তথাকথিত পাকিস্তানি সংস্কৃতির অজুহাতে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা কখনো স্তিমিত হয়নি। বরং সরকারি প্রচারমাধ্যমগুলো রাজনীতিপ্রচার ও সংস্কৃতিচর্চায় কোনোরকম ভূমিকা পালন করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নইলে ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্ভব হলো কী করে? সুস্থ সংস্কৃতিচর্চায় সরকারি রক্তচক্ষু বিঘ্নের সৃষ্টি তো করতে পারেইনি বরং শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের রুখে দাঁড়াবার জন্য প্ররোচিত করেছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে পাশ্চাত্যের ব্যান্ড মিউজিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা বেড়েছে তারচেয়ে অনেক গুণ বেশি। রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করা অথবা ছোট করা এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত মানুষের সমর্থন পায়নি, এখনও পায় না।
এটা রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিশেষ কোনো অনুরাগ বা ভক্তির নিদর্শন নয়। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রধান আকর্ষণ ব্যক্তির কাছে। এই আধুনিক ব্যক্তি যে-সমাজে গড়ে ওঠে, আমাদের দেশে সেই সমাজ এখন নির্মীয়মাণ। নানা কারণে এ-সমাজে ব্যক্তির বিকাশ স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক হচ্ছে না। এই সমাজগঠনের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বনির্ভর রাষ্ট্র। কিন্তু বিদেশি সাহায্যসংস্থাসমূহের রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ, তাদের পরোক্ষ উসকানিতে ধর্মান্ধ অপশক্তির উৎপাত প্রভৃতির কারণে রাষ্ট্র যেমন শক্ত হতে পারে না, ব্যক্তির স্বাভাবিক বিকাশেও তেমনি পদেপদে বিঘ্ন ঘটে।
রবীন্দ্রচর্চায় মাঝে মাঝে যে বিঘ্নের সৃষ্টি করা হয় তার কারণ কিন্তু তথাকথিত পাকিস্তানি সংস্কৃতি নয়। বরং সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট ধর্মান্ধদের উৎপাত। এই উৎপাত কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন এইসব ইতর লোকদের বিরুদ্ধে একটু সংঘবদ্ধ হলেই এরা গর্তে ঢুকে পড়ে।
সিংহভাগ শিক্ষিত মানুষের রাজনৈতিক মতামত যা-ই হোক-না কেন, একটি আধুনিক সমাজের সদস্য হওয়ার জন্য তারা উদগ্রীব। সুতরাং পঙ্গু হোক, রুগ্ণ হোক, ব্যক্তির বিকাশ এখানে কোনো-না-কোনোভাবে ঘটেই চলেছে।
এই ব্যক্তির একান্ত অনুভব সবচেয়ে বেশি সাড়া পায় রবীন্দ্রসংগীতে। তাই এই পঙ্গু বা রুগ্ণ ব্যক্তিটিকে বারবার যেতে হয় তাঁর গানের কাছেই।
রবীন্দ্রনাথ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যে-ব্যক্তিকে তিনি শক্তসমর্থ মানুষ। আমাদের পঙ্গু ব্যক্তি রবীন্দ্রসংগীতে নিজেকে শনাক্ত করতে চায় শক্ত মানুষ হিসেবে। হয়তো এই দেখাটা ভুল কিন্তু এই ভুল দেখতে দেখতেই সে একদিন শক্ত একটি ব্যক্তিতে বিকশিত হতেও তো পারে। তখনই গড়ে ওঠে ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ববান মানুষ দায়িত্বশীল, সে কেবল নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ থাকতে পারে না। তাই তার চারদিকের মানুষের প্রতি সে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ওঠে। রাশিয়ার চিঠিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণে কোনো ভ্রান্তি ছিল না। অসাধারণ শক্তিমান মানুষ যে-কোনো জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও মঙ্গল দেখে সন্তুষ্ট হতে বাধ্য।
বাংলাদেশেও ব্যক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে। এবং শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে এই গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রবীন্দ্রনাথের গান মানুষকে বিপ্লবের দিকে উদ্বুদ্ধ করবে না। কিন্তু শক্তসমর্থ ব্যক্তিগঠনে রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষমতা অসাধারণ। শক্ত মানুষের সমবেত শক্তি মানববিরোধী অচলায়তন ভাঙার অন্যতম প্রেরণা তো বটেই।
লেখকের একমাত্র প্রবন্ধবই ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ থেকে লেখাটা এইখানে পুনর্মুদ্রিত হলো। বইয়ের প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত
… …
- শরৎরাত্রিতে || আনম্য ফারহান - September 23, 2023
- হাওর সিরিজ || শামস শামীম - September 23, 2023
- জনমানসে বিরাজিত সাংস্কৃতিক সংঘাত ও মাতিয়ার রাফায়েলের কবিতা || আহমদ মিনহাজ - September 23, 2023
COMMENTS