বাংলাদেশ লোকসংগীতে সমৃদ্ধ শুধু নয়, বিশ্বলোকসংগীতের ভাণ্ডারও। জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন (১৮৫১-১৯৪১) থেকে রমা রলাঁ (১৮৬৬-১৯৪৪) সকলেই এই ভাণ্ডার ও বিচিত্রতা দেখে চমৎকৃতও হয়েছেন। কিন্তু কেন এই ভাণ্ডার, লোকসংগীতের কেন এই রূপবৈচিত্র্য? এই প্রশ্নের অনুসন্ধানে ফোকলোরবিদরা দেখেছেন বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রতিবেশ; প্রত্যক্ষ করেছেন অর্থনেতিক, ধর্মীয় ও সমাজ-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এবং উৎপাদ হিসেবে এদের বলিষ্ঠ ভূমিকা। বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশ আবার সর্বত্র সমান নয় বলে, ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক ও সমাজসাংস্কৃতিক পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের লোকসংগীতের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। তাই লোকসংগীতের আলোচনায় অনেকে বাংলাদেশকে বিভিন্ন সংগীতাঞ্চল যেমন ভাওয়াইয়া, মালসী, গম্ভীরা, বাউল, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি-মারিফতি প্রভৃতি অঞ্চলে বিভক্ত করে থাকেন। ঘাটুগান লোকসংগীতের অন্তর্ভুক্ত বলে তারও একটা আঞ্চলিক অবস্থান বিদ্যমান। দেখা গেছে বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল অঞ্চল এর উদ্ভব-বিস্তার ও বিকাশের ক্ষেত্র। ঘাটুগানের উদ্ভব-বিকাশে অন্যসকল লোকসংগীতের মতোই এর পেছনে ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট ক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করেছে। ঘাটুগান খাল-বিল, নদী-নালা, হাওড়-বাঁওড় অধ্যুষিত ভাটি অঞ্চলের লোকসংগীত। ভাটি অঞ্চলে লোকায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে সমাজ-সংহতি রক্ষা করে বিভিন্ন ‘একীকারক (unifying) সাংস্কৃতিক উপাদান’ মিলে যে-লোকসংস্কৃতি গড়ে ওঠে ঘাটুগান তা থেকেই জাত। তাহলেও এর ভিতর দিয়ে বাঙালির অখণ্ড জাতীয় অনুভূতি স্পন্দমান এবং তা জাতীয় গীতি-সংস্কৃতির একটি অঙ্গও।
২.
ঘাটুগান ভাটি বাংলার গান; কিন্তু ভাটিয়ালি গান নয়। যদিও ভাটিয়ালি গানের সঙ্গে তার একটা সঙ্গতিও রয়েছে। বলতে গেলে ভাটিবাংলার প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের অনিবার্য অভিব্যক্তি এই গানগুলো। ভাটিয়ালি গানের পরিবেশসূত্রের সঙ্গে এরও সাজুয্য পরিলক্ষিত হয়। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, ভাটিয়ালি গানের আদি উৎপত্তিস্থল সিলেট ও ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ হাওড়-অঞ্চল। আর হাবিবুর রহমান ভাটিয়ালি প্রসারণ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, সুরমা-মেঘনা নদীর উপত্যকায় এ-গানগুলো পরিপূর্ণতা পায় এবং পরে প্রসারণ ঘটে পূর্ববঙ্গের নদীতীরবর্তী অঞ্চলে। ঘাটুগান সম্পর্কে ওই একই কথা বলা চলে যে, উজানে আসামের শিলচর-করিমগঞ্জ থেকে ত্রিপুরার উত্তরাংশ এবং ময়মনসিংহের যেখানে শেষ সেখান থেকে ভাওয়াল হয়ে টাঙ্গাইল পর্যন্ত ঘাটুগানের বিস্তারে ওই একই প্রাকৃতিক কার্যকারণসূত্র জড়িত ছিল।
ভাটির প্রাকৃতিক পরিবেশটাই এমন যে, বছরের প্রায় ছয়-সাত মাস সময় বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানিতে ভাসমান থাকে। মানুষের প্রধান পেশা কৃষি; ঘরে ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গে বর্ষা চলে আসে, চারদিকে পানিতে থই থই করে গ্রাম-গ্রামান্তর, হাওড়-বিল-নদী। মানুষের জীবনে আসে অখÐ অবসর। সেই অবসরের বিনোদনেই উদ্ভব হয় নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন। এই আয়োজনের একটি হচ্ছে ঘাটুনাচের সঙ্গে ঘাটুগানের আসর। ঘাটুগানের আসরের প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ প্রসঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্য লিখেছেন যে,
ঘাটুগানের সময় বর্ষা ও শরৎকাল। পূর্ব মৈমনসিংহের বিস্তৃত জলাভূমির মধ্যে যখন বর্ষার জল সঞ্চিত হইয়া হাওড় বা সাগর বলিয়া ভ্রমোৎপাদন করে, সেই সময়ই ঘাটুগানের সময়। হাওরের বুকে বিস্তৃত নৌকার পাটাতনের উপর ঘাটুর আসর বসে, তারপর হাওরের প্রান্তবর্তী গ্রামগুলির ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়াইয়া দিবারাত্র অব্যাহত এই গান চলিতে থাকে।
শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চল নয়, সিলেট সহ অপরাপর যেসব অঞ্চলে ঘাটুগান প্রচলিত ছিল তাতেও সমান প্রাকৃতিক পরিবেশে এই গানের প্রসারণ-বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিজনিত যুবাদের ছদ্ম-বেকারত্ব ও অখণ্ড অবসর যে ঘাটুগানের উদ্ভবের প্রধান কারণ তাতে দ্বিমতের কোনও অবকাশ নেই। সেজন্য দেখা গেছে যখন কৃষিকাজের মরশুম, তখন এসব অঞ্চলে ঘাটুগানের আসর বসতো না। অবশ্য পরবর্তীকালে, শুধু বর্ষাকালে নয়, বছরের অন্যসময়েও গ্রামাঞ্চলে ঘাটুগানের আসরের সন্ধানও মেলে। সেটাও অগ্রহায়ণের ধানকাটার অবসরে কিংবা ধানকেটে ঘরে তোলার পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত হতো।
প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যেই সংস্কৃতির উপাদান মিশ্রিত থাকে; তাই প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনও পরিলক্ষিত হয় পৃথিবীর সর্বত্র। সংস্কৃতির সঙ্গে আবার নৃতাত্তি¡ক ও ধর্মনৈতিক যোগসূত্রও বিদ্যমান থাকে। এসব বিচিত্র উপাদানের মিথস্ক্রিয়ায় লোকবিশ্বাস ও লোকসংস্কারের জন্ম হয় এবং তাতে গড়ে ওঠে ভাবাত্মক পরিবেশও। লোকজীবনের বিশ্বাস, দর্শন, ধ্যান-ধারণাকে ভিত্তি করে গড়ে-ওঠা ভাবমূলক পরিবেশ নিয়েই লোকসমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং সেই পরিবেশ থেকে উদ্গত হয় লোকসমাজের সার্বিক কৃষ্টি ও জীবনের সামূহিক আনুষঙ্গিকতা। তাই প্রচলিত অঞ্চলসমূহের লোকজীবন, লোকভাব ও লোকভাষার প্রতিফলন ঘাটুগানের মধ্যে পাওয়া যায়। উদ্ভবের পেছনে আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের অনুষঙ্গ ধরা পড়ে আশুতোষের রচনায় যে,
এই সময়ের মধ্যে যদি পল্লির কোনও উৎসব দেখা দেয়, তবে সেই উপলক্ষ্যে সংগীতের আর বিরাম হয় না। ভাদ্রমাসের প্রথম দিন মনসার ভাসান উপলক্ষ্যে বড়ো হাওরের পূর্ব-প্রান্তবর্তী ‘নিকলি’ নামক স্থানে এখনও শত শত ঘাটুর নৌকা আসিয়া সমবেত হয়। বিজয়া-উৎসবের দিনও পূর্বে কোনও কোনও অঞ্চলে ঘাটুগানের বিশেষ সমারোহ হইত, কিন্তু পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিজয়া-উৎসব অপেক্ষা মনসার ভাসান উৎসবই অধিকতর জনপ্রিয় বলিয়া এই উপলক্ষ্যে এখনও জনসাধারণ তুমুল সাড়া অনুভব করিয়া থাকে।
সমান ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় সুনামগঞ্জের এককালের ঘাটুগানের দোহার মনিরউদ্দিন নূরীর স্মৃতিচারণে। তিনি শীতকালে ঘাটুগানের প্রচলনের কথা ছাড়াও বর্ষার সময়কার বড়ো আসরের বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন তথ্যসহকারে। বিভিন্ন পূজা-পার্বণ যে ঘাটুগানের একটা অনুষঙ্গ ছিল হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় নির্বিশেষে, সে-প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে,
আমি যেটা বলেছি সেটা হিন্দুদের বারুণী মেলাতে এই অনুষ্ঠান হতো একটানা তিন দিন তিন রাত। সম্ভবত আষাঢ় মাস বা শ্রাবণ-মাসের ভরা বর্ষায় এটা হতো। অনেক ‘খেলুয়া নাও’ [নৌকাবাইচের নৌকা] যেত সেখানে। গান গেয়ে গেয়ে একটার পর একটা নৌকা যাচ্ছে। একটার মধ্যে দেখেছি একটা ঘাটু নাচতেছে, পরের নৌকায় দেখতে পেলাম দুইজন ঘাটু নাচতেছে। সামনে একজন পিছনে একজন নাচতেছে তবে একই গান গাওয়া হচ্ছে। […] বাংলাদেশের মধ্যে সব চেয়ে ঘাটু মেলা হতো ‘রৌয়াইল বিলে’। এখানে বারুণী মেলা উপলক্ষে ঘাটুমেলা হতো।
