বিরুলিয়ায় মেঘদল  || শফিউল জয়

বিরুলিয়ায় মেঘদল  || শফিউল জয়


গতকাল মেঘদলের লাইভ শো-তে গেলাম। প্রিয় গানের দল মেঘদলের লাইভ-শো-র অপেক্ষা করছিলাম বহুদিন হলো। সন্দেহ নাই যে যিড়যিড়ের (না কী ঝিরঝির? ইংরেজি আর বাংলা বানানের সামঞ্জস্য না থাকার কারণে একটু দ্বিধায় — আসল উচ্চারণটা কী হবে!) এই ধরনের আয়োজন প্রশংসনীয়। বাংলাদেশি মিড-রেইঞ্জের পপুলার ব্যান্ডগুলার সলো শো আয়োজন করার যে হিম্মত তারা দেখাচ্ছে, তাতে লাইভ-শোয়ের সুদিন ফিরবে বলে অনেকেই হাঁকডাক ছাড়ছেন। হিপি-ডিপি মেঘদলশ্রোতাদের ভিড়ে আমি অতটা আশাবাদী না হলেও তাদের প্রাপ্যটা না বলাটা নাফরমানি হবে। তবে এই লেখাটা মূলত মেঘদলের পারফর্মেন্সের একটা ক্যাজুয়াল খতিয়ান।

এই আদেখলা ছোট্ট রিফ্লেকশনটা শুরু করার আগে আমি মেঘদলের দুইজন ব্যান্ডমেইটের কথা উল্লেখ করতে চাই। মেঘদলের লিরিক্যাল এবং ইন্টেলেকচুয়াল এক্সপোজারের কারণে যাদের নাম শ্রোতাদের মেঘদল এক্সপেরিয়েন্সের সাথে খুব একটা রেজোনেইট করে না : তানভীর দাউদ রনি এবং আমজাদ হোসেইন। যেহেতু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসমীপে এইটুকু বলার এখতিয়ার রাখি — মেঘদলের ফ্যান-ফলোয়ারদের সংগীতবিষয়ক অভিজ্ঞতার কূপমণ্ডূকতার কারণেই তারা সম্ভবত ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না যেই সাউন্ডটা ফাইন্যালি তাদের কানে পৌঁছায় তাতে আমজাদ হোসাইন এবং তানভীর দাউদ রনির অবদানটা কী (এবং আলবৎ রাশীদ শরিফ শোয়েব)। এবং সেই হেতু তারা আমজাদ হোসেইন বা তানভীর দাউদের অবদানটাও আইডেন্টিফাই করতে পারেন নাই এই পর্যন্ত, ঠিকঠাকমতো। তাদের প্রাপ্যের অংশ বোঝায়া দেয়ার একটা দায় থেকেও এই এলোমেলো রিমার্কগুলা।


তানভীর দাউদ রনির কথা এই ছোট লেখায় বলার সুযোগ খুব একটা নাই। বাট ড্রামার মিস্টার হোসেইনের কথা একটু টাচ দিয়ে যেতে চাই। মেঘদলের প্রথম অ্যালবাম থেকে দ্বিতীয় অ্যালবামের যে হিউজ উত্তরণ, আমার ধারণা সেইখানে ইন্সট্রুমেন্ট্যালি সবচেয়ে ক্রুশ্যাল রোলটা ছিল আমজাদ হোসেইনের। প্রথম অ্যালবামের শ্যাবি ড্রামিং থেকে মেঘদলের যে কমপ্যাক্ট সাউন্ডটা দ্বিতীয় অ্যালবামে আবিষ্কার করা যায়, সচেতন শ্রোতামাত্রই জানেন — আমজাদ হোসেইন সম্ভবত তার চল্লিশ শতাংশের মালিকানা দাবি করতে পারেন। মিস্টার হোসেইন লাইভেও ফাকিং ফ্ল-লেস এবং একটা ড্রামার ব্যান্ডকে কতটা পরিণত করতে পারে, উনি সেটার এমবডিমেন্ট!

