘শর্মা বিষয়ক জটিলতা’ অঙ্গের কবিতা কি অধিক লেখা হয়েছে বাংলাদেশে? বাংলা কবিতায় ‘প্রভাব, পরম্পরা, বিচ্ছেদ, সংযোগ’ ইত্যাদি নিয়ে যত ক্যাঁচাল তার বৃহদাংশ মুজিব মেহদীর রসিক ও পরিহাসদীপ্ত বয়নকুশলতায় নিহিত ভাবুকতা যেন নাকচ করে যায়। দীর্ঘ হলেও উদ্ধৃতি প্রীতিকর; যদি হায় শর্মাকলঙ্কিত কণ্টকাভাষ পাঠের পর দশকি তুলনাছকের বাইরে গিয়ে কবিতার নিজস্বতা অবধানে পাঠকের মতি হয়!

কখনো চিকেন শর্মা খেতে খেতে তনুজা শর্মার কথা
মনে পড়ে গেলে
কারো কোনো দায় নেই চিকেন বা তনুজার
সব দায় গিয়ে বর্তায় কুচিকুচি শর্মায়
প্রভাব শব্দটি ঘিরে যা কিছু অস্বস্তি আমার
শর্মার বরাতে দেখি কিছুটা কমেছে তাই
সাহসে দাঁড়াই এসে প্রকাশ্য রোদ্দুরে

চুল দেখলেই যারা মেয়ে ঠাওরায়
আর গোঁফ দেখলেই পুরুষ বেড়াল
মোটেই তাদের কথা হচ্ছে না এখানে
নিন্দুকের হাতে অস্ত্রের মজুত বাড়ানো
কখনো কাজের কথা নয়

আমরা বলছি ঐতিহ্যের কথা
কথা বলছি পরম্পরার
ছেঁড়া নদী কেননা কখনো সাগরে পৌঁছে না
থেমে থাকে কানাগলিতে এসে সকল যন্ত্রযান

বেড়াল থাকল বেড়ালের জায়গায়
মেয়েও থাকল মেয়েতেই
চোরা উল্লিখনে ছেয়ে গেল কেবল
বাংলা কবিতার ঝাড় ও জঙ্গল…
(শর্মা বিষয়ক জটিলতা)

‘মমি উপত্যকা’-য় সক্রিয় কবি মুজিব মেহদী পাঠকের অতি চেনা। ইঙ্গিত-আশ্রিত ভাষার আবরণে যে-কথাগুলো সেখানে তিনি বলতে চাইছিলেন সেগুলো কেন যেন বলি বলি করেও অনুক্তই থেকে গিয়েছিল। ‘চিরপুষ্প একাকী ফুটেছে’ ও ‘ময়দানের হাওয়া’-য় অর্থসংকেত ক্ষুণ্ণ না করে অনুক্ত কথারা নোঙর খুঁজে পেয়েছিল। আপাত সর্বশেষ ‘ধূলি ওড়ানোর ভঙ্গি’ কাব্যগ্রন্থে উপনীত কবি এক সাবলীল কথাকার। তুচ্ছ ও ক্ষণিক অনুষঙ্গে নিজেকে জুড়ে নিয়ে জীবনবেদের কিনারা খোঁজার বয়ানে তাঁকে এখন অধিক পরিণত ও আত্মবিশ্বাসী দেখায়।


নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you