সুতরাং নেত্রকোণার নিকলির মতো হবিগঞ্জের রৌয়াইল বিল ঘাটুগান প্রতিযোগিতা বা উৎসবের প্রধান একটি কেন্দ্র ছিল। উৎসবের ছোটো ছোটো কেন্দ্রের মধ্যে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর, উত্তর সিলেটের কিছু হাওর এবং দক্ষিণ সিলেটের বিভিন্ন হাওরের কথাও বলেছেন এককালের ঘাটুর সৌখিন ও সমজদারেরা।
ঘাটুগানের উদ্ভবের মূলে শ্রীরাধার বিরহ অর্থাৎ কৃষ্ণবিরহে অধীর ভক্ত হৃদয় হতে; অর্থাৎ ঘাটুগান হিন্দুসমাজজাত। তা হলেও, পরে মুসলমান-সমাজে এই গান ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীকালে প্রচলন-প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুদের স্থলে আসেন মুসলমানরা। মুসলমান-সমাজের সাংস্কৃতিক আত্মীকরণ এবং সমন্বয়েও ঘাটুগান লোকসংস্কৃতির একটি ধারা হয়ে ওঠে। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের আত্মজীবনীতে বিষয়টি এভাবে পাওয়া যায় যে,
যে-হিন্দুদের কৃষ্ণপূজার নবপদ্ধতি হিসেবে এ-গানের প্রচলন হয়, তা হিন্দুসমাজ থেকে বিদায় নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে অলৌকিকভাবে। আরও মজার বিষয় এই, কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা সমাজে মাংসভক্ষণ বিলকুল হারাম। মুসলিমদের ঘাটুসমাজে মাংসভক্ষণই ছিল বিশেষ রেওয়াজ, কোনও কোনও সময় দুই গায়ের শৌখিনদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে মেহমানদের আপ্যায়িত করা হতো বৈষ্ণবদের কাছে নিষিদ্ধ গো-মাংস দ্বারা।
অর্থাৎ ঘাটুগানকে কেন্দ্র করে একটা সাংস্কৃতিক প্রবাহ সমাজে তৈরি হয়েছিল। তবে সেটা যে সমাজের সকল স্তরে বিদ্যমান ছিল এমন নয়। ঘাটুগান উদ্ভবের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে এ-নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
ঘাটুগানের উদ্ভব ও প্রচলন কৃষিভিত্তিক গ্রাম-সমাজে। সেই গ্রাম-সমাজে, যেটা আবার ভাটি বাংলার। আশুতোষ ভট্টাচার্য থেকে জানা যায় যে, নিম্নশ্রেণির লোকের সুশ্রী সন্তানদেরই ঘাটু হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু যারা ঘাটু নাচায় কিংবা গানের আয়োজন করে তারা কারা? আশুতোষ ভট্টাচার্য এদের বলেছেন ‘শৌখিন সম্প্রদায়’। এই দুটি তথ্য ঘাটুগানের অপর গবেষকবৃন্দ যেমন সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী, রওশন ইজদানী, মোহাম্মদ আজরফ, আশরাফ সিদ্দিকী, ওয়াকিল আহমদ সহ সবাই স্বীকার করেছেন। এখানে ‘শৌখিন’ বলতে ‘অর্থনৈতিক শ্রেণি’ বুঝানো হয়েছে। ঘাটুগানের এই ‘শৌখিন শ্রেণি’ বাংলার ভূমিব্যবস্থার ফল। ঘাটুগানের উদ্ভবকাল যদি ষোলো শতকের শেষ কিংবা সতোরো দশকের প্রথমদিকে ধরা হয় তাহলে দেখা যাবে এসময়ে বাংলার রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বড়োধরনের রদবদল হয়ে যায়। ষোলো শতকের মাঝামাঝিতে বাংলায় পাঠান রাজবংশের অবসান হয় এবং নবাগত মুঘল শাসনে নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব হয় এবং এই শ্রেণির সঙ্গে প্রজা বা সাধারণ মানুষের দূরত্ব বেড়ে যায়। সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে আবার সাধারণ বাঙালি ভূমিউপজীবী হয়েও পড়ে। অবশ্য এর আগ থেকে বিদেশি বণিকদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে বাংলায় এবং দেশের অর্থনীতি বিশেষ খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। আঠারো শতকের শেষার্ধে পলাশীর যুদ্ধের পর গোটা রাজনৈতিক পরিস্থিতিই পালটাতে থাকে; শাসন ও ভূমিব্যবস্থায় আসে আমূল পরিবর্তন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে কেন্দ্র করে বাংলার অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বড়ো ধরনের পরিবর্তনও সাধিত হয়। সমাজে তৈরি হয় নানা শ্রেণি ও উপশ্রেণি। বিশেষ করে ভূমিব্যবস্থা বাংলার সমাজজীবনে নির্ভরশীল এক ‘শৌখিন শ্রেণি’ তৈরি করে, যারা নানাভাবে অর্থ-উপার্জন করে ভূমির ‘হঠাৎ রাজা’ হয়ে যায় এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল হিসেবে অনেক ভূমিমালিক ভূমিহীনও হয়ে পড়ে তখন। সিলেটের ভূমিব্যবস্থা ছিল আবার বাংলার ভূমিব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এখানে ভূমিকেন্দ্রিক অর্থনীতি এবং সমাজব্যবস্থা নানা ‘সমাজশ্রেণি’ তৈরি করে। এই নানা শ্রেণির এক শ্রেণি ছিল উল্লিখিত ‘শৌখিন শ্রেণি’।
এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় যে, চিরস্থায়ী বন্দেবস্তে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল বাংলার মুসলমানরা। ইংরেজদের সহায়তা না-পেয়ে তারা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে এবং হিন্দুসমাজ থেকে উদ্গত নব্য ধনিক শ্রেণি ভূমিমালিক হতে থাকলে মুসলমান ভূম্যাধিকারী মালিকানা হারিয়ে ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। এটা মুসলমান ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের ক্ষেত্রে যেমন রুচিবিকৃতি ঘটায়; যেমনি উঠতি জমিদাররা বিলাস-ব্যসনে অধঃপতিত হয়ে স্থূল ও নিম্নরুচির অধিকারী হয়ে ওঠে। যার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে উদ্ভুত শৌখিন শ্রেণির ঘরে ঘরে ঘাটু রাখার প্রবণতা এবং কার কয়জন ঘাটু আছে তা নিয়ে শানশওকত দেখানো।
আবার অর্থনেতিক পটপরিবর্তন এবং তজ্জন্য নানাবিধ অধঃপতনে সমাজে যে-সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয় তারই পরিপ্রেক্ষিতে ঘাটুনাচ ও ঘাটুগানের মতো লোকসংস্কৃতির উদ্ভব অনিবার্য হয়ে ওঠে। হুমায়ূন আহমেদের ঘেটুপুত্র কমলা (২০১২) চলচ্চিত্রে যে-শৌখিন জমিদারকে আমরা প্রত্যক্ষ করি তিনি তেমনি এক অবক্ষয়ী ও জনবিচ্ছিন্ন সামন্ত বা জমিদার। বাড়ির সবকিছুতে যেমন একটা জীর্ণতার ছোঁয়া আছে, তেমনি তার আচরণ, মর্জি ও মেজাজে একটু রুক্ষ ও ক্ষয়িষ্ণু ভাবও বিদ্যমান। হুমায়ূন আহমেদ জমিদারের রুচিবিকৃতির এক উজ্জ্বল পরাকাষ্ঠা হিসেবে চরিত্রটি নির্মাণ করেছেন, যিনি যথার্থই ঘাটুর সমজদার, রক্ষক ও পোষক।
অন্যদিকে হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজে, বিশেষ করে মুসলমান-সমাজে মানুষের যৌনজীবনে যে-নানারূপ বাধা-নিষেধজনিত অবদমন তারই মূর্ত প্রকাশ ঘাটুসংস্কৃতি। নবীন কিশোরকে ‘কিশোরী-যুবতী’ হিসেবে সজ্জিত করে নৃত্যগীত করা এবং গানের প্রধান বিষয়ও যেখানে প্রেমের নামে নানাবিধ অশ্লীলতার প্রকাশ; এমনকি ঘাটুকে ‘শয্যাসঙ্গী’ হিসেবে ভরণ-পোষণ করা — এটা রুচিবিকৃতিও বটে। ঘেটুপুত্র কমলাতেও আমরা দেখি জমিদারবাড়িতে ঘাটু কীভাবে অন্দরমহলে স্ত্রীর ‘সতীনস্বরূপ’ জমিদারের অঙ্কশায়ী হয়েছে এবং সেটা সকলেই অবগত আছে। অর্থাৎ এ-ধরনের সম্পর্ক স্বীকৃতিও আদায় করে নিয়েছিল তৎকালীন সমাজের। এটা সমাজের ক্ষমতাকাঠামোরও একটা দিক। সেই ক্ষমতা ভূমিনির্ভর বা অর্থভিত্তিক। চলচ্চিত্রে ঘেটুর পিতা বা পরিবার বিষয়টা জানলেও, পাশবিক নির্যাতনের বিষয় অবগত হয়েও ক্ষমতাধরের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করতে পারে না। তবে তা নিন্দনীয় ছিল, হিন্দু কি মুসলিম উচ্চতর সমাজে।
একদিকে সাংস্কৃতিক ক্ষুধা-মিটানো কিংবা সামাজিক নীতিবিরোাধী যৌনাচারবাহী ‘সমজদার’ বা ‘শৌখিন শ্রেণি’, অপরদিকে ‘অর্থনৈতিক নিম্নশ্রেণি’-র ঘাটুবৃত্তি সেকালের মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকেও নির্দেশ করে। আশুতোষ ভট্টাচার্য থেকে মোহাম্মদ আজরফ পর্যন্ত সকলেই বলছেন কিংবা অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য-অনুযায়ী ঘাটুপুত্রদের আগমন ঘটত বিত্তহীন সমাজ থেকে। আশুতোষ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ‘এই সকল সম্প্রদায় অর্থের বিনিময়ে উক্ত নৃত্যগীত-ব্যবসায়ী বালকের অভিভাবকের নিকট হইতে তাহাদিগকে নির্দিষ্টকালের জন্য এই কাজে নিয়োগ করিত।’ মোহাম্মদ আজরফও সমান কথা জানিয়েছেন যে, ‘হিন্দু অথবা মুসলমান পাড়াগাঁয়ের একটা সুশ্রী ছেলেকে তার পিতামাতার নিকট থেকে রীতিমতো দলিল-দস্তাবেজ করে একদল লোক খরিদ করে নিয়ে আসত।’ অর্থাৎ দারিদ্র্যের দায়ে পিতামাতারাই ছেলেকে ঘাটু হিসেবে বছরকয়েকের জন্য বিক্রি করে দিত। দারিদ্র্য মনুষ্যত্বকে এতটাই গ্রাস করত যে, পুত্র পাশবিক লালসার শিকার হচ্ছে জেনেও তা মেনে নিতে হতো পিতামাতাকে। আবার অর্থনৈতিক শ্রেণি সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় শৌখিন সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত সমাজের, কেননা উচ্চশ্রেণিভুক্ত সমাজে তা নিন্দনীয়ই ছিল। ময়মনসিংহ অঞ্চলের সমাজশ্রেণি সম্পর্কে রওশন ইজদানীর মন্তব্য হচ্ছে , ‘গায়ের অশিক্ষিত যুব-সমাজই এর গায়ক ও সমজদার।’ সুনামগঞ্জ অঞ্চলের ঘাটুসৌখিন দল সম্পর্কে আজরফ উল্লেখ করেছেন খানেবাড়ির প্রজাদের কথা। অন্য প্রজাদের তুলনায় এরা অবস্থাপন্ন ছিলেন। পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চল সম্পর্কেও আশুতোষের কথা হচ্ছে এ-অঞ্চলের উচ্চতর সমাজ ঘাটুগান বলতে ‘দুর্নীতিপূর্ণ পল্লিগান’ বলেই মনে করে। তবে জোতদার-জমিদাররা যে পৃষ্ঠপোষকতাও করত তাও জানা যায়।
ঘাটুগানের উদ্ভবের পেছনে ধর্মনৈতিক ও সাহিত্যিক প্রেক্ষাপটও সমান প্রাসঙ্গিক। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে গীতিকবিতার ধারায় বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অন্যসকল সাহিত্যধারা গাথামূলক বা কাহিনিমূলক হলেও বৈষ্ণবকবিতা ছিল গীতিধর্মী। এক্ষেত্রে চৈতন্যদেবের ভূমিকা বিরল; গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মকে তিনি নবরূপে মানুষের কাছে উপস্থাপিত করেছিলেন বলে রাধাকৃষ্ণবিষয়ক বৈষ্ণব পদাবলি সর্বমানবিক হয়ে উঠেছিল। চৈতন্যের পূর্বকালেও পদাবলিসাহিত্য বিদ্যমান ছিল, কিন্তু তা ছিল সাম্প্রদায়িক। চৈতন্যদেবের মানবীয় প্রেমাদর্শ বৈষ্ণব কবিতাকে অসাম্প্রদায়িক করে তোলে। তাই শুধু বিষ্ণু-উপাসক নয়, শৈব এমনকি মুসলমানরা পর্যন্ত বৈষ্ণবগীত রচনা করেছিলেন এবং সকলের জন্য উপাদেয় করে তুলেছিলেন। এই বৈষ্ণবগীতের সর্বাধিক প্রভাব লক্ষ করা যায় বাংলা লোকসংগীতের ক্ষেত্রে, বিশেষত প্রেমগানের ক্ষেত্রে।
কথিত আছে যে, বাংলায় ‘কানু ছাড়া গীত নাই’। এই ‘গীত’ অর্থে প্রেমগীতই বুঝতে হয়। বাংলার লোকসাহিত্যের প্রেমগীত রাধাকৃষ্ণের নামেই উৎসর্গীকৃত। মানব-মানবীর চিরন্তন সম্পর্কই প্রেম, আর বাংলার লোকগীতে প্রেমের ধারা রাধাকৃষ্ণের ভিতর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। আর এটাও সত্য যে, বৈষ্ণবধর্ম ও সাহিত্যকে অবলম্বন করেই রাধাকৃষ্ণের নাম লোকসাহিত্যের সকল স্তরে পৌঁছোয়। চৈতন্য-পূর্ব বৈষ্ণবগীতিতে যেখানে গ্রাম্য স্থূলতা বিরাজমান ছিল, মহাপ্রভুর প্রেমাদর্শে সেখানে আধ্যাত্মিকতার প্রলেপ পড়ে। চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণবগীতিতে তাই রাধাকৃষ্ণের প্রেমগীত মানে ছিল জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্কে সম্পর্কিত এবং আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ। কিন্তু লৌকিক প্রেমগীতে যখন রাধাকৃষ্ণভাবের প্রভাব পড়ে তখন তার প্রভাব দু-রকম হয়। এর একটি হচ্ছে, সেই প্রেমভাবে আধ্যাত্মিক-রস সিঞ্চিত হয় এবং অপরটি হচ্ছে, লোকগানে রাধাকৃষ্ণ সরাসরি অনুপ্রবিষ্ট হয়েও তারা অধ্যাত্মহীন লৌকিক মানব-মানবীতে পরিণত হন। বৈষ্ণব পদাবলির প্রেমের ভাব বাঙালি হৃদয়কে এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল যে, হিন্দুসমাজে বৈষ্ণব না-হয়েও সবাই তা দিয়ে কৃষ্ণসংকীর্তন করত। মুসলমান সমাজও বৈষ্ণব গীতিসুধায় মগ্ন ছিল। আর এসব গীত গাওয়া হতো বলে বিদ্বান-মূর্খ নির্বিশেষে সকলে সমান আস্বাদন করতে পারত। ঘাটুগানের জন্মও হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলির পরম্পরা থেকে। ঘাটুগান উদ্ভবের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় বৈষ্ণবধর্ম এবং বৈষ্ণবসাহিত্যপ্রভাব প্রসঙ্গে ওয়াকিল আহমদ বলেছেন যে,
চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে এদেশে বৈষ্ণবধর্ম জনপ্রিয় ছিল না। চৈতন্যোত্তরকালে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও বৈষ্ণব ধর্মমত শিক্ষিত সমাজের ন্যায় লোকসমাজেও ব্যাপকভাবে প্রচার ও বিস্তার লাভ করেছিল। তখনই রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা বিষয়ে শিক্ষিত কবিরা অসংখ্য পদাবলি এবং পল্লিকবিরা লোকসংগীত রচনা করেছেন। এরূপ সূত্র ধরে […] ঘাটুগানের উদ্ভব হয়েছিল বলে আমরা মনে করি।
আশুতোষ ভট্টাচার্যও কথাটা বলেছেন অন্যভাবে যে, বৈষ্ণব পদাবলির বাইরে রাধাকৃষ্ণের পরিকল্পনায় পল্লিকবি কতকটা স্বাধীনতা গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। যেখানে শাস্ত্রীয় শাসন ছিল না বলেই নিজের স্বাধীন অনুভূতিই রাধাকৃষ্ণের অনুভূতি বলে প্রকাশ করতে পেরেছেন। ঘাটুগানের প্রধান বিষয় কৃষ্ণবিরহ বা রাধাকৃষ্ণের প্রেম, কিন্তু সে-প্রেম বৈষ্ণব পদাবলির প্রেম নয় কিংবা তা অন্য লোকগানের রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক প্রেমগীত নয়; এ-অন্যজাতের গীত। এর কথা, ভাব-ভাষা ও উপস্থাপনা-রীতিও অন্য লোকগানের চেয়ে আলাদা।
৩.
ঘাটুগানের উদ্ভব বিষয়ে নিঃসন্দেহ কোনও মত এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি তার উদ্ভবকাল নিয়েও নয়। তবে ঘাটুগানের বিষয় এবং ভাষারূপ বিবেচনা করে একে মধ্যযুগের অন্তিমপর্বের সৃষ্টি বলে বিবেচনা করা যায়। উদ্ভবের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে যেমন কেউ কেউ ভারতের গুজরাট কিংবা মধ্যপ্রদেশের বৃন্দাবন-মথুরা পর্যন্ত অবতীর্ণ হয়েছেন। কেউ-বা আবার স্থানীয় ধর্ম ও লোকসংস্কৃতির প্রভাবজাত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সময়বিচারে সকলেই ষোড়শশতকের শেষভাগের আগে যেতে চাননি। ঘাটুগান নিয়ে যারা পথিকৃৎ গবেষকের ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী, আশুতোষ ভট্টাচার্য, আশরাফ সিদ্দিকী ও ওয়াকিল আহমদের নাম অগ্রগণ্য। অর্বাচীনকালের গবেষকরা মূলত উল্লিখিত গবেষকদের বক্তব্য ও মতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে নিজের মতামত দিয়ে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন, কিন্তু এ নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি। এমনকি ‘ঘাটু’ শব্দের নানা আঞ্চলিক ব্যবহার থাকার কারণেও এ-বিতর্ক জটিল আকার ধারণ করেছে।
প্রথমদিককার গবেষণায় উদ্ভব প্রসঙ্গে সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী বহুল প্রচলিত ‘ঘাটু’ শব্দটিকে গ্রহণ না-করে ‘গাঁডু’ বলেই মত দিয়েছেন। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাটি সন্ন্যাসীর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন,
গুজরাটের নিম্নশ্রেণির লোকেরা সুন্দর বালকদিগকে নাচ-গান শিখাইয়া মেয়েদের পোশাক ও অলঙ্কার পরাইয়া নৃত্য-গীতের সঙ্গে আমোদ করিয়া থাকে। এই ছেলেদিগকে ‘গান্টু’ বলা হয়। […] বৃন্দাবন হইতে গঙ্গার তীর ধরিয়া রাজমহল পর্যন্ত নিম্নশ্রেণির চাষা ও কুলিমজুরদের মধ্যেই গান্টুগানের প্রচলন দেখা যায়।
এছাড়া ঘাটুগানের এমন কিছু রূপমূল বা শব্দ তিনি সংগ্রহ ও উদ্ধৃত করেছেন যাতে হিন্দি এবং ব্রজবুলি ভাষার মিশ্রণ রয়েছে। তাই রূপমূলতাত্তি¡ক (morphological) সাদৃশ্য ও সম্পর্কের কারণে তিনি গুজরাট কিংবা উল্লিখিত অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে ঘাটুগানের উদ্ভবের ইতিহাস সন্ধান করেছেন। কাসিমপুরীর অনুসন্ধানে ‘গাডু’ শব্দটির বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ হচ্ছে গাঁডু, গাডু, গাটু, ঘাটু, ঘাঁঢু প্রভৃতি। তাঁর মতে, “পশ্চিমা কুলীদের মধ্যে উচ্চারিত হয় ‘গান্টু’। ইহা একটি আঞ্চলিক শব্দ। এই শব্দের মূল অনুসন্ধান করিলে আমরা দুইটি শব্দ পাই ‘গান’ আর ‘ঘাট’। গান+টু—গান্টু>গাঁটু; আর ঘাট+উ—ঘাটু।” এ-দুটি শব্দের মধ্যে তিনি ‘ঘাটু’-র পরিবর্তে ‘গাঁটু’ হওয়াই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেছেন। প্রসঙ্গত পূর্ববঙ্গে ঘাটুগানের উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তার বিষয়েও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরীর মতে, বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের আজমিরিগঞ্জই ঘাটুগান উদ্ভবের কেন্দ্রীয় স্থল। তিনি উদ্ভবের সময় নির্ধারণ করেছেন ষোড়শশতকের প্রথমার্ধ। এ-সময়ে আজমিরিগঞ্জের জনৈক আচার্য কৃষ্ণভাবে ‘পাগল’ হয়ে রাধিকারূপ ধারণ করে কৃষ্ণগীতের সঙ্গে বিশেষ ধরনের নাচের উদ্ভব ঘটান, যা বিকশিত হয়ে ‘ঘাটুগান’ বলে পরিচিতি পায়। কাসিমপুরীর ভাষায়,