যা-ই হোক, গতকালের শো নিয়ে কিছু কুইক রিমার্ক দেয়ার আগে মিস্টার হোসেইনের কথা বলার কারণ ছিল তার স্টেইজ-পার্সোনা এবং ইম্যাকুলেট পারফর্মেন্স। পশ্চিমা ব্যান্ডসংগীত আমরা যতটা শুনি, ততটাই যে দেখি — এটা স্বীকারোক্তিতে লজ্জার পরিমাণটা আনুপাতিক হারে কমে গেছে অনেক; বিশেষত সেই-সকল বুমারমানসিকতার ডাই-হার্ড ক্ল্যাসিক আর সিন্থ রক ফ্যানেরাও আস্তে আস্তে বুঝতে পারছেন যে, পশ্চিমের রকস্টারদের যে প্রফেটিক ইনফ্লুয়েন্স, তা শুধু মিউজিকের কারণে না।


এবার মূল আলাপে ঢোকা যাক। একক শো করার জন্য যে পরিমাণ এনার্জি আর প্র্যাক্টিস লাগে, মেঘদলের আদারওয়াইজ মেইজর প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত মেম্বাররা যে সেগুলা পাশ কাটায়া বাস্তবায়ন করতে পারছেন, তাতে বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় নাই। তবে বিস্ময় আর ভালোলাগা নিয়ে বলতে চাই না কারণ মেঘদল ব্যান্ড হিশাবে এখন স্ফীতির মুখ দেখতেছে। আমি বরং দুই-একটা ভালো না লাগা নিয়ে বলতে চাই। বিরুলিয়াতে কী ভালো লাগল না।

৩.১
স্টেইজ, লাইটিং, সেট ডিজাইন ইত্যাদি একদমই উপভোগ্য ছিল না। মেঘদল ব্যান্ডের যে লজিস্টিক্স আছে, বিশেষ করে মেজবাউর রহমান সুমনের মতো একজন সদস্য থাকার পরেও যদি তার রিফ্লেকশন এমন পুওর হয় — তাহলে মেঘদলের শিবু কুমার শীলের অডিও এবং ভিজ্যুয়ালের ওপর সমান গুরুত্ব দেয়ার কথাটা একটু গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে (প্রথম আলোয় দেয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য)। দুই-একবার স্পটলাইট ফেলে শিবু কুমার শীলকে যে অন্ধ করে দেয়া হয় নাই, তার জন্যে লাইটিং টিমকে ধন্যবাদ, যদিও সেটার বেশ চ্যান্স ছিল বলে মনে হইছে। যদি এইখাতের অর্থনীতির কথা চিন্তা করি, তাহলে বাংলাদেশি একটা ব্যান্ড হিশাবে এই এক্সপেকটেশন্সগুলা অন্য কোনো ব্যান্ডের কাছে থেকে রাখার ইচ্ছা পোষণ করার খুব একটা উপায় নাই। কিন্তু মেঘদলের জন্যে এই সেক্টরে যা করা তুলনামূলকভাবে সহজ, অন্য অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডের জন্যে সেটা অনেকটাই কল্পনাতীত (এসো আমার শহরে, এ হাওয়া দ্রষ্টব্য)।

৩.২
কয়েকটা হাল্কাপাতলা এবং দুই-একটা মেইজর টেকনিক্যাল স্লিপ ছিল। টেকনিক এবং স্কিল বরাবরই আইডিয়ার থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু মেঘদলের অ্যাম্বিশ্যান নিশ্চয়ই দেড়-দশকের ভেতর উত্থান-পতনের পাট চুকায়া হারায়া যাওয়া না। ফলে, একটা টোট্যাল ব্যান্ড হিশাবে মেঘদল এইখানে আরও কাজ করার সুযোগ রাখে। মেঘদল লাইভে যে উন্মাদনা ক্রিয়েট করে তাদের কাল্ট-ফলোয়ারদের ভিতর, সেখানে আমার এই অব্জেকশনের খুব একটা দাম নাই। মেঘদল যখন পাঁচটা গান গাইতে স্টেইজে উঠত, তখন যত মিস্টেইক্স থাকত, দশ-পনেরোটা গানের একক কনসার্টেও অলমোস্ট সেই সংখ্যক ভুল। তার মানে নিউমেরিক্লিই মেঘদলের এফিশিয়েন্সিটা বোঝা যাইতেছে। কিন্তু মেজবাউর রহমান সুমনের কাছে থেকে আরও সাবলীল পারফর্ম্যান্স আশা করা যাইতে পারে।

তবে, অন্যদিক থেকে, আমি মেঘদলের লাইভ-শো দেখছি বেশ আগে। তখনকার যে হরিবল সাউন্ড আউটপুট শোনার এক্সপেরিয়েন্স ছিল, সেটার থেকে গতকাল মোটামুটি বেহেশতি সাউন্ড ছিল৷

৩.৩
আমজাদ আর শোয়েব মেইনলি মেঘদলের পাওয়ারহাউজ — যেটা এমজি কিবরিয়া কমপ্লিমেন্ট করে (দুর্দান্ত ছিল এইজন)। রাশীদ শরিফ শোয়েবের একজন সহকারী গিটারিস্ট থাকলে (স্টেইজের একটা আলোহীন ননডেসক্রিপ্ট কোণায় যাকে দাঁড়া করায়া রাখা যাবে) গিটারটা আরেকটু আরামসে বাজাইতে পারতেন সে আর মেঘদলও তার ফ্যুল লাইভ পোটেনশিয়ালটা ইউটিলাইজ করতে পারত। কোরাসে যাওয়ার সময় আর কোরাসের পর বারবার টোন চেইঞ্জের তড়িঘড়িটাও একটু কমবে (যার জন্যে কিছু জায়গায় কম্প্রমাইজ করতে হইছে বলে আমার ধারণা। আমার কাছে ভিডিও নাই, কিন্তু মেমরি যতখানি সার্ভ করতেছে সেটার উপরে ভিত্তি করে মনে হচ্ছে আকাশ মেঘে ঢাকা-তে একটা গিটারপিস বাদ দেয়া হইছে কি এই কারণেই?)। ইম্প্রভাইজেশনের বাসনা থাকলে আরেকটা গিটারিস্ট ম্যান্ডেটরি হয়ে যাওয়ার কথা (শোয়েব ভোকালিস্ট হিশাবে লাইভে মাই গড!-টাইপ কনফিডেন্স এক্সুড করে, অ্যাবসোলুট লাইভ ম্যাটেরিয়ল)। কিন্তু মায়া সাইকেল-এর ড্রিমি সাউন্ডস্কেইপটা লাইভে একদমই আসে নাই। এটা পারফর্মারদের দোষ না, জাস্ট সাউন্ড অ্যারেইঞ্জমেন্টটা! ভিজ্যুয়ালের থেকেও মেঘদলের জন্যে এখন গুরুত্বপূর্ণ লাইভের ঠিকঠাক টেকনিশিয়ান কাম ইঞ্জিনিয়ার হায়ার করা।

৩.৪
তানভীর দাউদ রনিকে লাইভসাউন্ডে আরও ফ্রন্টলাইনে আনা হউক। স্পেশালি না বলা ফুল-এর মতো গানে — যেটা গতকাল হয় নাই। এ হাওয়া-র মতো গান যত আসতে থাকবে, আমার বিশ্বাস তানভীর দাউদের গুরুত্ব মেঘদল আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে।

৩.৫
শিবু কুমার শীলের কথা নতুন করে বলার তেমন কিছু নাই। ওয়াইনের এইজিঙের মতো তার পারফর্মেন্স। সৌরভেরও।


আমার শেষ পয়েন্টটা — মেঘদল কেন তবু মন  গাইলো না?

  • ব্যানারে ব্যবহৃত ছবির শিল্পী সাব্বির আকরাম

গানপারে মেঘদল
শফিউল জয় রচনারাশি

COMMENTS

error: