এই চোখ দুইটার দিকে তাকিয়ে একটু চেষ্টা করলেই বুঝতে পারবেন সেখানে অনেক কথা লুকিয়ে আছে যেন। চরিত্রটির নাম Thomas More, ষোড়শ শতাব্দীর একজন ক্রিশ্চিয়ান সেইন্টের আদলে লেখা। যে ব্যক্তি চরিত্রটি ধারণ করেছেন, তিনি আবার নিজেকে Simon Templer ওরফে Saint নামে পরিচিত করেছেন অপরাধ আর গুপ্তচরবৃত্তির জগতে। অনাথ আশ্রম থেকে কিশোর বয়সে পালিয়ে আসা John Rossi আজীবন নিজেকে এই Simon Templer-এ পরিণত করেছে। সেই John Rossi আদতে সে-ই কিশোর বয়সেই আটকে গেছে, নিজেকে আজীবন খুঁজে ফিরছে নানা ঐতিহাসিক Saintদের মাঝে। The Saint ম্যুভির সুদর্শন যুবকের এই ভাবুক চোখদুইটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম কোনো হলিউডতারকার অন্ধ ভক্ত হয়ে যাওয়ার কারণ। যেন আইয়ুব বাচ্চুর বিখ্যাত গান, —
হাসতে দেখো, গাইতে দেখো
অনেক কথায় মুখর আমায় দেখো
দেখো না কেউ, হাসি শেষে নীরবতা।
—এটার বাস্তব উদাহরণ এই হলিউড অভিনেতা। যাকে সবাই ততদিনে চেনে Val ‘Iceman’ Kilmer নামে। Iceman খেতাবটা Top Gun মুভির থেকে পাওয়া, যেখানে মূল চরিত্রটিও তার ছিল না। Val Kilmer, ততদিনে Jim Morrison, Doc Holliday, Elvis Presley এমন সব বিখ্যাত চরিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলেছেন, আলোচিত/সমালোচিত হয়েছেন ডিসি কমিক্সের বিখ্যাত Batman/Bruce Wayne চরিত্র করে। অথচ সেই আলোচিত অভিনেতার ভক্ত হলাম কি না তার বক্সঅফিসে মোটামুটি আয় করা একটা সিনেমায় এসে, কী অদ্ভুত! সিনেমাটায় ভ্যাল কিলমার ১২টা ছদ্মবেশ নেয়, বারবার মুখোশের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে অদ্ভুত অভিনয়দক্ষতায়। কিন্তু সেই যে কিশোর John Rossi-র সারল্য, সেটা সবসময়ই তার চোখের মাঝে দেখতে পাওয়া যায়। আমার জন্য তখন এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা, একজন মানুষ কী দারুণভাবে তার শিকড়ের মাঝ দিয়েই যাত্রা করছে! চরিত্ররচনার এই ভীষণ কঠিন ব্যাপারটা প্রথম আমাকে এই একজন ভ্যাল কিলমার ভাবতে শিখিয়েছেন।
তার মা ছিলেন সুইডিশ বংশোদ্ভূত, আর বাবা ছিলেন আংশিক আইরিশ, আংশিক জার্মান এবং আংশিক Cherokee বংশোদ্ভূত। দাদা ছিলেন অ্যারিজোনা বর্ডারের পাশে নিউ মেক্সিকোর একজন Gold Miner. এ-সবকিছুই তাকে খুব অল্প বয়স থেকেই বোধহয় ভাবতে শিখিয়েছিল নানা বৈচিত্র্য নিয়ে। তার উপরে আট বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, নিজের এপিলেপ্সি-আক্রান্ত ছোটভাইয়ের বাসার জাকুজি পুলে ডুবে গিয়ে ১৫ বছর বয়সে মৃত্যু এমন ঘটনাগুলোও খুব অল্প বয়সেই হয়তো ভাবনার জগতে ভিন্নতা এনেছিল তার। নিউইয়র্কের বিখ্যাত জুলিয়ার্ড স্কুলের ড্রামা ডিভিশনে সে-সময়ে সুযোগ পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। থিয়েটারে এতটাই নিবিষ্ট ছিলেন যে ফ্র্যান্সিস ফোর্ড কাপোলার The Outsider সিনেমার অফার পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছিলেন থিয়েটার কমিটমেন্টের কারণে। মজার ব্যাপার, যেই ব্রডওয়ে নাটকের জন্য সিনেমা ফিরিয়ে দেয়া, সেই The Slab Boys-এর প্রধান চরিত্র তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছিলো Kavin Bacon, Sean Pennদের মতো তারকার কাছে। তার নিজের ভাষায়, “নাটকের তারকা হওয়ার কথা ছিল যার, সে এমন একটা চরিত্র করছে যাকে নাটকের সব চরিত্রের হাসির পাত্র হতে হয় প্রতি মুহূর্তে।” হজম করা সহজ ছিল না, কিন্তু কিলমার হজম করেছিলেন। ডেডিকেশন! তার কাছে তখন এই সত্য উন্মোচিত যে ছোট চরিত্র বলে আসলে কিছু নেই, আছে শুধু ছোট অভিনেতা। এবং এই সময়েই তার উপলব্ধি হয় এমন সব চরিত্রের পেছনে ছুটে চলা, যা তাকে রূপান্তর করবে বারবার।
তার স্বপ্ন ছিল ২৭ কিংবা ২৮ বছর বয়সের আগেই ‘হ্যামলেট’ তাকে করতেই হবে। সে-স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছিলেন ’৮৮ সালে। অবশ্য ততদিনে হলিউডে স্টার হয়ে উঠেছেন। প্রথম বিগ ব্রেক ছিল তার সিনেমা Top Secret, যেখানে ভ্যাল Nick Rivrers নামক একজন আমেরিকান রক-ন্-রল স্টার হিসেবে পর্দায় আসেন। ফিল্মের সব গান ভ্যাল নিজেই গেয়েছিলেন, এমনকি নিক রিভার্স নামে তার একটা অ্যালবামও বেরিয়েছিল তখন। তারপর ডেভিড লিঞ্চের Blue Velvet ফিরিয়ে দিয়ে টম ক্রুজের সাথে Top Gun করেন। খ্যাতির চূড়ান্তে যাওয়ার পথের শুরু এভাবেই। এরপরে জিম মরিসন চরিত্রে The Doors, এলভিস প্রিসলি চরিত্রে True Romance, ডক হলিডে চরিত্রে Tombstone… নিজেকে রূপান্তরের একের পর এক দুর্দান্ত প্রয়াস। এর পরেই কোনো দ্বিধা না করে, স্ক্রিপ্ট না পড়েই Batman Forever-এর জন্য সাইন করা। সিনেমাটা নিয়ে অনেক কথা থাকলেও ভ্যাল যে ব্রুস ওয়েইন চরিত্রে নিজের সেরাটা দিয়েছিলেন, এমনকি তার ব্যাটম্যান অনেক বেশি রক্তমাংসের মানুষ ছিল, সব ক্রিটিকই সেটা মেনে নিয়েছিলেন। এবং এর পরপরই Batman-এর পরবর্তী ম্যুভি না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভ্যাল বেছে নেন The Saint.
The Saint হচ্ছে Leslie Charteris-এর ১৯২৮ সাল থেকে লেখা বিখ্যাত গল্প-উপন্যাস সিরিজ, যেখানে সাইমন টেম্পলার নামের একজন রবিনহুড টাইপ চরিত্র ধনীদের থেকে সম্পদ নিয়ে গরিবের মাঝে বিলিয়ে দেয়। ১৯৩৮ সাল থেকেই হলিউডের রূপালি পর্দায় বারবার ফিরে এসেছে তার গল্প, ফিল্ম বা টিভিসিরিজ হয়ে। George Sanders বড়পর্দায় আর Roger Moore ছোটপর্দায় স্মরণীয় করে রেখেছেন তাদের পোট্রেয়াল দিয়ে। সেই বিখ্যাত চরিত্রে এমনই বাঘা বাঘা অভিনেতাদের পরে নতুন করে কিছু দেওয়ার যে বিশাল রিস্ক, সেটাই বুঝি ভ্যাল নিতে চেয়েছিলেন। এবং আমার কাছে তিনি দুর্দান্ত রকম সফল। শুরুর প্যারাতেই বলেছি কীভাবে বারোটা ভিন্ন ভিন্ন মুখোশের আড়ালে থেকেও একজন স্বপ্নদেখা তরুণের দেহে আবদ্ধ আজন্ম এক অনাথ কিশোরের অভিব্যক্তি, আহা!
শেষবার ভ্যাল কিলমারকে যখন Top Gun Maverick-এ বড়পর্দায় দেখলাম, গলা ছেড়ে চিৎকার করেছিলাম। সেই সাথে চোখ ভিজে গিয়েছিল তাকে বিদায়ের সময় হয়ে আসছে বুঝতে পেরেই। থ্রোট ক্যান্সারে গলার স্বর প্রায় পুরোটাই হারিয়েছেন ততদিনে। কিন্তু সে-ই স্টাইলিশ ব্যাডঅ্যাস ভ্যাল কিলমার হারায়নি এক চিলতেও। যৌবন-আটকে-রাখা Tom Cruise-এর সামনেও তাকেই বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। চোখের পানি আটকে রেখেছিলাম তাকে আবার দেখতে পাওয়ার আবেগের। কিন্তু যখনই ভ্যাল কথার পরিবর্তে স্ক্রিনে টাইপ করলেন তার সংলাপ আর আমরা যখন সেটা দেখলাম, পানি আর আটকানো গেল না। বিদায় বুঝি তখনই নিয়ে নিয়েছিলেন প্রিয় ভ্যাল কিলমার…লিখেছিলেন —
❝It’s time to let go.❞
আজ শেষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো মাত্র, বোধহয়…
Rest in Peace Val ‘The Saint’ Kilmer
০২ এপ্রিল ২০২৫
- মেঠোসুর কলরব : আবহমানের উৎসব || রূপকার - May 17, 2025
- মেঠোসুর আনন্দযাত্রা : গানময় এক সংবেদনশীল বাংলাদেশ || বিমান তালুকদার - May 9, 2025
- মাড়া || সুশান্ত দাস - May 3, 2025
COMMENTS