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে শ্রীহট্টের আজমিরিগঞ্জ-নিবাসী জনৈক আচার্য রাধিকার বিরহভাবে আকুল হইয়া সংসারের মায়া কাটাইয়া কোথাও উধাও হইয়া গেলেন। বেশ কয়েক বৎসর পর তিনি স্বীয় গৃহে ফিরিয়া আসিয়া আপন আবাস বাটীর সম্মুখস্থ পুকুরের ধারে কুঞ্জ নির্মাণ করলেন এবং বিরহিনী রাধিকার বেশে মথুরাবাসী কৃষ্ণের আপেক্ষায় কালযাপন করিতে লাগিলেন। ভাবাবেগে অধীর হইয়া কখন তিনি ফুল তুলিতেন, কখন অপরূপ কুঞ্জ সাজাইতেন, কখন ‘কলসি কাখে জল ভরিতে’ যাইতেন, কখন-বা প্রাণ-বেণুর রব শুনিয়া প্রিয় শিষ্য উদয় আচার্যের গলা জড়াইয়া কাঁদিতেন, কখন-বা ‘কোয়িলার কুহু তানে’ আপনাকে হারাইয়া ফেলিতেন-তন্ময় হইয়া পড়িতেন।
ধীরে ধীরে তাহার শিষ্যের সংখ্যা বাড়িতে লাগিল; নিম্নশ্রেণির অনেক ছেলেও শিষ্যত্ব গ্রহণ করিল বা শিষ্য করিয়া লওয়া হইল। এইসব ছেলেকে রাধিকার সখী সাজান হইত। ছেলেরা নীরবে নাচিয়া ভাব প্রকাশ করিত; বিরহসংগীতে সকলকে মুগ্ধ ও ভাবাতুর করিত। ক্রমে এই ছেলে-শিষ্যদের যোগে গড়িয়া উঠিল ‘গাডু’ গান।
শুধু হিন্দুসমাজে নয়, পরবর্তীকালে মুসলমান সমাজেও এই গানের প্রচার-প্রসার লাভ করে বলে কাসিমপুরী জানান। তবে এরূপ প্রচার-প্রসারের সঙ্গে ‘সাধনপদ্ধতি’-র বিকৃতিকে তিনি দায়ী করেছেন। অর্থাৎ প্রথম দিকে সাধকদের বিশেষ আচারসংগীত হলেও পরে তা ‘অ-সাম্প্রদায়িক’ সংগীত হিসেবে লোকসংগীতের অঙ্গীভূত হয়। কাসিমপুরীর পর্যবেক্ষণে,
অতঃপর নিম্নশ্রেণির হিন্দু-মুসলমানের সুন্দর সুকণ্ঠ ছেলেদিগকে ‘গাডুগিরি’-তে দিয়া গাডুগানকে পয়সা উপার্জনের অর্থাৎ অর্থাগমের ব্যবসায়ে পরিণত করা হইল। গাডুর সৌখিনেরা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের গরিব লোকদিগকে মাসিক একটা টাকা বরাদ্দ করিয়া তাহাদের নধরকান্তি বালকদিগকে নাচ-গান ও ভাবের অভিব্যক্তিমূলক অঙ্গভঙ্গি শিখাইয়া ও চুল লম্বা রাখাইয়া ‘গাডু’ বানাইয়া বেশ ব্যবসা চালাইতে লাগিল।
অর্থাৎ তাঁর দৃষ্টিতে ঘাটুনাচ ও ঘাটুগান ধর্মীয় ভাব ও সাধনা থেকে উদ্ভুত হলেও পরে তা লোকরুচির আওতায় লোকসংস্কৃতির ব্রাত্যস্তরে স্থানলাভ করে জনমনের সাংস্কৃতিক ক্ষুধা মেটায় এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় অর্থনীতি ও বাজারসংস্কৃতি। কাসিমপুরীর অনুসন্ধানে ‘গাডুদের মধ্যে যে-উত্তম বলিয়া প্রমাণিত হইত তাহার মাসিক বেতন সর্বাপেক্ষা বেশি হইত। আমি নিশ্চিতরূপেই জানি, উমর আলী আর সুরেন্দ্র নমদাস নামক দুইটি গাঁটুর মানিক আয় ছিল তিনশত টাকার ওপর। তাহারা উভয়েই পল্লির বিশিষ্ট লোকদের বাড়িতে আসর দিয়া গান গাহিত। বিশিষ্ট লোকদের মধ্য হইতে অনেক শৌখিনকেই এই দুই গাঁটুর মোহে পড়িয়া সর্বস্বান্ত হইতেও দেখিয়াছি।’
ঘাটুগানে প্রাচীন পাঠ থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, প্রথম দিককার গানজুড়ে আধ্যাত্মিক রসই প্রধান ছিল এবং সেটা অবশ্যই ধর্মীয় আবহে ও সাধনার সঙ্গে জড়িত ছিল। বৃহত্তর জনরুচির সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়ার কালে কিংবা অঙ্গীভূত হওয়ার ফলে তা স্থূলরুচির সঙ্গেই জড়িত হয়। উদ্ভবের পর দ্রুত এর রূপান্তরে একটি সমাজ-মনস্তাত্তি¡ক দিকও যে জড়িত ছিল গবেষকের বক্তব্য থেকে তারও প্রমাণ মেলে,
বৈষ্ণববাদের যে-আধ্যাত্মিক মূল্য ছিল, প্রাথমিক যুগে গাঁটুগানের সেই মূল্য ছিল বলিয়া অনেকের ধারণা; কিন্তু আমি যতদূর অবগত আছি, মনে হয়, ইহার আধ্যাত্মিক মূল্যের চেয়ে গাঁটুর রূপ, সৌন্দর্য, গান আর অঙ্গভঙ্গী সহকারে নৃত্য, নারীসুলভ বেশ-ভূষা আর কমনীয় মোহই ছিল প্রবলতর। এইদিক দিয়া চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি গাঁটুগান নরনারীর প্রেমসংগীত নহে-ইহা আদিম সমাজের কামসংগীতেরই রূপান্তর। আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে বা রূপক যদি অধ্যাত্মভাবের উদ্দীপক না-হইয়া রিরংসার উত্তেজক হইয়া থাকে, তবে এই আধ্যাত্মিকতা শয়তানির ছদ্মবেশ ব্যতীত আর কিছু নয়।
লোককবি মনসুর বয়াতীর মতে, ঘাটুগানের উদ্ভব ভাওয়ালে। তিনি নিজেও ঘাটুগানের রচয়িতা ও শিল্পী ছিলেন। তাঁর মতে, ‘ভাওয়াল রাজার দরবারে একসময় বাৎসরিক একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সে-অনুষ্ঠানে এলাকার সকল গায়কের দাওয়াত পড়ত। সে-গানের বিষয়বস্তু ছিল মূলত রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে। এ-ধারার গানের নাম ছিল ঘাটুগান।’ মামুন তরফদার-সংগৃহীত একাধিক প্রশ্নোত্তরমূলক ঘাটুগানে ঘাটুর জন্ম ভাওয়ালে বলে উল্লেখ পাই : ‘রাই বুঝাই তোরে ঘাটুর জন্ম ভাওয়ালের দ্যাশে / যখন ঘাটু দ্যাশে আইল, ছোটো ভাই মোর পাগল হইল / হালের বলদ গোহালে রইল। […]’ তবে এ-মতের পক্ষে শক্ত কোনও যুক্তি মেলে না।
আশুতোষ ভট্টাচার্যের আলোচনায় ঘাটুগানের জন্মস্থান পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ বলেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি তাঁর গবেষণায় ত্রিপুরার উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেটের পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ হবিগঞ্জ-সুনামগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে ঘাটুগানের প্রচলন আছে বলে উল্লেখ করলেও ঠিক কোন অঞ্চলে এর উদ্ভব ঘটেছিল তাতে নিঃসন্দেহ হননি। তিনি জানিয়েছেন,
পূর্ব মৈমনসিংহ অর্থাৎ মৈমনসিংহ জেলার নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও সদর মহকুমায় এক শ্রেণির লোকসংগীত প্রচলিত আছে, পূর্ব মৈমনসিংহের একান্ত সংলগ্ন অঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিম শ্রীহট্ট ও উত্তর ত্রিপুরা ব্যতীত ইহা বাংলাদেশের আর কোথাও প্রচলিত নাই। ইহা কেবলমাত্র উপরোক্ত অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ তাহা নহে, এই অঞ্চলের মধ্যেও ইহা বৎসরের নির্দিষ্ট সময়েই গীত হয়-এই নির্দিষ্ট কাল অতিক্রান্ত হইয়া গেলে, বৎসরের মধ্যে ইহা আর শুনিতে পাওয়া যায় না। […] গ্রামের ঘাটে ঘাটে ঘুরিয়া গান গাওয়া হইতেই বালকের নাম ‘ঘাটু’ হইয়াছে।
আশরাফ সিদ্দিকী আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতোই সমান মত প্রকাশ করে লিখেছেন যে,
পূর্ব মৈমনসিংহ, ত্রিপুরার কিয়দংশ এবং সিলেট অঞ্চলে একপ্রকার আঞ্চলিক গীত প্রচলিত আছে এগুলো স্থানভেদে ঘাটু, গাঁডু, গাডু, গাটু, ঘাঁটু ইত্যাদি নানভাবে উচ্চারিত হয়। পশ্চিমা কুলিরা আবার উচ্চারণ করে ‘গানটু’। শব্দমূল বিচারে ‘ঘাট’ আর ‘গান’ এই দুই শব্দই প্রধান মনে হয়। দিগন্তব্যাপী বর্ষার হাওরের কূলে নৌকায় করে ঘাটে ঘাটে গান গাওয়া হতো বলে গানের বালক ও গানগুলোকে ‘ঘাটু’ বলা হতো […]।
উদ্ভব-প্রসঙ্গ ছাড়াও তাঁদের উদ্ধৃতি-দুটিতে ঘাটুগানের নামকরণপ্রসঙ্গও উল্লিখিত হয়েছে; যা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মামুন তরফদার দীর্ঘদিন ধরে ঘাটুগান সংগ্রহ ও গবেষণা করে আসছেন। তাঁর মতে, ঘাটুগান মূলত পাহাড়ি গান। আর টাঙ্গাইলে প্রাচীনকাল থেকেই ঘাটুগানের প্রচলন ছিল। আবদুল করিম মিঞার বক্তব্য এ-প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যে,
ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষ্যে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাথে আসামের ঘনিষ্ট যোগাযোগ স্থাপিত হয়। দেশবিভাগের পূর্বে ম্যালেরিয়া আর কালাজ্বর এবং সাপের ভয় উপেক্ষা করে ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকজন আসামে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে থাকে। তারা বনজঙ্গল কেটে আবাদযোগ্য জমি তৈরি করে। ফলে আসামের সাথে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বিনিময় হয়। আবার দেশভাগের পর বিপুলসংখ্যক লোক বাস্তুভিটা ত্যাগ করে আবার তাদের নিজস্ব এলাকা ময়মনসিংহে ফিরে আসে। ঘাটুগান সম্ভবত আসাম অঞ্চল থেকে টাঙ্গাইল এলাকায় বিস্তার লাভ করে।
এ-রকম তথ্যের কথা জানা যায় সাইমন জাকারিয়ার একটি অনুসন্ধান থেকেও। তাঁর পর্যবেক্ষণে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে একসময় নদীপথে নৌকা করে জীবিকার তাগিদে অনেকে আসামে যেত এবং যাওয়া-আসার পথে বিভিন্ন ঘাটে নৌকা বেঁধে যে-নাচগান করত তা-ই ঘাটুগান নামে প্রসিদ্ধি পায়। এই তথ্যের সঙ্গে আবদুল করিম মিঞার মতের মিলও পাওয়া যায়। তবে সাইমন জাকারিয়া একই রচনায় আরেকটা সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। ময়মনসিংহ শহরের বিত্তশালী ও রাজপরিবারের লোকজন বাড়িতে ‘নারী-রক্ষিতা’ রেখে আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু গ্রামীণ জীবনে বিত্তশালী ও ভূস্বামীদের পক্ষে আর্থসামাজিক কারণে সেটা সম্ভব হয়ে উঠত না। এমতাবস্থায় ‘রক্ষিতার বিকল্প’ হিসেবে কমবয়েসি ছেলেদের নারীর বেশে সাজিয়ে নাচ-গান করাতেন এবং এঁরাই ঘাটুতে রূপান্তরিত হন।
কিন্তু এসব বক্তব্যে ঘাটুর নামকরণ ও এতদ্সংক্রান্ত যুক্তি যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয় না।
এছাড়া ঘাটুগানের নামকরণ এবং এর উদ্ভব প্রসঙ্গে মুখে মুখে প্রচলিত তিনটি মত তুলে ধরে ওয়াকিল আহমদ বিভিন্ন লোকসাহিত্যবিদের মতামতের নিক্তিতে নিজেরও অভিমত ব্যক্ত করেছেন তাঁর একাধিক গবেষণায়। তাঁর উদ্ধৃত মতগুলো হচ্ছে,
[১] পূর্বকালের ময়মনসিংহের সাধারণ কৃষকেরা প্রতিবছর নৌকাযোগে আসামে ছন কাটতে যেত। কার্তিক, অগ্রাহায়ণ, পৌষ-এই তিনমাস তারা সেখানে অবস্থান করত। জীবজন্তুর ভয় থাকায় পাহাড়ের পাদদেশে জলা-জঙ্গলার অবস্থান নিরাপদ ছিল না বলে তারা দিনের শেষে নৌকায় ফিরে আসত। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত এসব মানুষ অবসর যাপনকালে নিজ নিজ নৌকায় বসে গান করত। নদীর ঘাটে বসে গান করা হতো বলে এর নাম হয়েছে ঘাটুগান।
[২] ভারতের গুজরাটে কিশোর বয়সের সুদর্শন বালককে দিয়ে অনুরূপ নাচ-গান পরিবেশনের রীতি ছিল। গুজরাটি ভাষায় এরূপ বালককে ‘গান্টু’ বলা হয়। উত্তর ভারতের বৃন্দাবন-মথুরা থেকে গঙ্গার তীর ধরে বিহারের রাজমহল পর্যন্ত নিম্নশ্রেণির কুলি-মজুর ও চাষিদের মধ্যেও গান্টুগানের প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে মধ্যযুগ থেকেই গুজরাটের শেঠরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছে। বালকবেশী কিশোরীর ঘাগরা-পরার রীতি আছে। এটি রাজস্থানী-গুজরাটি রমণীদের জনপ্রিয় পোশাক। গুজরাটের শেঠদের এবং পশ্চিমা কুলি-মজুরদের মাধ্যমে বাংলাদেশে গান্টু গান-নাচের প্রচলন হতে পারে। ময়মনসিংহের আঞ্চলিক উচ্চারণে ‘গান্টু’ থেকে গাঁডু, পরে ঘাঁটু/ঘাটু শব্দের প্রচলন হতে পারে।
[৩] কৃষ্ণের বাঁশির ‘ঘাট’ থেকে ‘ঘাটু’ নামকরণ হয়। বাঁশির ছিদ্রকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘ঘাট’ বলে। বংশীবাদক ঘাটগুলিতে আঙুল সঞ্চালন করে বাঁশির সুর নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এই বংশীধ্বনি ঘাটু নামের ছেলেটিকে নাচে গানে নিয়ন্ত্রণ করে।
উপর্যুক্ত প্রথম মতের আরেকটি ভাষ্য ওয়াকিল আহমদ উল্লেখ করেছেন যে, ময়মনসিংহের হাওর অঞ্চলে একসময় বড়ো বড়ো নৌকা করে ঘাটুর দল দর্শক-শ্রোতা নিয়ে হাওরে মিলিত হয়ে নাচগানের আয়োজন করত। পরে জেলার অন্যত্রও এরূপ পরিবেশনা বিস্তৃত হয় প্রশস্ত নদী ও বিল-বাঁওরে। টাঙ্গাইল অঞ্চলে ঘাটুগানের প্রচলন ছিল। দর্শক-শ্রোতা বেশি হলে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে ডাঙায় গানের আসর বসত। সে-গান রাতভর চলত। নদীর ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এরূপ গান পরিবেশন হতে বলে এর নাম হয় ‘ঘাটু’ গান। পরে ঘাট ছেড়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে এর বিস্তৃতি ঘটে। ওয়াকিল আহমদ এই মতের সঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্যের সমর্থন পেয়েছেন এবং দ্বিতীয় মতের সঙ্গে সিরাজুদ্দীন কসিমপুরীর মত। দ্বিতীয় মতের পক্ষে ওয়াকিল আহমদের কথা হচ্ছে, গঙ্গার তীর বেয়ে গান্টু গান প্রথমে মুর্শিদাবাদ ও মালদহে বিস্তারই সম্ভব, যেহেতু রাজমহল থেকে গঙ্গা ওদিকে ঢুকেছে। বালকদের বালিকা সাজিয়ে নাচগান করার রীতি সেসব অঞ্চলে প্রচলিত ‘আলকাপ’ গানে যেমন আছে; তেমনি বর্ধমানে প্রচলিত ‘লেটো’ গানেও তা পাওয়া যায়। এছাড়া ছদ্মবেশী বালকদের ওইসব অঞ্চলে যথাক্রমে ‘ছোকরা’ ও ‘লেটো’ বলা হয়। শ্রীহট্ট অঞ্চলেও ঘাটুর বিকল্প শব্দ ‘ছোকরা’। শেষমেষ ওয়াকিল আহমদের মত হচ্ছে, “এক্ষেত্রে ‘ঘাট’ থেকে ঘাটুর নামকরণের যৌক্তিকতা বেড়ে যায়।” অন্যত্র তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল এরূপ :
‘ঘাট’ থেকে ‘ঘাটু’ শব্দের উৎপত্তি হতে পারে। ঘাট+উ = ঘাটু। ঘাটুগান আর নাচের আসর নৌকার পাটাতনে বসে। ঘাটুর দল ঘাটে ঘাটে গান করে ও নাচ দেখিয়ে জীবিকা অর্জন করে। উপরন্তু রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার মধ্যে যমুনার ঘাটের লীলা উল্লেখযোগ্য অংশ। ঘাটুগানের বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণের প্রেম। উভয় দিক থেকে ‘ঘাটু’ শব্দের চালু হতে পারে। তবে ঘাট ছাড়াও লোকালয়ে ঘাটুগানের আসর বসে। গুজরাটে একই শেণির নাচগানের ‘চল’ আছে, এখানে বালিকাবেশী ছেলেদের ‘গানটু’ বলে। গানটু>গাঁটু>ঘাঁটু>ঘাটু এরূপ হওয়া স্বাভাবিক।
এ-ব্যাপারে আমাদের মত যথাস্থানে প্রকাশ করব। ঘাটুগানের উদ্ভব ও নামকরণের পক্ষে উদ্ধৃত তৃতীয় মতের পক্ষে কিছু তাত্তি¡ক ব্যাখ্যাও চোখে পড়ে। এমন একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন সঞ্জয় সরকার। তাঁর মতে,
বাঁশির ছয়টি ঘাট হলো ষড়রিপু। ষড়রিপুকে সাধনার বলে জয় করে অর্জন করতে হয় মনুষ্যত্ব। আর বাঁশির ছয়টি ঘাটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বাঁশিতে বেজে ওঠে সুমধুর সুর। এই ছয়টি ঘাট সমষ্টি হলো রাধার অষ্ট সখি। ফুঁকদানের ছিদ্রটি স্বয়ং রাধা। কৃষ্ণের ফুঁক রাধাকে করেছে মধুর ও জগতের প্রিয়। তাই রাধাকৃষ্ণভিত্তিক বাঁশির সুরে নিয়ন্ত্রিত গানকে ঘাটুগান নামকরণের ইতিবৃত্ত অযৌক্তিক নয়।
ওয়াকিল আহমদ এধরনের মতকে ‘উর্বর মস্তিষ্ক-প্রসূত’ বলে মন্তব্য করেছেন। আমরাও একে ‘বাড়াবাড়ি’ ধরনের তত্ত্ব বলে ধারণা পোষণ করি।
আবার ঘাটুসংস্কৃতির উদ্ভব কাল-স্থান-পাত্র প্রসঙ্গে ওয়াকিল আহমদ সিরাজউদ্দীন কাসিমপুরীর মতকেই প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, সিলেটের আজমিরিগঞ্জ নামক ভাটি-অঞ্চলেই ষোলো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অথবা সতেরো শতকের প্রথমার্ধে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে কেন্দ্র করেই ঘাটুগানের উদ্ভব হয়। উদ্ভবের পেছনে বৈষ্ণবধর্ম এবং জনৈক আচার্য ব্রাহ্মণ ও তাঁর শিষ্য উদয় আচার্য জড়িত ছিলেন। তাঁর সিদ্ধান্ত হচ্ছে,
এভাবে হবিগঞ্জের ঘাটুগান নেত্রকোনায় প্রচার ও প্রসার লাভ করে; পরে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ সদর, টাঙ্গাইল এবং ঢাকার নানা অঞ্চলে এ গান বিস্তার লাভ করে। অপরদিকে হবিগঞ্জ থেকে বৃহত্তর সিলেট, কুমিল্লা ও ত্রিপুরা পর্যন্ত তা প্রসারিত হয়।
ওয়াকিল আহমদের মতে, উনিশশতক ও বিশশতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ঘাটু নাচগানের প্রচলন অব্যাহত ছিল।
অবশ্য তিতাশ চৌধুরী বলছেন ভিন্নকথা। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘাটুগানের উৎপত্তি ও প্রচলনস্থান হিসেবে চিহ্নিত করে এর সঙ্গে ওড়িশ্যার তেলেনাগানের সগোত্র হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে,
কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তর্গত ‘গুনিয়াউক’ গ্রামই এই ঘাটুগানের প্রধান ও আদি উৎস। ব্যারিস্টার আবদুর রসুলের পিতা গোলাম রসুলই ছিলেন এ-গানের প্রবর্তক। তাঁর উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ঘাটুগান কুমিল্লার জেলার সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। এ-গানগুলো উর্দু-বাংলা পার্সি ও হিন্দির সংমিশ্রণে বিরচিত।
তিতাশ চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে তিনটি ঘাটুগান উদ্ধৃতও করেন। সেসব গানে বাংলার সঙ্গে উর্দু-হিন্দি ও ফারসির মিশ্রণ অতিমাত্রায় লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
এদিকে ওয়াকিল আহমদ তিতাশ চৌধুরীর এ-বক্তব্যকে ‘অভিনব ও কৌতুহলোদ্দীপক’ বলে মন্তব্যও করেছেন। গোলাম রসুল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গুনিয়াউকের জমিদার ছিলেন, ছিলেন সজ্ঞীতজ্ঞও। কুমিল্লার আঞ্চলিক ইতিহাসগ্রন্থ থেকে তাঁর সম্পর্কে যে-তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা গেছে তিনি সংগীত রচয়িতা ও তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গোলাম রসুল ঘাটুনাচের ভক্ত ছিলেন, নিজেও ঘাটুগান রচনা করেছেন। দলগঠন করে সেসব অঞ্চলে ঘাটুনাচ ও গানের প্রচলনে ভূমিকাও রেখেছিলেন। তাই বলে তিনি ঘাটুগানের প্রবক্তা এ-সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। ভাটি অঞ্চলের অনেক জমিদারই ঘাটুগানের সমজদার ছিলেন, তাদের ঘাটুর দলও ছিল; নিজ নিজ বাড়িতে ঘাটু রাখতেনও। হয়তো কেউ কেউ দু-একটি গানও রচনা করতেন তাই বলে তাঁদের একটা বিশেষ সংস্কৃতির প্রবক্তা বলা সমীচীন হয় না। তবে এটাও সত্য যে, বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে ঘাটুগানের প্রচলনে গোলাম রসুলের ভূমিকা অনেক।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সিলেট, ত্রিপুরা, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, ঢাকা, টাঙ্গাইল প্রভৃতি অঞ্চলে ঘাটুগানের প্রচলন ছিল। কিন্তু উদ্ভবস্থলের দিক থেকে প্রায় আশুতোষ ভট্টাচার্য ছাড়া সকলেই বর্তমান হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ বা বৃহত্তর সিলেটের কথা বলছেন। কিন্তু আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর দাবির পক্ষে কোনও যুক্তি বা তথ্যপ্রদর্শন করেননি। সুতরাং অপরাপর মতামতের সঙ্গে বর্তমান গবেষণা ও ক্ষেত্রসমীক্ষার পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, বাংলাসাহিত্যের প্রথম ইতিহাসগ্রন্থপ্রণেতা দীনেশচন্দ্র সেন বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (১৮৯৬) গ্রন্থে শ্রীহট্টের ব্রজবুলির নিদর্শন হিসেবে একটি ঘাটুসংগীত উদ্ধৃত করেছেন। গানটির রচয়িতা কবি সত্যরাম। গানটি এই,
কাঁহে কো শোচ কর মন পামর। রাম ভজ, তুহুঁ রহনা দিনা।
ইষ্টকুটুম্ব ছোড়দে আশ, এ সংসার অসার, এক উইনাম বিনা।।
যো কীটপতঙ্গক আহার যোগাওত, পালক হ্যায় উহি এক জনা।
কবি সত্য কহে, মন থির রহো, যিনি দিহা দন্ত, সো দেগা চিনা।।
রাধাকৃষ্ণের লীলাপ্রসঙ্গ এখানে অনুপস্থিত হলেও সত্যরামের গানটিকে দীনেশচন্দ্র সেন ‘ঘাটুসংগীত’ হিসেবে উদ্ধৃত করে ঘাটুসংগীতের আঁতুড়ঘর হিসেবে সিলেটকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সত্যরাম অনেক ঘাটুসংগীতের রচয়িতা ছিলেন। সিলেটের পঞ্চখণ্ড অর্থাৎ বিয়ানিবাজারের কবি ছিলেন। পেশায় ছিলেন কাছাড়ের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান। গবেষক আশরাফ হোসেন শিলহটের ইতিহাস গ্রন্থে পঞ্চখণ্ডের সত্যরামের সঙ্গে তরফের মুনসি ভবানপ্রসাদ কর, উচাইলের হরগোবিন্দ দাস প্রমুখ ঘাটুগানের কবিদের নাম উল্লেখ করেছেন। এভাবে ঘাটুগানের আদিকবি হিসেবে সিলেটের অনেক লোককবি খ্যাতিলাভ করেছিলেন। ঘাটুগানের স্থান প্রসঙ্গে আশরাফ হোসেন লিখেছেন,
ছোটো ছোটো বালকদের নাচগান শিক্ষা দিয়া বাজনা সংযোগে একপ্রকার চুটকী (ছোটো) গান করা হয়। উহার নাম ঘাটুগান। [সিলেট] জেলার ভাটি অর্থাৎ নিম্নাঞ্চলেই ওই শ্রেণির গানের প্রচলন অধিক।
আর বৈষ্ণবসাহিত্যের সূত্র ধরে ঘাটুগানের জন্ম ধরলে দেখা যায় বৈষ্ণবসাহিত্যে সিলেটের ঐতিহ্য প্রবাদপ্রতিম। শুধু চৈতন্যদেবের পিতৃভূমির কারণেই নয়; অদ্বৈতাচার্য, মুরারিগুপ্ত প্রমুখ বৈষ্ণবতাত্ত্বিকের জন্ম সিলেটেই। নবদ্বীপে তত্ত¡ ও জ্ঞানে সিলেটিদের প্রভাবও ছিল চোখেপড়ার মতো। সুতরাং সিলেট চৈতন্যসাহিত্যের একটা কেন্দ্র হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করে মধ্যযুগে। ফলে বৈষ্ণবতত্ত¡ ও প্রেমধর্মের প্রভাব সিলেটের আপামর জনমানসের প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। সিলেটের লোকসংগীতের ভাবেও এর প্রমাণ মেলে। আসামের গবেষক সুধীর সেন বৈষ্ণবসংগীতচর্চা প্রসঙ্গে লিখেছেন,
শ্রীহট্টে প্রচলিত গোবিন্দভোগের গান, ঘাটুগান ও ঠাট কীর্তন এই জেলারই বিশিষ্ট পরিচায়ক। এগুলির ভাব ও ভাষার সম্পদ অন্যান্য সঙ্গীতের তুলনায় নিকৃষ্ট নয়। […] গোবিন্দভোগের ন্যায় ঘাটুসঙ্গীত মান মাথুরাদি পালাক্রমে বিভক্ত কৃষ্ণলীলা গীতি।
গবেষক সুধীর সেন ঘাটুসংগীতকে সিলেটের নিজস্ব সম্পদ হিসেবেই বিবেচনা করেছেন এবং বৈষ্ণবপ্রেমতত্ত্ব ও কৃষ্ণলীলার সঙ্গে এর সংযোগ দেখিয়েছেন নিঃসন্দেহ চিত্তে। তিনিও তাঁর গ্রন্থে ঘাটুগানের কবি হিসেবে কবি সত্যরামের নাম উল্লেখ করেছেন। তবে দীনেশচন্দ্র কিংবা সুধীর সেন কেউই সত্যরামের জীবনকাল উল্লেখ করেননি। তা করলে, অনেক প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যেত। মুহম্মদ আসাদ্দর আলীও বৈষ্ণবসাহিত্য ও সিলেটের ঘাটুগান প্রসঙ্গে যে-অভিমত দিয়েছেন তাতে সিলেটে যে একসময় ঘাটুসংস্কৃতির ‘প্রাদুর্ভাব’ দেখা দিয়েছিল তাও প্রমাণিত হয়।
বৈষ্ণবসাহিত্যে সিলেটের বিরাট অবদানের কথা সর্বজন স্বীকৃত। বৈষ্ণবসাহিত্যেরই অন্তর্ভুক্ত হলো ঘাটুগান। সেজন্য প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে সিলেটের বুকে বিপুলসংখ্যক গান রচিত হয়েছে। একদা ঘাটুগান ও ঘাটুনাচ এক দুষ্ট আখড়ায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল সিলেট। ঘাটুর ইলিম-তালিমের অন্যতম বিশেষ কেন্দ্র ছিল ছাতক থানা [সুনামগঞ্জ]।
একই প্রসঙ্গে অন্য একটি গবেষণায় ওয়াকিল আহমদ যে-মত প্রকাশ করেন তাতেও বৈষ্ণবসাধনার সঙ্গে ঘাটুসংস্কৃতি ও সিলেট কীভাবে পরস্পরসংশ্লিষ্ট তাও নির্ধারিত হয়ে যায়, যা অন্য কোনও অঞ্চলের সঙ্গে তুলনীয় হওয়ার দরকারও পড়ে না।
[…] এ-সকলই যে বৈষ্ণবধর্ম ও সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রভাবের ফল তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বৈষ্ণবদের এরূপ ভাবধারা লোকজীবনেও অবাধ প্রভাব বিস্তার করেছে। ভাউল, মুর্শিদি, সারি, ভাটিয়ালি, ঘাটু, ঝুমুর, ধামালি ইত্যাদি লোকসংগীতে রাধাকৃষ্ণের প্রেম ও গানের ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়। লৌকিক ধারায় এরূপ প্রভাব আজও অব্যাহত আছে। সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব কত ব্যাপক ও গভীর হয়েছিল, এসব দৃষ্টান্ত থেকে তা অনুভব করা যায়। শ্রীচৈতন্য পিতৃভূমি সিলেট ত্যাগ করলেও সিলেটবাসী শ্রীচৈতন্যকে ত্যাগ করেনি।
এছাড়াও সিলেটের একজন শক্তিশালী কবি ছিলেন দীন ভবানন্দ। তাঁর বিখ্যাত কাব্যের নাম হরিবংশ। হরিবংশের অনেক গান আবার ঘাটুগান হিসেবে গাওয়া হতো বলে জানা যায়। ঘাটুসংস্কৃতির জনপ্রিয়তা এর এমন কারণ হতে পারে।
