কণ্ঠসম্পদ ও কন্ডোলেন্স

কণ্ঠসম্পদ ও কন্ডোলেন্স

একটা ব্যাপার লক্ষ করা যাচ্ছে এখনকার বাংলাদেশে, সেইটা হচ্ছে এ-ই যে, গানবাজনায় শিল্পীর কণ্ঠসম্পদ খুব-একটা খেয়াল করা হচ্ছে না। আগে যেমন ছিল যে কণ্ঠশিল্পীকেই ডিগ্নিটির জায়গায় রেখে সুরশিল্পী বা গীতিকার-সংগীতপ্রণেতা কাউকেই ঠিকঠাক মর্যাদা দেয়া হতো না, আজকে তেমনি সুরকার-গীতিকার-সংগীতকারকে সেলেব্রেইট করা হলেও কণ্ঠশিল্পীটিকে যেন গোনাগ্রাহ্যিতে নেয় না কেউ।

কথা হয়তো সত্য যে একজন কমপ্লিট মিউজিশিয়্যান অগ্রগণ্য সবসময়, কিন্তু কমপ্লিট মিউজিশিয়্যান হবার দৌড়ে নেমে সবাই যার যার কম্পোজিশন যেনতেনপ্রকারেণ নিজের গলায় পার্ফোর্ম করতে যেয়ে এমন একটা না-ঘর না-ঘাট অবস্থা হচ্ছে যা আর বলার নয়। গানবাজনায় কণ্ঠসম্পদের কদর বাংলাদেশে একেবারেই নাই আর।

তবে এই কথাটাও কবুল করে যাওয়া যাক যে কমপ্লিট মিউজিশিয়্যান হওয়াটা জাতির জন্য অত্যন্ত সুখের খবর। বাংলাদেশে এখন শয়ে শয়ে কমপ্লিট মিউজিশিয়্যান। অতটা ভাগ্য দুনিয়ার কোনো জাতির আছে, এমন নজির দ্বিতীয় খুঁজে বের করা ভার হবে। এই জাতি ছিল কবির জাত, শয়ে শয়ে কবির শহরে সয়লাব দেশ, বর্তমানে কবির দাপট খর্ব হতে লেগেছে মিউজিশিয়্যানের সনে পাল্লায়। কিন্তু দম নিয়া খানিক ভাবতে বসলেই বোঝা যাবে যে এই ল্যান্ডে কমপ্লিট মিউজিশিয়্যান চিরকালই ছিল, যাদেরে বলা হয় বাগগেয়কার, যারা নিজের রচনার সুর-কথা-বাজনা-কণ্ঠ সবকিছু স্বয়ং দিয়া থাকেন, তবে বাগগেয়কার হওয়া চাট্টেখানি কথা তো নয়, কাজেই বাগগেয়কার সংখ্যায় চিরদিনই অঙ্গুলিমেয় হবার কথা। বাংলাদেশে হয়েছে বেশুমার কাতারে কাতার। ফলে গানবাজনায়, বিশেষত ‘লঘু সংগীত’ বলা হয় যেইটারে, কণ্ঠের কদর কমতে কমতে একদম তলানিতে যেয়ে ঠেকেছে।

যে-কয়জন ছিলেন আমাদের দেশে কণ্ঠসম্পদের অধিকারী, চিরদিন যারা তাদের কণ্ঠ দিয়ে দেবদেবীদের ঈর্ষা জাগিয়েছেন, ইহলোক থেকে একে একে বিদায় নিতেছেন সবাই। তালিম নিয়া কণ্ঠের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রণিপাত করবে, এমন কেউ অবশিষ্ট রইছে না আর। সংগীতে যেমন বাদ্য, যেমন সুর, যেমন নৃত্য, কণ্ঠও তেমনি পৃথক মর্যাদার একটা ফ্যাকাল্টি কথাটায় কেউ ভরসা রাখছে না আর। সবাই নিজের গলায় ঘেউঘেউ অথবা ঘাঘা করাটারেই মিউজিক বা গান-গাওয়া ভাবছে। এরই মধ্যে যে-কয়জন ছিলেন আমাদের দেশে কণ্ঠসম্পদের কারবারি, শাহনাজ রহমতুল্লাহ সেই লাস্ট মোহিকানদের একজন সম্প্রতি বিদায় নিলেন।

অবশ্য গত দুই/আড়াই দশক ধরে উনি ঠিক অ্যাক্টিভ ছিলেন গানের অ্যারেনায় তা বলা যাবে না। বাংলাদেশ টেলিভিশনে সেই আশি-নব্বইয়ের দশকে যে-অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হতো, ফিরে তাকায়ে দেখে এখন মনে হয়, কম্পারেটিভলি মিউজিক্যাল শো হতো অন্যান্য ধরনের অনুষ্ঠানের চেয়ে বেশি। শাহনাজ রহমতুল্লাহ ওইসব অনুষ্ঠানে গাইতেন দেখতাম। সন্ধ্যায়, বিকালে, রাইত আটটার এবং দশটার খবরের পরে নানান জাতের গানের অনুষ্ঠান হতো। নাটক ইত্যাদি ছিল অত্যন্ত হাতে-গোনা, পাক্ষিক আর সাপ্তাহিক দুইটা, আজকের মতো ঘণ্টায় ঘণ্টায় নাটক আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় ট্যকশো জিনিশগুলা আগে এইভাবে এত বল্গাহারা ছিল না। গান ছিল। শূন্যস্থান ভরাটকরণে ছিল যখন-তখন গানের উদ্গম। শাহনাজ রহমতুল্লাহর গান এইভাবে ছেলেবেলা জুড়ে শুনে গেছি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।

দেশাত্মবোধক গানের একটা ব্যবহার ইশকুলে প্রায় প্রতিদিনই দরকার হতো। ওই ব্যবহারিক দরকারে শাহনাজ রহমতুল্লাহর কয়েকটা গান আমাদের অতো কণ্ঠের বর না-পাওয়াদেরও মুখস্থ ছিল। ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’ এবং আরও অনেক দেশাত্মবোধ-উজ্জীবিত গানের তিনি শিল্পী।

জিয়ার আমলে উনার গান টেলিভিশনে-রেডিয়োয় ব্যাপক অন-এয়ার হয়েছে। এরশাদের আমলে তো হয়েছেই। কিন্তু গত দুই দশকে তেমন নয়া গান উনারে গাইতে দেখা যায় নাই। বয়স হয়েছিল, এইটা একটা কারণ হতে পারে অ্যাবসেন্সের, ধর্মকর্মের আচারকৃত্যে একটু মনোযোগীও হয়ে গেছিলেন হয়তো। বরাবর অল্পই গেয়েছেন উনি। হিন্দি-উর্দু যোগ করেও খুব বেশি গান উনি গেয়েছেন এমন বলা যাবে না তার সমসাময়িক অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলে। এইরকম একটা জাদুদীপ্ত কণ্ঠে আরও অনেক গান ধরে রাখা যেত যদি, কী ভালোই-না হতো!

শুধু দেশাত্মবোধক গানই তো নয়, প্রেমের গানেও উনার অনির্বচনীয় কণ্ঠের ম্যাজিক অবিস্মরণীয়। দুইটা গানের কথা আপাতত বলতে পারি ইয়াদ আছে, একটা হচ্ছে ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’ এবং অন্যটা ‘সাগরের তীর থেকে’; এই দুই গান আমাদের আম্মা-চাচিমা-খালা-ফুপুদের মুখে মুখে ফিরত, শুনে শুনে আমাদেরও মুখস্থ হয়ে গেছিল, আমাদের বাপ-চাচাদেরও অন্তরে শাহনাজ রহমতুল্লাহ করে নিয়েছিলেন বিশেষ একটা জায়গা। আমাদেরও।

উনার আরেকটা পরিচয় আমাদের কাছে তখন খুব উচ্চারিত হতো, উনি জাফর ইকবালের বোন। কোন জাফর ইকবাল? নায়ক জাফর ইকবাল। চমৎকার কয়েকটা গানেরও কণ্ঠদাতা জাফর ইকবাল। উনার আরেক ভাই এদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীতপরিচালক আনোয়ার পারভেজ। বোঝা যায় পারিবারিকভাবেই মিউজিকের একটা প্র্যাক্টিসের অ্যাম্বিয়্যান্স ছিল উনাদের ফ্যামিলিতে।

প্ল্যাব্যাকেই তিনি তার জনপ্রিয় ও দুর্দান্ত কাজগুলো উপহার দিয়েছেন আমাদেরে। ‘গুনাই’ সিনেমায় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে গেয়েছিলেন, পরে একে একে আরও অসংখ্য। ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘পিচঢালা পথ’, ‘ছুটির ফাঁদে’, ‘ঘুড্ডি’ ইত্যাদি সিনেমায় প্ল্যাব্যাক করে উনি অ্যাক্লেইমড হয়েছেন বা অ্যাওয়ার্ডও অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় মোটামুটি ডিগ্নিটির অ্যাওয়ার্ড যা যা আছে। সেসব বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে শাহনাজ রহমতুল্লাহ সংগীতশ্রোতা মানুষের প্রিয় কণ্ঠের অধিকারী একজন শিল্পী, যিনি কণ্ঠ দিয়ে একের পরে এক জাদুরুমাল উড়িয়েছেন আকাশে-বাতাসে। অনেক গীতিকার ও সুরকারের কাজে উনার কণ্ঠ যুক্ত হয়ে অভাবিত উড়ান দিয়েছে এইটা সত্য। উনি মূলত গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আলাউদ্দীন আলী, খান আতাউর রহমান প্রমুখ কম্পোজারদের সুরে এবং সংগীতনির্দেশনায় তার পপুলার প্ল্যাব্যাকগুলো করেছেন।

১৯৫২ সনে জন্মে একদম ছোটবেলা থেকেই মিউজিকে এসেছেন এবং বিদায় নিয়েছেন ২০১৯ সনের মার্চে। তার প্রয়াণের পর এই কথাটাই মনে উদয় হচ্ছে বারবার যে এখন বাংলাদেশের গানবাজনাজগতে কণ্ঠের মর্যাদা প্রায় বিলুপ্ত হয়েই গিয়েছে। এখন কণ্ঠ বোধহয় চামচিকার হলেও চলে, মেশিনে সেইটারে গুঁজামিল দিয়া বাঘের বা কোকিলের বানিয়ে নেয়াতেই মিউজিশিয়্যানদের কম্মসারা। অথচ কণ্ঠ তো সর্বস্ব দাবি করে, কণ্ঠ তো মহামহিম শিল্পেরই মর্যাদা পাবার কথা, রেওয়াজ হোক বা তালিম/ট্রেইনিং সবকিছু সত্ত্বেও কণ্ঠ তো অব্যাখ্যেয়। কণ্ঠ নিশ্চয় গিফটেড জিনিশ এক। এই গিফটের অনাদর করতে করতে বাংলাদেশ গিফটশূন্য হয়েই গিয়েছে বলতে হবে।

লেখা : সুবিনয় ইসলাম

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you