তাণ্ডবমত্ত শহরে বেতো ঘোড়াদের বিচরণ

তাণ্ডবমত্ত শহরে বেতো ঘোড়াদের বিচরণ

অতীতের দমবন্ধ পরিবেশ পুনরায় ফেরত আসার আগে মধ্যবর্তী এই পরিসরকে কাজে লাগানো উচিত। প্রাণভরে শ্বাস টানার সুযোগ পরে জুটবে বলে মনে হচ্ছে না। লেখা দরকার। দুহাত খুলে লেখা দরকার। পারছি কই? রাস্তায় মাসুম ছেলেমেয়েরা যানজট সামলাচ্ছে। বাজার সামলাচ্ছে। দেয়াল রং করছে। তাদের চোখমুখে দেশকে গড়ে তোলার স্বপ্ন ঝিলিক হানছে টের পাই। বয়সটি এরকম! এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়; — হেলাল হাফিজের পঙক্তিকে তারা ভাষা দিতে আকুল! যুদ্ধে যাবার এই বয়স আমরাও একদিন পার করে এসেছি। অসম্ভবকে সম্ভব ভাবার সাহস ছিল সেখানে জাদুর কাঠি। অফিস যাওয়া-আসার পথে জাদুকর সেই বয়সে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলোর মুখপানে তাকাই। বুক ধক করে ওঠে! কী মায়াময় তারুণ্য! বিরাট বোঝা আমরা বুড়ো ভামের দল তার ওপর চাপিয়েছি। নিজেরা তো কিছু ছিঁড়তে পারিনি, এখন পারাপারির সকল ভার তার ঘাড়ে চাপিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার উপায় খুঁজছি। এই বয়সে যা করার কথা নয় সেগুলো করতে বাধ্য করছি তাকে। বুড়োটে চোখে এসব দেখি আর ফানুস দপ করে কদিন বাদে হাওয়ায় উবে যাবে ভেবে বুক মোচড় দিয়ে ওঠে। এই যখন অবস্থা, কলম কী করে চলে বলুন! তবু হয়তো লিখব। লিখতে তো হবে। এছাড়া কিছু পারি না ঠিকঠাক।

বৃষ্টিতে ভিজে কাক বাচ্চাগুলোর মুখে লাবণ্যপ্রাণ নতুন দিনের দ্যুতি কিন্তু আমি তাকে পড়তে পারছি না। ঘোলাটে লাগছে। মন কুডাক ডাকছে খালি! আহা! তারা যদি প্রতারিত হয়! যদি অচিরে বুঝে ফেলে, স্বাধীন নয় বরং তাদেরকে পরাধীন করা হয়েছে পুনরায়! স্বপ্নভঙ্গের দায় তখন কে নেবে? আমাদের স্বপ্ন যারা ভেঙেছিল তারা কি দায় নিয়েছে আজতক? কাকে দায়ী করবে তখন এই এত-এত ভোরের শিশির? নিজেকে? নাকি যারা তাদের রাস্তায় নামতে বলেছিল তাদেরকে? বুক মোচড় দিচ্ছে এসব ভেবে। স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা মর্মান্তিক। বিষাদমাঝে এটুকু সুখ হয়তো থাকবে,— একদিন তারা রাস্তায় সরব হয়েছিল। সাথিদের চোখের সামনে খুন করা হয় রাস্তায়, তবু রাস্তা ছাড়েনি। আগলে রেখেছে লাশ। রক্তে টগবগ ফুটছিল প্রতিশোধ। বৃষ্টিতে ভেজা কাক হয়ে বুড়ো ভামদের রেখে যাওয়া ময়লা সাফাইয়ে নেমেছিল একঝাঁক উজ্জ্বল পায়রা।

এরচেয়ে বেশি বলা কঠিন। দেখে যাওয়া সার মনে হচ্ছে। সবাই দেখছেন। তাদের সঙ্গে ভিড়ে আমিও দেখছি। সবাই বলছেন। আমিও তাল দিয়ে বলছি দুকথা। দুকান ভরে শুনছি। শুনেই যাচ্ছি। হাসিনাপতনের পর থেকে নির্ভার হওয়ার কথা ছিল। পারছি কই! পতনের আগে-পরের কদিন কেমন কাটল তার খতিয়ান নিজের কাছেও ঝাপসা! কারফিউ জারির দিন থেকে তামাদি হওয়া অবধি অফিসে যাতায়াত করেছি সমানে। পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনে শরিকদের মরণপণ লড়াই নিষ্প্রাণ দেখে গেছি। তারা লাঠিসোটা হাতে উদ্যত। ঢিল ছুঁড়ছে। পুলিশ গুলি ছুঁড়ে জবাব দিচ্ছে সমানে। একটি ছেলেকে দেখলাম গোত্তা-খাওয়া ঘুড়ির মতো রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছে। মাথায় বুলেট ঢুকেছিল। একই দেশের নাগরিক তবু তারা এক নয় আর! মাঝখানে পাহাড়সমান প্রাচীর উঠেছে। একে অন্যের প্রতিপক্ষ হয়ে লড়ছে। হাসিনা আর কিছু না পারুক, তাদেরকে প্রতিপক্ষ করে মরণখেলায় নামিয়ে দিতে পেরেছে।

মরণখেলায় এইবার হাসিনা জিততে পারেনি। জেতার কথাও ছিল না। লৌহমানবী হেলিকপ্টারে চড়ে পালিয়েছে। সে পালিয়েছে বৃষ্টিঝরা আগস্ট মাসে। পালানোর খবর পেয়ে বুঝি অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরাল শ্রাবণাকাশ? আকাশ কি কাঁদছে অবিরল? যদি কাঁদে তাহলে তার রং কী? কান্নার কোনো রং হয় কি? যদি হয় তবে আকাশ কি নির্ভার হওয়ার আনন্দে ক্রন্দসী? নাকি বিষাদ ও পরিতাপ ঝরিয়ে হালকা হতে কাঁদছিল? কিছু বুঝতে পারছি না। বোঝা যাচ্ছে না সম্যক। হাসিনাপতনের তাৎক্ষণিক মুহূর্ত যদি বলি সেটি (আমার কাছে) এরকম ছিল। এরকম হয়ে দেখা দিয়েছিল সে।

জানালা দিয়ে দেখছি, আকাশের কান্নায় শরিক হতে রাস্তায় মানুষ নেমেছে। ছেলে-মেয়ে-বুড়ো কেউ বাকি নেই। শিশুরাও রাস্তায়। শ্লোগান দিচ্ছে মনখুলে। বুনো আনন্দে নিঃশ্বাস টানছে সব্বাই। আমার তবু বিকার নেই। উত্তাপ টের পাচ্ছি না। জানি না কেন! অতঃপর রজনী ঘনায়। উল্লাসকে অচিরে তাণ্ডবে মোড় নিতে দেখি। তাণ্ডবমত্ত শহরে বেতো ঘোড়ার মতো বিচরণ করি পরের ক’দিন। কারো সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ নাই। সম্বল বলতে জাভেদের সঙ্গে ফোন আর হোয়াটসঅ্যাপে হালকাপাতলা সংযোগ। বার্তা চালাচালি। ঘোলাটে সময় কী বহন করতে যাচ্ছে সেটি নিয়ে আলাপ। সময় বলে দিবে এর কতখানি সঠিক কিংবা বেঠিক ছিল। বেঠিক যদি হয় তাহলে বৃষ্টিভেজা তারুণ্যকে প্রথমবার বাংলাদেশ জিততে দেখবে। চাই, মনপ্রাণে চাই, তারা জিতুক। বুড়ো-হাবড়াদের শঙ্কায় জল ঢেলে জিতুক। হতভাগা দেশকে নতুন ছন্দে গড়ার যজ্ঞে জয়লাভ করুক। তারুণ্যের জয় পরাজিত করুক বুড়োদের। কিছু পরাজয় জয়ের সুখ জাগায়। তাই যেন হয় ঈশ্বর। যদি না হয়…? থাক, আপাতত ওসব আর ভাবতে চাইছি না।


জুলাই জেনোসাইড, লাল জুলাই
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you