ঐতিহাসিক ও ভাষাবৈজ্ঞানিক দিক বিবেচনা করলেও সিলেটের সঙ্গে ‘ঘাটু’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত সম্পর্ক তৈরি করা যায়। সিলেটের স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে গুজরাটি সংস্কৃতির মিল রয়েছে। বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে। সিলেটের কৃষিজমি পরিমাপের এবং শস্যের পরিমাণ নির্ধারণে যেসব একক প্রচলিত রয়েছে সে-পদ্ধতি গুজরাটি। উদাহরণ হিসেবে ভূমিপরিমাপে সিলেটে ‘হাল’/‘আল’ এবং শস্যপরিমাপে ‘পালি’/‘পাইল’ [>‘ফালি’/‘ফাইল’] ব্যবহার করা হয়। উনিশশতকে প্রাপ্ত সিলেটের ভাটেরা তাম্রশাসনে রাজা গোবিন্দকেশব দেবের ভূমিদানে ‘ভূহল’, ‘হাল’, ‘ভূকেদার’ শব্দগুলোকে ভূমি পরিমাপের একক হিসেবে দেখা গেছে। এর সঙ্গে তুলনীয় গুজরাটের বর্ণদেবের চালকা শিলালিপিতে ভূমি পরিমাটের একক ‘হল’ এবং শস্যপরিমাপের একক ‘পাইলি’ শব্দদুটি। এর সঙ্গে ঐতিহাসিকসূত্রতা হচ্ছে যে, সপ্তম শতকের ভাস্করবর্মার তাম্রশাসনে সিলেটে যেসব ব্রাহ্মণদের উপনিবেশিত করা হয় তাদের বেশিরভাগই গুজরাট থেকে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সুতরাং সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরীর মতানুযায়ী গুজরাটাগত ‘গান্টু’ শব্দটিও যদি ‘ঘাটু’ শব্দের ব্যুৎপত্তির মূলে থাকে তাহলেও সিলেটের সঙ্গে ঘাটুগানের উদ্ভবের সম্পৃক্ততা যুক্তিগ্রাহ্য।
সুতরাং উপর্যুক্ত উৎস থেকে তথ্য-প্রমাণে সিলেট যে ঘাটুগানের উদ্ভবস্থল তাতে যৌক্তিকতা বেড়ে যায়।
প্রাসঙ্গিকভাবে তথ্য-প্রমাণে আরও দুটি মত এখানে যুক্ত করা যেতে পারে। এর একটি প্রখ্যাত গবেষক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে নিঃসংশয়চিত্তে লিখেছেন, ‘[…] এ গান (ঘাটু) বা প্রথার উৎপত্তি ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলার সঙ্গমস্থল জলসুখায়।’ উল্লেখযোগ্য যে, হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ উপজেলার জলসুখা ভাটি জনপদের বর্ধিষ্ণু গ্রাম ও প্রসিদ্ধ ইউনিয়ন। হুমায়ূন আহমেদও ঘাটুগানের উদ্ভবস্থল হিসেবে এই জলসুখাকেই চিহ্নিত করেছিলেন যে, ‘প্রায় ১৫০ বছর আগে হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামে এক বৈষ্ণব আখড়ায় ‘ঘেটু’ গান নামে এক নতুন সংগীতধারার সৃষ্টি হয়েছিল’। তবে হুমায়ূন নতুন ধারার ঘাটুগানের এই যে কাল নির্ধারণ করেছেন, তা কীসের ভিত্তিতে করেছিলেন তা উল্লেখ করেননি। অবশ্য সেটা কোনও গবেষণাপ্রবন্ধও ছিল না। ঘেটুপুত্র কমলা নামক নির্মিত চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে টাইটেলে এ-কথাগুলো তিনি লিখেছিলেন। আমাদের ধারণা তাঁর এই কালনির্ণয় ছিল অনুমানভিত্তিক কিংবা কিংবদন্তির আলোকে। কেননা হুমায়ূন আহমেদের তথ্যানুযায়ী ঘাটুগানের উদ্ভবকাল দাঁড়ায় উনিশশতকের মাঝামাঝি কালে। এটা যেকোনও বিচারে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ঘাটুগানের উৎপত্তিস্থল হিসেবে ভাটি জনপদ বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জের জলসুখা হিসেবে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমির লোকজ সংস্কৃতি বিষয়ক জরিপ ও গবেষণায়। সে-প্রতিবেদন থেকে জলসুখার যে-ইতিহাস চোখে পড়ে তা এইরূপ,
ওই অঞ্চলে তেরোজন জমিদারের বাস ছিল। তারমধ্যে বারোজন হিন্দু ও একজন মুসলমান জমিদার ছিলেন। হিন্দু জমিদারের মধ্যে প্রয়াত গিরীশচন্দ্র রায় গং ও মুসলমানের মধ্যে মৃত রমজান আলী চৌধুরী ওরফে গোছা মিয়া চৌধুরী ছিলেন। তারা গ্রামের শৌখিন মানুষের বিনোদনের জন্য বর্ষাকালে যাত্রাগানসহ নানান আয়োজন করতেন। খরস্রোতা কুদলিয়া নদীতে নৌকাবাইচের ব্যবস্থা হতো। একপর্যায়ে তারাই ঘেটুগানেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। গ্রামের একমাত্র বৈষ্ণব-সম্প্রদায়ের প্রাচীনতম গোপীনাথের আখড়াটিতে কোনও একসময় ঘেটুগান সৃষ্টি হওয়ার তথ্যের যথাযথ প্রতীয়মান হয়। গোপীনাথের বৈষ্ণব আখড়াটি পরিদর্শনকালে দেখা গেল, অতিপ্রাচীন এই আখড়াটি সেকালের চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি। প্রচণ্ড (প্রস্থ) গাথনি ও কারুকার্যে ভরপুর ছিল। বর্তমানে অযত্মে অবহেলায় রয়েছে। আখড়াটি গাছপালায় ভরপুর। এখন অনেকটাই ভূতুড়ে স্থানে পরিণত। […] তথ্যের ভিত্তিতে বৈষ্ণব আখড়ায় ঘাটুগান সৃষ্টির যৌক্তিকতা পাওয়া যায়। তাই জলসুখার গোপীনাথের আখড়াটি ঘাটুগান সৃষ্টির স্থান হিসেবে গণ্য করা যায়।
অনেক গবেষক ও উৎসাহী লোক আজও ঘাটুগানের সেই ঐতিহ্যবাহী স্থানটি দেখতে যান। অনেকে স্মৃতিচারণ করেন জলসুখার। বর্তমান গবেষণার জন্য ক্ষেত্রকর্মের মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ করতে গিয়ে এককালের সরকার, ঘাটু কিংবা দোহার, যাদের সবাইই বয়োবৃদ্ধ এখন; তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন আজমিরিগঞ্জেই ঘাটুগানের জন্ম হয়। অবশ্য এর বাইরে কেউ-বা বলেন সিলেটের জৈন্তাপুরে, আবার কেউ-বা আসাম-করিমগঞ্জে বলে উল্লেখ করেছেন। এককালে ঘাটুগানের দোহার সুনামগঞ্জের ছাতক অঞ্চলের মনিরুদ্দিন নূরী সাক্ষাৎকারে বলেন সিলেটেই ঘাটুগানের জন্মস্থান বলতে গেলে আজমিরিগঞ্জই। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার মটাই মিয়ার (ছদ্মনাম; তিনি প্রথমে তথ্য দিতে রাজিই হননি) মতে, জৈন্তাপুরেই ঘাটুগানের উদ্ভব হয়। তিনি এককালে ঘাটু নাচাতেন। বিভিন্ন সময়ে তার প্রায় বারো/তেরোটি ঘাটু (ঘাটুয়া) ছিল। মটাই মিয়ার কথার সম্মতি মেলে সুনামগঞ্জের বয়োবৃদ্ধ ঘাটুগানের বিশারদ তোরাব আলীর বক্তব্যেও। তিনি বলছেন আসামের করিমগঞ্জ থেকে জৈন্তাপুরের লোকেরা ঘাটুগান নিয়ে আসে। এঁদের প্রায় সকলেই ‘ঘাট’ থেকে যে ঘাটুগানের জন্ম তা স্বীকার করেছেন এবং ঘাটুগানের সঙ্গে বর্ষাকাল, নৌকাবাইচ, হাওর ইত্যাদি অনিবার্যভাবে যুক্ত করেছেন। তবে এ-বিষয়ে তোরাব আলী বলেছেন ভিন্নকথা।
তবে ‘ঘাট’ থেকে ‘ঘাটু’ শব্দটি যে ব্যুৎপন্ন হয়নি তার জোর বক্তব্য দিয়েছেন সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী। নিজের মতের পক্ষে তিনি অন্তত দুটি কারণ দেখিয়ে বলেছেন যে, ‘ঘাট’ থেকে ‘ঘাটু’ শব্দের উদ্ভব হওয়ার কোনও কারণ নেই। তাঁর যুক্তি এই,
প্রথমত, শ্রাবণীব্রত আর দুর্গাপূজার বিসর্জনের আড়ং ব্যতীত এই ছেলে দলকে আর কোনওদিন নৌকায় তুলিয়া ঘাটে ঘাটে নৃত্যগীতের আসর জমাইতে দেখি নাই-এই দুইদিন ব্যতীত আর সবসময় এ-গান লোকালয়েই গীত হইয়াছে-এখনও সামান্য হইয়া থকে। (বর্তমানে এই গাঁডুকে ‘বটগাঁডু’ বলে); দ্বিতীয়ত, কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, কৃষ্ণের যমুনার ঘাটে বসিয়া গোপীগণের সঙ্গে বস্ত্রহরণ ইত্যাদি ইত্যাদি বাহ্যলীলার অবতারণা হইতে কৃষ্ণের আর এক নাম ঘাটু, এ-ব্যাখ্যা এক উদ্ভট কল্পনা বলিয়া মনে হয়। বৈষ্ণবগ্রন্থের কোথাও এরূপ উদ্ভট চিন্তার খোঁজ পাওয়া যায় না।
কিন্তু এই বক্তব্যের বিপক্ষেও যুক্তির অবতারণা করে বলা যায় যে, কৃষ্ণের অপর নাম ‘ঘাটু’ এটা ইতিহাস সিদ্ধ না-হলেও, এই মত গ্রহণযোগ্য না-হলেও ঘাটুগানের বিভিন্ন বিষয়াবলি বা ভাববস্তু বিচার করলে দেখা যায় তাতে কৃষ্ণলীলার যমুনা-ঘাট সম্পৃক্ত গান রচনা এবং পরিবেশনায় ঘাটুদল জোর দিয়েছেন বেশি। সুতরাং যমুনা-ঘাটে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাজাত গান বলে এর নামকরণ ঘাটুগান হয়েছে এমন ধারণাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আবার তোরাব আলী ঘাটুগানকে ঘাটু না-বলে ‘ঘেটু’-গান বলাই সঙ্গত মনে করেন। তাঁর কথা হচ্ছে “ঘেটু হচ্ছে একটা ‘মূর্তি’। মূর্তি সামনে রেখে গান গাওয়া হতো। অর্থাৎ ‘ঘট’ থেকে ‘ঘেটু’। ঘেটুসংগীতই পরবর্তীকালে ঘাটুগানে বা ঘেটু গানে রূপ নেয়।” তোরাব আলীর প্রধান যুক্তি হচ্ছে ঘেটুগান কৃষ্ণভক্তিমূলক গান। তাই ‘ঘাট’ থেকে ‘ঘাটু’ হওয়া অসম্ভব। বিভিন্ন অঞ্চলেও অবশ্য ঘাটুর বদলে ‘ঘেটু’ শব্দের প্রয়োগ আছে। হুমায়ূন আহমেদও তাঁর চলচ্চিত্রের নাম দিয়েছিলেন ঘেটুপুত্র কমলা। তোরাব আলীর এই মতও ভাবার মতো।
