এক তীর্থ দুই যাত্রী || ইফতেখার মাহমুদ

এক তীর্থ দুই যাত্রী || ইফতেখার মাহমুদ

আমি যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি, তখন কিনলাম শাহাদুজ্জামানের ‘বিসর্গতে দুঃখ’ বইটা। দুই হাজার তিন সাল। শ্রাবণ প্রকাশনীর করা। প্রাইমারি স্কুলের বইয়ের মতো। আকারে, গড়নে। বইয়ে বর্ণমালার ধারাবাহিকতা মেনে একজনের গল্প বলা। লেখক শাহাদুজ্জামানের সাথে চিনপরিচয় শুরু হলো।

[শাহাদুজ্জামানকে নিয়ে অগণিত কথা বলার আছে। সেগুলো আশা করি একদিন বলা হবে।
আজকে বরং একটা বেধারার কথা বলা যাক।]

বাংলাভাষায় তৎপর লেখকদের একটা ধারা আছে। তাদের মধ্যে ক্ষীণ একটি রেখা হলো বুদ্ধিমান তৎপরবৃন্দের। এরা বই পড়েন, সিনেমা দেখেন, সংগীতে আনুগত্য প্রকাশ করেন, ভ্রমণে এরা নিবেদিতপ্রাণ। শিল্পসাহিত্যের নানা বিষয়ে তাদের আগ্রহ রয়েছে। লেখক হিসেবে বিজ্ঞানমনস্কতা এদেরকে অগ্রবর্তী করে রাখে। চিরশিক্ষার্থী ধরনের এই ‘বুদ্ধিমান তৎপর’ লেখকবৃন্দ তাদের লেখায় তাদের জীবনযাপনকে উপেক্ষা করতে পারেন না।

বুদ্ধিমান তৎপর লেখক হিসেবে আমার প্রথম যার নাম মনে পড়ে তিনি হুমায়ূন আহমেদ। তারপরই আমার শাহাদুজ্জামানের নাম মনে আসে।

হুমায়ূনের চেয়ে ইলিয়াসের সাথে মিল পেলে শাহাদুজ্জামান বেশি খুশি হবেন বলে মনে হয়, তবুও আমার মনে হুমায়ূনের ধারার পরবর্তীদের একজন হিসেবেই শাহাদুজ্জামানের নাম আসে।

হুমায়ুনের সাথে তার লেখার মিল নেই বললেই চলে, শুধু কথা-বলা ভঙ্গিতে লেখা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া। এটা একালে অনেকেই রপ্ত করেছেন, নতুন কিছু নয় বলেই মনে করি।

হুমায়ূনের ধারা বলতে যা আমার মনে আসে, সেটা হলো, নতুন কিছু করার ধারা। শাহাদুজ্জামানের মধ্যে নতুন কিছু করার যে অন্তর্গত তৎপরতা দেখি, সেটা সুলভ নহে।

শাহাদুজ্জামান নতুন কিছু করার ধারায় প্রায় বিপ্লবীর মতো।

তার লেখা নিয়ে যত তর্ক করা যায়, আরও কারো লেখা নিয়ে এত অমিলের কথা আমি শুনিনি। তাকে নিয়ে কথা বলে বলে দেখেছি, সাধুমহলে বেশ একটা আপত্তি আছে। এই আপত্তি আমার ভালো লাগে। শাহাদুজ্জামান যে নতুন, সেটা ভালো করে ভিত্তি পায় তাতে।

শাহাদুজ্জামান হুমায়ূন আহমেদের মতো নন, কিন্তু শাহাদুজ্জামানকে হুমায়ূনের লিগ্যাসি বহন করতে দেখে আমার অবাক লাগে। এরা দুজনই প্রথমে পাঠকদের হয়েছেন, বই পড়েছে পাঠকেরা, তারও অনেক পরে সমসাময়িক লেখকরা। দুজনকে নিয়েই কেমন যেন একটা আড়াল আছে, ভাষায় কারুকার্যে শাহাদুজ্জামান কাব্যিক, হুমায়ূন কন্টেন্টে কবিতাতুল্য। অদ্ভুতভাবে, জীবনানন্দ তাদের প্রিয়তম কবি। তারা দুজনই খুবই গ্লোবাল। অন্যদেশের অন্য শিল্পীদের তারা একটুও দূরের লোক ভাবেননি। দুজনই সাহসী এবং সংযমী। ভাষায় পরিমিতিবোধ এই দুই লেখকের তুল্য কমই আছে বাংলাগদ্যে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, লেখায় বোকামি একদমই নেই এই দুজনের। বোকামি আড়াল করতে গিয়েই বেশিরভাগ বাংলা ভাষার লেখক সতর্ক ভঙ্গিতে বোকামি করে বসেন। নিজেরা অবশ্যই তা টের পান না। এদের দুজনের মধ্যে নির্বুদ্ধিতাসংক্রান্ত দ্বিধা নেই। এরা এ প্রসঙ্গে নিঃসঙ্কোচ শিল্পী।

আমার অনুমান, শাহাদুজ্জামান হুমায়ূনের লেখা খুব একটা পড়েননি। না-পড়ার মধ্যেই তার মতামত লুকিয়ে আছে। আমি পড়েছি। দুজনকেই। যত্ন এবং মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। মানুষের জন্য মমতা, সত্যের জন্য নির্মমতা এই দুইয়ে এই দুজন অনন্য। আমি তাদের মিলিয়ে ফেলতে চাই না। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে এইসব কথা এলোমেলো হয়ে মনে আসে। সংকোচে লিখি না। মনে হয়, শাহাদুজ্জামানভাই হয়তো দুঃখ পেয়ে বসবেন।

আবার একেকবার মনে হয়, নো প্রবলেম। এইসব লেখা তার চোখে পড়বে না। আর পড়লেই কী! তিনি অতকিছু পরোয়া করেন না। পরোয়া করলে লেখক থাকা যায় না। শেষের কথাটা যে শুধুই ওনার জন্য বলা, তা মনে হয় না।

ঠিক আছে, তাহলে লিখে ফেলা যাক। ‘সিলি’ সব কথা, হোক, তবু লিখি আজ।

[যদি এখনো কারো মনে দ্বিধা থাকে যে, এই লেখা ‘সিলি’ নয়, তাকে বলে রাখি, এই যে শাহাদুজ্জামানের জন্মতারিখ ১০ নভেম্বর আর হুমায়ূনের ১৩, এটাও আমাকে ভাবনায় ফেলে দেয়।]

এত কাছাকাছি কেন এত দূরের এই দুজন?

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you