রনজিৎ রক্ষিত — এ নামটি উচ্চারিত হলে চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে অনেক প্রতিষ্ঠানের ছবি। মনে পড়ে যায় নানান আন্দোলন-সংগ্রাম, কত চড়াই-উৎরাই! ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চালু প্রস্তাব উত্থাপনের (১৯৪৮ সালে) তপ্ত ভূমিতে রনজিৎ রক্ষিত ভূমিষ্ট হয়ে ৫২-তে এসে রাজপথ চিনে নেন। মধ্যষাটে এসে আইয়ুববধের পুরাণ রচনা করতে গিয়ে কারাবরণ করেন। ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি মডেল হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানশিক্ষক, ৭১-এর সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা রনজিৎ রক্ষিত তাই আজ আর কোনো ব্যক্তির নাম না, একটি প্রতিষ্ঠানের নাম — এদেশের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের নাম।
এক্ষণে এসে রনজিৎ রক্ষিত নামের প্রতিষ্ঠানের অথবা সংগ্রামের নেপথ্য প্রাণসঞ্চারণী কারিগররূপে যাঁদের মানতেই হয়, সে-দুই কুশীলব হলেন — ‘বৃটিশ খেদাও’ আন্দোলনে মাস্টারদার অনুগামী ১৫বছরের বৃটিশ কারাবন্দী পিতা যতীন্দ্র মোহন রক্ষিত এবং মহাত্মা গান্ধীর সহযাত্রী তৎকারণে ৬ মাসের গৃহান্তরীণ মাতা রাণী রক্ষিত। সালাম জানাতে হয় স্বরাজ প্রতিষ্ঠায় এই দুই সংগ্রামী বিপ্লবীর প্রতি। যোগ্য পিতামাতার যোগ্য সন্তান। ধন্য তাদের তপস্যা। এ-সঙ্গে ভুলব না, ভুলে যেতে পারব না, তাঁর সহধর্মিনী দীপ্তি রক্ষিতের আন্তরিক প্রশয়। তারপর আছে চারপাশের নানান স্বজন। বন্ধুবৎসল মানুষটি সকল পরিজনের সহজ-সরল ধারাবাহিক সহমর্মিতায় আমৃত্যু নিবেদিত ছিলেন সত্য ও সুন্দরের তপস্যায়। ফলে সৃজনে সক্ষম হয়েছেন ‘আলোর নিচে সেই অপূর্ব আলো’।
রনজিৎ রক্ষিতের মধ্যষাটের কারাবরণ মনে করিয়ে দেয় তাঁর পথচলা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। পাথর কেটে কেটে তিনি রাজপথ নির্মাণ করেছেন। এ-সময় তাঁর হাতের তালুতে, পায়ের পাতায় কিংবা হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়, তা কোনো কোনো পথিক দেখেছে, আবার কেউ দেখেনি। রণজিৎ রক্ষিত এই দেখা-না-দেখার কোনো তোয়াক্কাই করেননি। তাই তিনি সপ্তাহান্তে প্রাণের টানে ছুটে গেছেন জন্মদাগ স্পর্শ করতে কানুনগোপাড়া গ্রামে। সারারাত, সারাদিন কানুনগোপাড়া বান্ধব পাঠাগারের নাটকের মহড়া শেষে পরের দিনান্তে আবার শহরে ফিরে এসেছেন সদাশয় এই আদর্শ শিক্ষক, যাতে সপ্তাহ শুরুর দিনে বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাহত না হয়। তিনি নাট্যচর্চা বা সংস্কৃতিচর্চা করতে গিয়ে আদর্শ শিক্ষক অথবা পারিবারিক দায়িত্ববোধে বিপত্তি ঘটতে দেননি। ফলে তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক প্রথম নাট্য উৎসব, প্রথম জাতীয় আবৃত্তি উৎসবে অংশগ্রহণ এবং জাতীয় শিশু আবৃত্তি উৎসবে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করা। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির নির্বাচিত সহ-সভাপতি।
শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা আর একাগ্রতার কারণে সত্তর দশকের শেষপ্রান্তে এসে মিলন চৌধুরী রচিত বাংলাদেশে প্রথম পথনাটক ‘যায় দিন ফাগুন দিন’-এ অভিনয়ের জন্য ‘গণায়ন’ অন্যতম কুশীলবরূপে তাঁকে বেছে নেয়।
রণজিৎ রক্ষিতের গণতান্ত্রিক আদর্শবোধ কিংবা সাংস্কৃতিক মনন কখনও পারিবারিক জীবনবোধ বা কর্মজীবনের বাধা হিসাবে দাঁড়ায়নি, সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিপূরক হিসাবে কাজ করেছে। তাই তিনি মঞ্চে, বেতারে কিংবা টেলিভিশনে নিয়মিত আবৃত্তি, উপস্থাপন ও অভিনয়ে অংশ নিতে পেরেছেন। প্রায় পাঁচ দশক (১৯৬৬ সাল হতে) সময়কাল বেতারে নিয়মিত অভিনয় করতে পারার গৌরব বর্তমান সময়ে খুবই বিরল।