এখন এ-পর্যায়ে এসে আমরা ঘাটুগানের উদ্ভব প্রসঙ্গের শেষ সীমানা টানতে চাই। বিভিন্ন মনীষী ও গবেষকের মতামত, যুক্তিতর্ক, অনুমান, ক্ষেত্রকর্ম এবং বর্তমান গবেষণার পর্যবেক্ষণে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, ঘাটুগানের উদ্ভবস্থল বৃহত্তর সিলেটের অন্তর্গত হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জের জলসুখা গ্রামে। রাধাকৃষ্ণের সংকীর্তনের সঙ্গে এর উদ্ভব-ইতিহাস জড়িত হলেও পরবর্তীকালে তা অধ্যাত্মভাব এড়িয়ে নিছক লোকসংগীতের একটি ধারায় পরিণত হয়। নামকরণের ক্ষেত্রে ‘ঘাটু’ শব্দের ব্যুৎপত্তি ‘ঘাট’ কিংবা ‘গান্টু’ শব্দদুটোর যে-কোনও এটি থেকে হওয়া সম্ভব। আমাদের বিবেচনায় ‘ঘাট’ থেকে হওয়াটা স্বাভাবিক। সিলেটে ‘ঘাটু’ শব্দের আরও আঞ্চলিক রূপ রায়েছে যেমন ‘ঘাটুয়া’, ঘাট-উয়া’, ‘ঘাউট্যা’, ঘাউটা, ‘ছোকরা’, ‘নাচইয়া’ ইত্যাদি। অর্থের পতনে এখন এটি একটি ‘গালিশব্দ’ও।
বর্তমান গবেষণার পর্যবেক্ষণে সুতরাং সিলেট ঘাটুসংস্কৃতির কেন্দ্রীয় অঞ্চল এবং সেখান থেকে ক্রমে ত্রিপুরা, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, ঢাকা ও টাঙ্গাইলে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা অঞ্চলে ঘাটুগানে প্রচলেন পেছনে পূর্বেই গোলাম রসুলের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের বিবেচনা হচ্ছে, জমিদার গোলাম রসুলের ব্যাপক জমিদারি হবিগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সিলেটের লাউড় অঞ্চলের অনেক চৌধুরী তাঁর জমিদারির ‘মুনশি’ হিসেবে কাজ করতেন। তাই ধারণা করা সম্ভব যে, সেসব চৌধুরীদের মাধ্যমেই তিনি আজমিরিগঞ্জ ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে ঘাটু ও ঘাটুর দল সংগ্রহ করতেন। এটা তখনকার যুগে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। যা-ই হোক, কেন্দ্রীয় অঞ্চল হিসেবে বৃহত্তর সিলেটের এমন কোনও গ্রাম পাওয়া যাবে না যেখানে ঘাটুগান প্রচলিত ছিল না। ক্ষেত্রকর্মের মাধ্যমে গান ও তথ্যসংগ্রহের জন্য যে-গ্রামেই গিয়েছি সেখান থেকে নানা তথ্য পেয়েছি। একটি-দুটি গান পেয়েছি। এমন কোনও এলাকা পাওয়া যায়নি যেখানে ঘাটুগানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এমন দু-একজন বয়োবৃদ্ধ পাওয়া যাবে। অবশ্য বিষয়টা তাঁরা এখন স্বীকার করতে চান না। এড়িয়ে যান। কেননা এর সঙ্গে এখন সামাজিক মর্যাদাহানি জড়িত রয়েছে।
সিলেটে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমাজে ঘাটুগানের প্রচলন ঘটেছিল। বাউল শাহ আবদুল করিমের গানেও এর উল্লেখ আমরা দেখি,
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলাগান ঘাঁটুগান গাইতাম।।
বর্ষা যখন হইত গাজির গান আইত
রঙ্গে-ঢঙ্গে গাইত আনন্দ পাইতাম।
বাউলাগান ঘাটুগান আনন্দের তুফান
গাইয়া সারিগান নাও দৌড়াইতাম।। […]
উদ্ধৃত গানটি সিলেটের লোকসংস্কৃতির অনন্যতার উজ্জ্বল উদাহরণ। সেদিক থেকে বহুমাত্রিক সিলেটের লোকসংস্কৃতিতে অবসর-বিনোদন, বিলাস এবং সাংগীতিক তৃষ্ণা থেকে এর বিস্তার হলেও পরে ঘাটুসংস্কৃতি সামাজিক অনাচারে পরিণত হয়; সেটা নানাদিক থেকেই। বাংলাদেশের আর কোনও অঞ্চলে এমনটা ঘটেছে বলে তথ্য মেলেনি। আসাদ্দর আলীর স্মৃতিচারণমূলক রচনা থেকে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায় যে,
তখন ছেলেধরার দল মা-বাবার কোল খালি করে ছোটো ছোটো সুন্দর ছেলেকে চুরি করে নিয়ে ঘাটুর আড্ডায় বিক্রি করে দিত। বেশিরভাগ ছেলের নাম বদলিয়ে ঘাটুগানে শিক্ষিত করে তুলত ওস্তাদেরা। অনেক ছেলে ঘাটুজীবন অতিবাহিত হওয়ারপরও তথ্য না-জানার কারণে বাবা-মার কোলে ফিরে ফিরে যেতে পারেনি। […] ভাড়া দেওয়াসহ পণ্যের ন্যায় রীতিমতো বেচাকেনা চলত ঘাটুকে। আগেকার দিনে কোর্টকাচারিতে অনেক মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে ঘাটু নিয়ে। ১৯৬৮ ইংরেজিতেও সনামগঞ্জের মহকুমা হাকিম আদালতে ঘাটুসংক্রান্ত মামলা দেখেছি।
এদিকে ঘাটুগানের উৎপত্তিস্থল আজমিরিগঞ্জ এককালে ঘাটু কেনাবেচার কেন্দ্র বলে উল্লেখ করেছে গবেষকরা। তাঁদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, “এককালে এখানকার ‘ফান্দুক’ গ্রামের ঘাটু কেনাবেচা হতো। ফান্দুকের বালকেরা অধিক সুশ্রী ছিল; এজন্য ঘাটুরূপে তাদের চাহিদা ও কদর ছিল। আঞ্চলিক ভাষা তাদের ‘হান্দুইক্যা ঘাটু’ বলা হতো। নেত্রকোণার লোক এখান থেকে ঘাটু সংগ্রহ করে দলগঠন করত।” ক্ষেত্রানুসন্ধান দ্বারা এও জানা গেছে যে, সুনামগঞ্জের জাউয়া বাজার ও সিলেটের করিমগঞ্জ বাজারেও (বর্তমান আসামে) উৎকৃষ্ট ঘাটু পাওয়া যেত। জৈন্তাপুরের ঘাটুরা স্বভাবত লাজুক ছিল। আর হবিগঞ্জের ঘাটুরা ছিল বেপরোয়া স্বভাবের।
৪.
ঘাটুগানের প্রেক্ষাপট ও উদ্ভব প্রসঙ্গে উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এপর্যায়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব যে, ঘাটুগান বাংলার অপরাপর আঞ্চলিক গীতের মতো বিশেষ ধরনের এক গীতিধারা, যা বাংলার লোকসংস্কৃতির নানাবিধ মিথষ্ক্রিয়ার ফলাফল হিসেবেই এর সৃষ্টি, প্রসার ও বিস্তার। ভাটিবাংলার অঞ্চল হিসেবে হাওড়-বিল-নদী বেষ্টিত বৃহত্তর সিলেটের প্রত্যন্ত হবিগঞ্জের অন্তর্গত জলসুখা গ্রামে ষোলো শতকের শেষার্ধ কিংবা সতেরো শতকের প্রথমার্ধে বৈষ্ণবীয় কৃষ্ণভক্তি থেকে গীত গান থেকে এর উদ্ভব। পরে শুধু হিন্দুসমাজে নয়, মুসলমান সমাজেও এই গানের প্রচার-প্রসার লাভ করে। অর্থাৎ প্রথম দিকে সাধকদের বিশেষ আচারসংগীত হলেও পরে তা ‘অ-সাম্প্রদায়িক’ সংগীত হিসেবে লোকসংগীতের অঙ্গীভূত হয়। এবং এর পেছনে কাজ ক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে প্রত্যন্ত সিলেটের বিশেষ ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা উৎপাদ ও উপাদান। পরবর্তীকালে ঘাটুসংস্কৃতির প্রভাব ও লোকপ্রিয়তা সন্নিহিত অঞ্চলসমূহে ছড়িয়ে পড়ে লোকসংস্কৃতির একটি বলয় তৈরি করে। এই বলয়ের রয়েছে নানা কেন্দ্র ও উপকেন্দ্র। উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রগুলো হচ্ছে হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, আসামের করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি, ত্রিপুরার উত্তরাংশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল প্রভৃতি। বাংলার অপরাপর লোকসংগীত যেমন পটুয়া, ভাদু, ঝুমুর, গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, জাগ, আলকাপ, লেটো প্রভৃতির মতোই ঘাটুগান বিশেষ ঐতিহাসিক এবংবিধ কারণে উদ্ভূত ও প্রচারিত হয়ে সন্নিকট ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে প্রভাব-পরিব্যাপ্ত হয়ে বিশেষ অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। তবে বঙ্গীয় সংস্কৃতির ধারা ও নিজস্ব ভাববস্তুর গুণেই আবার উল্লিখিত লোকসংগীতের মতো আশুতোষ-কথিত ‘ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি’ নীতি রক্ষা করে ঘাটুগান বাঙালির সামগ্রিক লোকসংস্কৃতি তথা লোকসংগীতের অন্তর্ভুক্তও হয়েছে।
এই বিষয়ে লেখকের গবেষণা ঘাটুগান ঘাটুসংস্কৃতি শীর্ষক গ্রন্থে বিধৃত, যা নাগরী থেকে প্রকাশিত এবং বইবিক্রির অনলাইন দোকানগুলায় পাওয়া যায়। গ্রন্থরূপে এর সাইটেশন ইত্যাদি রিসার্চ-এথিক্স মেনে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে। এই প্রবন্ধের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিস্তারিত তথ্যনির্দেশ অনলাইন মিডিয়ায় পাব্লিশকালে বর্জিত হয়েছে কেবল ওয়েবম্যাগে প্রেজেন্টেশন রিডারফ্রেন্ডলি করবার প্রয়োজনে। — গানপার
জফির সেতু রচনারাশি
গানপারে ঘাটুগান
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS