২০০০-অনোয়ার্ডস বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিকের ডেভেলপমেন্ট

২০০০-অনোয়ার্ডস বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিকের ডেভেলপমেন্ট

শেয়ার করুন:

 

২০০০-অনোয়ার্ডস বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিক নিয়া আমার কোনো কথাবার্তা কখনো বলা হয় নাই। এর কারণ অন্যকিছু নয়, স্রেফ সংগতিহীনতা। মানে এক্স্যাক্টলি ওই বছর থেকেই ধীরে ধীরে অ্যালিয়েন হয়ে যেতে থাকার শুরু হয় আমার। বছর-দুয়েকের মধ্যেই ঢুকে যাব চাকরি ইত্যাদিতে এবং এতকালের স্বাভাবিক ছন্দে একটা দুর্গতির শুরু হয়ে গেছে বুঝতে বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এর ফলে ব্যান্ডমিউজিক কেন, অনেককিছুরই ঠিকঠাক ট্র্যাক ফলোআপ করে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। ‘শিরোনামহীন’ আগাগোড়া শোনা হয়েছে, একদম পয়লা অ্যালবামের ‘আর্টসেল’ শোনা হয়েছে, এছাড়া এমনকি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ‘মেঘদল’ ইত্যাদি ব্যান্ডের এফএমবাহিত দুয়েকটা নাম্বার ছাড়া গান বিশেষ শোনা অনেকদিন পর্যন্ত হয়ে ওঠে নাই।

ঠিক যে এই টাইমফ্রেমের ভিতরটায় পা রাখবার যার যার জায়গা করে নেবার স্ট্রাগলটা আমাদেরে করে যেতে হচ্ছিল। সময়কাঠামো দুইহাজার-উত্তরকাল। পঁচিশে এসে দাঁড়াই, দুইহাজারপরের পঁচিশে, হিসাব করে দেখি ফাকিং টোয়েন্টিফোর কমপ্লিট ইয়ার্স! দুই যুগের অধিক! গ্যন! সবচেয়ে বড় অর্জন সবচেয়ে বড় বিসর্জন, ব্যক্তিগত জীবনে, এই সময়টায়। এইখানে এই পঁচিশ বছরেই স্ফীত হয়ে ফের ক্ষীণ হয়ে আসে ব্যক্তিগত শ্রবণরেখাটি, ক্ষীণ হয়ে আসে আমার গানশোনাশুনি। সিনেমাদেখা বা বইপড়া, তা-ও, আস্তেধিরে স্তিমিতস্রোতা হয়ে আসে স্বচ্ছতোয়া সবই।

কিন্তু শুনব, অচিরেই সিলেক্টেড কিছু ব্যান্ডের গান জড়ো করব প্ল্যান করছি প্রতি বছর। এবার নতুন বছরে এইটা করেই ফেলব যেভাবেই হোক। আর এই ‘শিরোনামহীন’ ছাড়া আগাগোড়া ধারাবাহিক কাউকে না-শোনার কারণে লেখায় ব্যাপারগুলো আসে নাই। ও হ্যাঁ, তাহসান-জন একত্র থাকা পর্যন্ত ‘ব্ল্যাক’ শোনা হয়েছিল। ‘জলের গান’, যদি হিসাবে নিতে চান, শুনেছি; ‘চিরকুট’ আশা করি অত হিসাবনিকাশের পর্যায়ে পড়ে বলবেন না, আর শোনাও হয় নাই টিভিশো ছাড়া ওদের মিষ্টদ্রব্যগুলো।

তবে এইটাও মনে হয় আমার হামেশা যে, ব্যান্ডমিউজিকে এবং অন্যান্য সর্বক্ষেত্রে এই সময়টাতেই প্রাযুক্তিক পটবদলের কারণে একটা ক্রান্তির অধ্যায় যাচ্ছিল। অন্তর্বর্তীকালে ক্যাসেটের জায়গায় সিডি এসে যায়, এর সঙ্গে চেনাজানা হতে হতে এইটা-ওইটা পার হয়ে একসময় সাউন্ডক্লাউড বা আরও সহস্র নেটিজেনিক অবারিত দরোজা যায় খুলে। এগুলোর সঙ্গে কোপআপ করে শ্রবণধারাবাহিকতা রাখতে পারিনি। এখন যখন দেরিতে হলেও প্রযুক্তির সঙ্গে সড়গড় হয়েছি কিছুটা, পেছনে চেয়ে দেখি প্রায় একদশকের অতিকায় পাহাড় গড়ে উঠেছে। না-শোনা গানের। গড়ে উঠেছে গ্যাপ, দূরত্ব, সংগীতশ্রবণ ও অন্যান্য ভোগেন্দ্রিয় সবখানে।

এছাড়াও ব্যান্ডঅ্যাক্টিভিটির ব্যাপারটা আন্ডারগ্রাউন্ডের নামে এই সময়টাতেই কিছুটা হলেও শ্রোতাবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল কি না, আজকাল এ-নিয়া ভাবতে প্ররোচিত হচ্ছি। নিশ্চয় খেয়াল করলে দেখবেন, ওপেন এয়ার কন্সার্টের আয়োজন এই সময়টাতেই স্তিমিত হতে শুরু করেছে, কিংবা হলেও খুব বেশি স্পন্সরশাসিত এবং পশ হয়ে যাচ্ছে, ব্যান্ডমিউজিশিয়্যানরা রাতভর টিভিস্টুডিয়োগুলোতে এক-ধরনের এক্সপোজার শো করে বেড়াচ্ছেন, যে-কারণে একটু হলেও শুরুতেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছি হয়তো কোনো-এক নতুন মিউজিশিয়্যানের প্রতি। মিউজিশিয়্যান এবং কবিরা যতদিন ঈশ্বরের মতো অমূর্ত ভৌতিক রাখতে পারেন নিজেকে, ততদিন ব্যাপারটা ভালো উভয় তরফেই; এইটা আমার মনে হয় কেন যেন, বলতে পারব না, অ্যানিওয়ে।

আরেকটা ব্যাপার। যতই আমি এই সময়ের, বর্ণিত ২০০০-পরবর্তীকালের, গান শুনি না কেন, ধরা যাক আপনার মতো সমসাময়িক গানের উৎস হতে উৎসারিত শ্রোতার লেভেলে রিসিভ করতে পারব না নতুনকালের গানটাকে। যতদূর পারা যায় নিজের রিসিভারটা উদার রাখতে পারি, কিন্তু ঘুরেফিরে আমি আমার প্রাইম টাইমের স্মৃতির কাছেই নতজানু হবো। এইটা একইসঙ্গে মানুষের সীমা এবং সম্ভাবনাও। গবেষক হলে, ব্যক্তিনিরপেক্ষ গবেষক হলে অবশ্য, ব্যাপারটা আলাদা। আমি লিখি দেখবেন যে একপ্রকার স্মৃতিনির্ভর লেখা। আর স্মৃতিতে তো মানুষের কৈশোর এবং সূচনাতারুণ্যেরই জয়জয়কার। সেকন্ডারি সোর্স থেকে রসদ নেবার মতো ধৈর্যশীল ও সশ্রম হওয়া আমার পক্ষে মুশকিলের, আর বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের ক্ষেত্রে এর সুযোগও অতি অল্পই। কাজেই স্মৃতিই ভরসা।

যা-হোক, আমি নিজেও জোর তাগিদ বোধ করছি ইদানীং যে আলোচ্য সময়খণ্ডের ব্যান্ডগান শিগগিরই শোনা দরকার; এইটা করতে পারলে আমার পরিকল্পিত কাজগুলোও অন্যতর ঔজ্জ্বল্য পাবার সম্ভাবনা থাকে। এই সময়ের প্রোমিনেন্ট কয়েকটা কাজের হদিস তো করে ফেলা গেছে এরই মধ্যে, বেশকিছু আরও করতে হবে। ‘মেঘদল’, ‘নেমেসিস’, ‘মনোসরণি’, ‘ইন্দালো’, ‘সহজিয়া’ … এইগুলিরই নাম শুনি; কিন্তু আর কিছুই কি নাই? তা, আছে না, আরও কত!

গত দুই দশকে হিপহপ ধারায় বাংলাদেশের গানে যে-একটা আড়মোড়াভাঙা আলোড়ন লক্ষ করা যায়, মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় এর প্রজেকশন ও সসম্মান প্রেজেন্স অতীব নগণ্য। মুশকিল হলো, স্টুডেন্টলাইফের পরে লাইফস্টাইলের এস্ট্যাব্লিশমেন্টাল কারণে এমন কিছু অনপনেয় নকশা লাইফে এসে যুক্ত হয় যে রকের ধক ধরবার মোমেন্টামগুলো অন্তর্হিত হয়ে যায় ব্যক্তির লাইফ থেকে। যে-জিনিশ লিখতে চাইছি সেজন্যে রেগ্যুলার লিসেনিং, কন্সার্ট অ্যাটেন্ডিং এমনকি হেডব্যাঙ্গিং সমস্তই দরকার। অতি আবশ্যিকভাবে দরকার উৎকর্ণ শোনা। সামাজিক রাষ্ট্রিক ব্যক্তিক সমস্ত মাধ্যমের অ্যান্টেনায় কান পাতিয়া রাখা। আর রিলেন্টলেসলি নিরলস অভিজ্ঞতা টোকা।

যা এখন লিখতে চলেছি তা আগে লেখা গেলে এর জজবা আলাদা রকমের হতো, বলা বাহুল্য। ২০০০-অনোয়ার্ডস বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিকের ডেভেলপমেন্ট, অগ্রগতি ও অনগ্রসরতা বিবেচনায় নিয়া যাচিত উন্নতি অবনতি, কোথায় কেমন কট্টুক হলো, বুঝতে একটু সুস্থির বসবার দরকার এইবার। একটা ছোট্ট কথা শুধু ফোকর দিয়ে বলে রাখবার, কথাটা এ-ই যে, প্রত্যেক জেনারেশনের একটা বোধনকাল থাকে, ব্যক্তির স্বীকারোক্তি বা সেল্ফস্টেইটমেন্ট বিবেচনায় নিলে, আমি নিজে যে-জেনারেশনে বিলং করি, যে-জেনারেশনে আমার উন্মেষ, চক্ষুউন্মীলন, বোধন ও বিকাশ, সেটি নব্বই। দৃষ্টি ফোটা মাত্র সম্মুখে ও চারিপাশে অ্যাভেইল্যাবল যা পেয়েছি, যা আমায় দৃষ্টিপ্রসারে হেল্প করেছে, সেসবের প্রতি ফ্যাসিন্যাশন শুধু নয়, সেসবের ইম্প্যাক্ট আমার মধ্যে আছে বলেই নয়, সেই সময়টাকে লেখার ভিতর দিয়ে দেখতে দেখতে নিজের অস্তিত্বের ফ্যুটপ্রিন্টগুলারে সবচেয়ে ভালোভাবে ভিজিবল করা যায়। সেই ভিজুয়ালাইজেশন আরেকটু সুপরিস্ফুট করা গেলে এর পরবর্তী, অর্থাৎ মিলেনিয়াল অনোয়ার্ডস, টাইমটার লগে আমার অস্তিত্বের সংযোগ ও বিয়োগের বিন্দু ও বক্ররেখাগুলি নিরীক্ষণ করবার ফুরসত মিলত।

বসবার কথায় ইয়াদ হয় মাহমুদ দার্বিশের বাক্য। প্রতিভা কোথায় থাকে, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতেসিলেন, পশ্চাদ্দেশে। লেখকেরা জানে, চেয়ারে বসতে হয়, লেখাটা পাড়তে চাইলে চেয়ারে বসতেই হবে, এছাড়া লেখা পাড়ার উপায় নাই, ডিম ও অন্যান্য নিউট্রিশাস নানা জিনিশ পাড়া সম্ভব হলেও। দৌড়ের উপরে যে-জীবন, দশানন রাক্ষস ক্ষিধের, লেখায় সেখানে বেশিক্ষণ বসে এবং লেগে থাকা নামুমকিন প্রায়।


ফেসবুকের নানান যন্ত্রণার মধ্যে এইটা আরেকটা যে অ্যালগরিদম পরিবর্তন করে তারা আপনার কমফোর্ট ডিসকমফোর্ট বিবেচনায় না নিয়া। আপনি নোট ফর্মে একটা সময় লিখতে অভ্যস্ত হলেন, নোট দিলো তামাদি ডিক্লেয়ার করে। একসময় জানতাম এইখানে এই নয়া প্রাযুক্তিক বন্দোবস্তব্যবস্থাপনায় কিছুই নিখোঁজ হবে না, হারাবে না। তারপরে টের পেতে পেতে ঢের দেরি হয়ে যায়, টের পাই, চিরকেলে সেই ধাপ্পাই। প্রিজার্ভড না-রাখলে দেখি সবই হারায়া যায়। প্রিজার্ভ রাখা মানে অনলাইনে আর্কাইভড নয়, রাখতে হয় অফলাইনে। অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলগুলায় একহপ্তা আগের টাইমলাইন ঘেঁটে দেখা যায় কিছু-না-কিছু খোয়া যায়। এটাওটা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের বাহানায়। কেবল ফোটোগ্রাফ আর দুনিয়ার আগড়মবাগড়ম ফানআইটেমগুলো দেখি চিরঅমর! কবে যে আপন খোমাখানাও খোয়া যায় আইডি থেকে, খেয়ে ফেলে ফেসবুকমালিক উইদাউট প্রায়োর নোটিস, আল্লা জানেন। হারালে হারাবে, খোয়া গেলে তা যাবে, যা থাকবে তা-ই মস্ত। এই চিন্তায় নিজেরে সান্ত্বনা যোগাই। তবু মার্ক জাকার্বাগের নিকট এ-মর্মে মেমোরেন্ডাম একটা পাঠানো যায় নিশ্চয়। দেখি ভেবেচিন্তে। ফেসবুকমালিকের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাবার রেজাল্ট ও কন্সিক্যুয়েন্সেসগুলো খতিয়ে দেখে এরপর স্মারকলিপি লিখতে বসব। বলবার কথাটা আপাতত এই যে, এই নিবন্ধের মূল কথাভাগ রচিত হয়েছিল শফিউল জয়ের সঙ্গে একটা আলাপের সূত্রে, ভেঙে ভেঙে, প্যারা বাই প্যারা আকারে, ইনবক্সে। ব্যান্ডসংগীত নিয়া, বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিঘাত নিয়া আলাপিত রচনাটি খণ্ডে খণ্ডে লেখার কাজটা চালু রইলেও অতগুলো বছরে এখনও সমগ্রের অভিমুখ ও অবয়ব লোকেইট করা সম্ভব হয়নি। হলে, কোনোদিন যদি হয়, ব্যক্তিগত টোনের এই নিবন্ধটিও তখন কোথাও সেখানে কন্ট্রিবিউট করবে। এই আশা ব্যক্ত করছি নিবন্ধকাল থেকে একদশক দূরে এসে এই দ্বিসহস্রপঁচিশের এপ্রিলের উত্তীর্ণ সন্ধ্যায়।

জাহেদ আহমদ (রচনা ২০১৪  পরিমার্জনা ২০২৫)

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you