বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমকে (Shah Abdul Karim) নিয়ে এখন পত্রপত্রিকা এবং ফেসবুকে অনেক লেখালেখি হয়। কিন্তু অনেকেই না-জেনে না-শুনে অনেককিছু ভুলভাবে লিখে থাকেন। যেমন, আমার মায়ের নাম নিয়েও ভুল লেখালেখি হচ্ছে। বর্তমানে অনেকেই লিখে থাকেন যে আমার মায়ের নাম আফতাবুন্নেছা। কিন্তু, ইহা সঠিক নয়। আমার মা তারা তিন বোন ছিলেন, আতরজান বিবি, মমজান বিবি, সরজান বিবি। আমার মা ছিলেন মধ্যম। আমার মায়ের নাম হলো মমজান বিবি এবং ডাকনাম বৈশাখী’। হয়তো বৈশাখ মাসে জন্ম নিয়েছিলেন বলেই বৈশাখী নামটা। আমার মা অত্যন্ত সহজ-সরল ছিলেন বলে বাবা (শাহ আবদুল করিম) সরলা বলে ডাকতেন। মাকে নিয়ে বাবা অনেক গানও লিখেছেন; যেমন —
*
সরল তুমি শান্ত তুমি নূরের পুতুলা,
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা।।
*
সরলা গো কার লাগিয়া কি করিলাম,
আপনার ধন পরকে দিয়া
ধনের কাঙ্গাল সাজিলাম।।
আরেকটি বিষয় মনে পড়ে গেল যে, “কেন পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু, ছেড়ে যাইবায় যদি” — অনেকে বলে থাকেন গানটি আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা এই গানটি মায়ের উদ্দেশ্যে লিখেছেন। কিন্তু, তা ঠিক নয়। এই গানটি ১৯৮১ ইংরেজিতে ‘কালনীর ঢেউ’ বইয়ে প্রকাশ হয়েছে। আর আমার মা মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯০ ইংরেজিতে। তাহলে, এই গানটি মাকে উদ্দেশ্য করে মায়ের মৃত্যুর পর কিভাবে লিখা হলো?
মায়ের মৃত্যুর পর বাবা যে-গানটি লিখেছিলেন সেই গানটি হলো, —
*
আর জ্বালা সয় না গো সরলা,
তুমি আমি দু-জন ছিলাম
এখন আমি একেলা।।
দুনিয়া কঠিন ঠাঁই
দুঃখ কইবার জায়গা নাই গো,
মনের দুঃখ কারে জানাই
বসে কাঁদি নিরালা।।
দুঃখে আমার জীবন গড়া
সইলাম দুঃখ জনমভরা গো,
হইলাম সর্বস্বহারা
এখন যে আর নাই বেলা।।
দুঃখিত হবেন না; আমি বলতে চাই — যারা লেখক, গবেষক, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক এবং মিডিয়ায় কর্মরত, আপনাদের সহযোগিতায়ই শাহ আবদুল করিম আজ সারা বিশ্বে বহুল প্রচারিত। আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। তবে, বিশেষ করে আমার এই অনুরোধ রইল যে, ভালো করে জেনেশুনে যে-কোনো বিষয় উপস্থাপন করবেন।
জানার জন্য ‘শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র’ বইটি পড়লেই সঠিকভাবে অনেককিছু জানতে পারবেন। এমনকি আমি সহ বাবার অনেক ভক্তবৃন্দের মধ্যে যারা বাবার সঙ্গ করেছেন তারা অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন। তারাও বাবার সম্পর্কে অনেকটা সঠিক তথ্য দিতে পারবেন।
দুঃখ লাগে অনেক লেখক ও গবেষক রয়েছেন যারা কখনও শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে চর্চা করেননি, শাহ আবদুল করিমকে সঠিকভাবে না-জেনেই তারা শুধু বাণিজ্যের জন্য আমার অনুমতি না নিয়ে, আমাকে না-জানিয়ে অনেকসময় দেখা যাচ্ছে বই প্রকাশ করে যাচ্ছেন। এই সমস্ত বইয়ে অনেক ভুল তথ্য উপস্থাপন হচ্ছে। যার ফলে আজ আমার মায়ের নামটিও ভুলভাবে ‘আফতাবুন্নেছা’ নামে প্রচারিত হচ্ছে। এমনকি কেউ কেউ আমার মাকে হিন্দু বলেও লিখেছেন। আর লিখেছেন আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা যে-খাটে শুইতেন সেই খাটের নিচেই নাকি মাকে দাফন করা হয়েছে! নিশ্চয় আপনারা যারা শাহ আবদুল করিমের স্মৃতিবিজড়িত উজানধল গ্রামে এসেছেন তারা অবশ্যই দেখেছেন যে বাবা আদর করে বাড়ির উঠোনে মাকে সমাহিত করেছেন। এইভাবে অনেকেই অনেককিছু লিখছেন।
আবার কিছু কিছু শিল্পী রয়েছেন যারা ক্যাসেট থেকে গান শুনে-শুনেই শিখে গাইতেছেন, যাতে রয়েছে অনেক ভুলভ্রান্তি। যেমন, —
দিবানিশি ভাবি যারে
তারে যদি পাই না,
রঙ্গের দুনিয়া
তরে চাই না।
এটার বদলে গেয়েছেন —
২৪ ঘণ্টা ভাবি যারে
তারে যদি পাই না
অন্যজন গাইতেছেন —
রঙ্গের দুনিয়া তরে চায় না
আরেকটা গানে, —
পাড়াপড়শি বাদি আমার,
বাদি কালননদী
এর পরিবর্তে গাইতেছেন —
বাদি কালনী নদী
অন্য আরেকটা গানে আছে —
রাবেয়া সঁপিয়া দিলেন
দেহ প্রাণ মন,
বলকের ইব্রাহিম ছাড়ে সিংহাসন।।
এখানে ‘বলকের’ পরিবর্তে ‘পলকে ইব্রাহিম ছাড়ে সিংহাসন’ বলে গাইছেন।
এভাবে অনেকেই ভুলভাবে গাইতেছেন। গানের একটা শব্দ ভুলের কারণে গানের মূল ভাবার্থটি নষ্ট হয়ে যায়। তাই, আমি মনে করি, কবি নিজে যেভাবে লিখেছেন সেভাবে গাওয়ার চেষ্টা করাই উচিত।
বাংলা একাডেমি আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে লালন করে। এদেশের সংস্কৃতি নিয়ে একাডেমি অনেক বই প্রকাশ করে থাকে। সেই বইগুলোতেও যে এত ভুল তথ্য প্রকাশ হচ্ছে! যারা ছাপানির দায়িত্বে রয়েছেন, তারাও ঢাকায় বসে-বসেই বিভিন্ন বিষয়ের তথ্যগুলো সংগ্রহ করেন। তারা যাদের উপর দায়িত্বভার অর্পণ করেন, সেই দায়িত্ববাহকেরা কতটুকু সঠিক তথ্য দিচ্ছেন সেটা আমার মনেহয় বড়কর্তারা খতিয়ে দেখেননি। তার প্রমাণ, ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা’ সিরিজে সিলেট, সুনামগঞ্জ … এভাবে বেশকিছু বই প্রকাশ হয়েছে। এই বইগুলোতে রয়েছে অসংখ্য ভুল। এতে শাহ আবদুল করিমের লেখা অনেক গান অন্যজনের নামে ছাপা হয়েছে; যেমন —
মাটির পিঞ্জিরায় সোনার ময়না রে
তোমারে পুষিলাম কত আদরে
এই বহুল প্রচারিত গানটি কোথাকার ‘দুধু মিয়া’-র নামে ছাপা হয়েছে!
তারপর, আরেকটি গান —
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
এই গানটি দুর্বিন শাহের নামে প্রকাশ হয়েছে!
তারপর, একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি দিলওয়ার সাহেবের লেখা “তুমি রহমতের নদীয়া / দয়া করো মোরে হযরত শাহজালাল আউলিয়া” — এই গানটি দুর্বিন শাহের নামে ছাপা হয়েছে!
আমার বাবা শাহ আবদুল করিমের আরেকটি গান “প্রাণ বন্ধু আসিতে সখি গো / আর কতদিন বাকি” — এই গানটির ব্যাপারে লেখা হয়েছে যে এই গানটি সিলেটের বাইরের কবি কর্তৃক রচিত!
আরেকটি গান আমাদের সিলেটের মরমী কবি আরকুম শাহের লেখা, গানটি হলো —
কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে
ফুলে পাইলা ভ্রমরা
ময়ূর বেশেতে সাজইন রাধিকা।।
এই গানটি ছাপা হয়েছে শাহ আবদুল করিমের নামে!
আরও দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, আমার বাবার “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” নামে যে-গানটি একাদশ শ্রেণীতে কবিতা আকারে পাঠ্য করা হয়েছে, সেই গানটিও বাংলা একাডেমির বইয়ে ভুলভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এভাবে আরও অনেক গান ভুলভাবে প্রকাশ হয়েছে।
এই ভুলসম্বলিত বইগুলোতে প্রথমেই তথ্য সংগ্রহের নিয়মাবলি লেখা আছে। আমার মনে হয় সঠিক নিয়মাবলি অবলম্বন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি।
পরিশেষে আমি এ-ই বলতে চাই, শাহ আবদুল করিম এখন শুধু আমার বাবাই নন, তিনি এখন সারাদেশের, সারাজাতির, সারাবিশ্বের। তাই, শাহ আবদুল করিম সম্পর্কে ভুল উপস্থাপন করলে আগামী প্রজন্ম ভুলভাবেই জানবে। এটাই বলতে চাই যে, শাহ আবদুল করিম বা যে-কোনো মানুষ সম্পর্কেই জেনেশুনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা আমাদের উচিত।
COMMENTS