সাংস্কৃতিক চর্চার বিশাল পরিমণ্ডলে পরিভ্রমণান্তে রনজিৎ রক্ষিত বর্তমান সময়ে একলব্যের মতো আবৃত্তির শিল্পিত চেতনার আরাধনায় স্থির ও অবিচল। ষাট দশকে রণজিৎ রক্ষিতের প্রাণের সাধন শুরু হয়েছিল একজন নাট্যকর্মী হিসাবে। তখন শহর চট্টগ্রামে আবৃত্তিশিল্পী বলতে নাট্যজনদের বোঝাত। সে-ধারা থেকে বেরিয়ে এসে আবৃত্তিশিল্পীদের স্বতন্ত্র সত্তা তৈরির সংগ্রামে রনজিৎ রক্ষিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এক্ষেত্রে সারথী হিসাবে তিনি পেয়েছেন বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম।
বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম, সম্মিলিত আবৃত্তি জোট চট্টগ্রাম-এর সভাপতি, বোধন আবৃত্তি স্কুল-এর অধ্যক্ষ, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ-এর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রণজিৎ রক্ষিত তাই বাংলাদেশের আবৃত্তির ইতিহাসে নানাভাবে উচ্চারিত একটি নাম। আবৃত্তিকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও দুবাই, ভারত ও যুক্তরাজ্য সফর করেন। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে রবীন্দ্র সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন পরিষদের আমন্ত্রণে সরকারি পর্যায়ে আবৃত্তি পরিবেশন করেন। রবীন্দ্রনাথের ১০০তম, ১২৫তম ও ১৫০তম জন্মজয়ন্তীতে অংশগ্রহণ করেন।
সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দায়বোধ থেকে রণজিৎ রক্ষিত আলাউদ্দিন ললিতকলা কেন্দ্র চট্টগ্রাম, উদীচী, রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ, বান্ধব পাঠাগার, দি চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন, দি চিটাগাং জেলা কো-অপারেটিভ হাউজিং (২২০০) সোসাইটি লি., রেনাশিস, বাংলাদেশ বোর্ড অব ইউনানী অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক সিস্টেমস ও মেডিসিন, বিশ্বশান্তি পরিষদ, দি আর্বান কোঅপারেটিভ ব্যাংক, গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়, নান্দীকার নাট্য সম্প্রদায়, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদ, চট্টগ্রাম একাডেমি, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর খেলাঘর, চট্টগ্রাম শিল্পী কল্যাণ সংস্থা, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, ৩০নম্বর পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ড অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবল দল প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
সুদীর্ঘ অর্ধশতকের বেশি সময় সাংস্কৃতিক এবং গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলের বাতিঘর হিসাবে দায়িত্ব পালনের সম্মাননাস্বরূপ লাভ করেছেন ভাষা আন্দোলন স্মৃতি পদক (সুচেতন আকাদেমী, কোলকাতা), মৃণাল সরকার স্মৃতি পদক (অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, চট্টগ্রাম), নাজিম মাহমুদ স্মৃতি পদক ।
কারো সম্ভাষণে রণজিৎদা, কারো কাছে রনজিৎস্যার, কারো রনজিৎকাকু কিংবা কারো কাছে শুধুই রনজিৎ রক্ষিত সার্বিক বিবেচনায় আজ আবৃত্তির ইতিহাসে নয়, নাট্যচর্চার এপাতা-ওপাতায় নয়, বাংলাদেশের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাতিঘর। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, রনজিৎ রক্ষিত নামের এই বাতিঘর অনন্তকাল আমাদের জন্য, আমাদের উত্তর-প্রজন্মের জন্য আঁধার চিরে আলো জ্বালিয়ে যাবেন। আমরা ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম রণজিৎ রক্ষিতের আলোকচ্ছটায় প্রজ্বলিত হয়ে জন্ম-জন্মান্তরে অপূর্ব সেই আলো হয়ে থাকব।
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS