বিয়াভাঁড়ামো

বিয়াভাঁড়ামো

মডার্ন দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কিমৎ অত্যন্ত চড়া। আপাতচক্ষে দেখে মনে হয় কী সুন্দর আর সাবলীল বেঁচে থাকা! আসলে ব্যাপারটা তার উল্টা। বাঁচতে হয় বেহায়ার মতো, অগত্যা, মডার্ন দুনিয়ায় হাজার ভালো ও বিলাসী বিষয়াশয়ের মাঝখানে এর কার্স এর অভিশাপ নিয়া ভাবতে বসলে ব্রেইনের তার ছিঁড়ার উপক্রম হয়। ব্যাপারটা ভাঙায়া বলা যাক।

ধরেন যে আপনি ভীষণ পড়ুয়া মানুষ। বই পড়েন বা চান কাজের জিল্লতির শেষে বা ফাঁকে একটু বই পড়তে। এত বই রোজ আপনার চোখের সামনের বাজারে গড়াগড়ি খায় এবং আপনারে এত প্রলোভিত করে যে টেকা দায়। হাতে নিয়া আপনি যদি পড়তে লাগেন তখনই দেখবেন নব্বইভাগ ক্ষেত্রে প্রতারিত হবার বোধ আপনার ভিতরে গেঁড়ে বসে। আজাইরা বই, কিন্তু বিজ্ঞাপিত হয়েছে বাপের দুর্দান্ত ব্যাটাটার মতো। কোথায় যাবেন ভালো বইয়ের খোঁজে? চোখ খুললেই বাজার। চোখ বন্ধ করলেও বাজার। আর বাজারদালালেরা ক্রেতাপাঠকের বারোটা বাজায় কাতারে কাতার।

তারপর ধরেন আপনি সিনেমা দেখেন। সর্বভুক সিনেমাখাদক আপনি। কী দেখবেন! খালি ভুষিমাল চারপাশে। ভালো ভালো মালগুলো ভুষির চাপে এবং দাপটে-দৌরাত্ম্যে কোণঠাসা থাকে।। এখন, এই-যে খারাপের চাপে ভালোর দফারফা বা কোণঠাসা হালত তো শুধু মডার্নকালের ব্যাপার না। আদ্যিকালের এবং চিরকালেরই। কিন্তু পূর্বের যে-কোনো সময়ের তুলনায় রদ্দি জিনিশের রমরমা আজকের দুনিয়ায় বেশি এবং থিয়োরি দিয়াও রদ্দিরই পক্ষে সাফাই গাইবার জন্য অ্যাকাডেমিয়া ইত্যাদি তো চব্বিশঘণ্টার নিয়োজিত ও নিবেদিত ব্যবস্থা।  আপনি সিনেমা দেখতে বসে মনের ভুলে বা আপন খেয়ালে খারাপেরই খপ্পরে জীবন কাটিয়ে টেরও পাবেন না। পাবেন যখন ততদিনে দেখাকম্ম সারা, আপনি তখন ক্রিটিক তথা মারা-যাওয়া পাঠক/দর্শক/শিল্পোভোক্তা।

ভারতীয় ম্যুভিসিনেমা না-দেখে কি উপায় আছে? দেশে এমন ব্যবস্থা আর পারিবারিক আবহ আমাদের যে সারাক্ষণ ভারতীয় শিল্পপ্রচারণায় দিন কাটাতে হয়। আপনি না-চাইলেও ইন্ডিয়ানবাংলা ছায়াছবি আপনার চোখের পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে এবং তার খপ্পর থেকে রেহাই পান না। বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ সম্ভবত যাদের নিজেদের কোনো সিনেমা নাই। সিনেমা আমরা বানাই না। অ্যাড বানাই বা কাব্য ইত্যাদি। সিনেমা বানাইবার ব্রেইন আল্লা আমরারে দেন নাই। ইন্ডিয়ানবাংলা সিনেমা দেখে এবং তাতে অর্থলগ্নি করে আমরা আন্তর্জাতিক সিনেমার অঙ্গনে সেল্ফি খিঁচে বেড়াই।

সিনেমার নামটা অ্যাট-লিস্ট বলি, যেইটা দেখে এত তত্ত্ব কপচাচ্ছি। সিনেমার নাম ‘বিবাহ অভিযান’। ভাষা বাংলা। খাঁটি নয়, ইন্ডিয়ানটা। এইখানে লিখব বলে ডিরেক্টরের নামটা টাচফোনে এঁকে রেখেছিলাম, অভিনয়কুশলীদেরও, ডিরেক্টর বিরসা দাশগুপ্ত। পয়সা দেয় কে এই লোকগুলারে সিনেমার মতো ব্যয়সাপেক্ষ একটা কাজে বাজেভাবে খরচের জন্য? অবাক লাগে। এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন যারা, তাদের নাম দেখে দেখে টুকছি : অঙ্কুশ, রুদ্রনীল, অনির্বাণ, সোহিনী, প্রিয়াঙ্কা, নুসরত ফারিয়া এবং আরও অনেকে। সিনেমার কাহিনি শুনবেন? নারদ নারদ!

এত ঢিলা কাহিনি লিখতে যে পারে তারে একবার অন্তত বলা দরকার উনি জিনিশ একখান। চিত্রনাট্য যে এত ঢিলাঢালা হতে পারে এইটা আমরা মান্নাযুগের দর্শকেরাও মেনে নিতে পারি না। ফালতুর সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া নাট্য ও নাটামি। ভাঁড়ামির চূড়া। নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে কেবল রুদ্রনীলকে আগে থেকে চিনি, বাকিরা পোশাকপরা নায়ক-নায়িকা। আর রুদ্রনীলের ভালো রোল যেমন আছে ক্যারিয়ারে, ভাঁড়ামির নিম্নস্তরের দরোজাটাও উনিই আগলায়ে রেখেছেন। এই সিনেমায় উনি দরোজায় যেন দৈত্যসম।

চিত্রনাট্য তো নাম-কা-ওয়াস্তে, তবু এই ধরনের সিনেমার দর্শক যে আছেন এবং এই দর্শক আসলে টেলিভিশনের সোপঅপেরার বানানো দর্শক, তারা আনন্দ পেতেও পারেন। তবে এই সিনেমাটা আরেকটু নুনমরিচ বেশি হলেই সারছিল। অশ্লীল হবার সমূহ আশঙ্কাটা উড়িয়ে এর অভিনয়কারীরা কেবল অভিনয় দিয়া হাসানোর কসরত করে গেছেন। সংলাপ নাই, সত্যিই সংলাপের নামে যা আছে তা মানুষ বসে বসে বলতে বা লিখতে পারে তা ভাবাই যায় না। এমন একটা সিনেমায় যে-কয়বার হাসি ঝিল্কাবে আপনার বদনে তা ওই অভিনয়শিল্পীদের মরিয়া ট্রাইয়ের কারণেই। বেচারারা! আর বিয়া নিয়া ভাঁড়ামোরও একটা মা-বাপ একটা ইশটিশন একটা পারঘাটা থাকতে হয়, যেইটা এই সিনেমায় পাওয়া সাধ্যাতীত প্রায়। এর বেশি বললে তো আপনারা আমায় রামগরুড়ের ছানা ঠাওরাবেন।

লেখা / মিল্টন মৃধা

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you