কংস-মগরা-ধলাই-সাইভুলি-ধনু-ঘোরাউৎরার অববাহিকায় সুরে-জিজ্ঞাসায়-পরিবেশনে বাউলের একটা নিজস্ব ধারা ও ঘরানা বহমান। সুরে ও জিজ্ঞাসায় ভাঁটফুলের এই শুভ্র মৃত্তিকা থেকেই উৎসারিত হয়েছে তত্ত্বগানের বিপুল জগৎ। এই মাটিটাই সুরের। ভাবুকের। নেত্রকোনা মূলত নদীবিধৌত হাওরের পাড়। দূর হাওরের হাওয়া ও স্নিগ্ধতা ধান-পাখি-ফুল ও মাছের উল্লাসে এখানে প্রবাহিত। ঝগড়া-ফ্যাসাদ যে নেই তা নয়। পলিমাটির মাধুর্যে গড়ে উঠেছে এখানকার মানুষের মন। এখানে হাওরপাড়ের ভাবুকেরা, গায়েনেরা, গীতালুরা বিস্তীর্ণ জলরাশির দিকে তাকিয়ে গানে গানে কাহিনি বাঁধেন। লম্বা লম্বা কাহিনিকাব্যের সুরে উঠে আসে ধরা-অধরা মানবচরিত্র। পৃথিবীর সব কাহিনির উৎসে আছে মানুষ। মাটির গুণাগুণে সেই কাহিনিতে তৈরি হয় ভিন্নতা। সেই ভিন্নতার সুরেই এখানে রূপায়িত হয় আলাল-দুলাল, কাজলরেখা, মহুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ানা মদিনা।
.
২
কত যে বিচিত্র এখানকার গানের প্রকার ও প্রকাশ! মাটির নরম থেকেই উৎসারিত হয়েছে এখানকার সুর, সাধু-মহাজনের জীবনপদ্ধতি। দিঘির পাড়ের বেলপাতার মতো নরম ও দরদি এখানকার মানুষের হৃদয়। প্রশ্ন ও সুরযাপনের বিচিত্র শুদ্ধতা থেকেই জন্ম নিয়েছে ভাটি-বাংলার নিম্নভূমির আন্তরিক তত্ত্বগান। প্রশ্নে-প্রশ্নে গানে-গানে এই মাটির সাধু মহাজনেরা জ্ঞানের কথা প্রচার করেন। সুর ও জিজ্ঞাসার এই প্রদীপ্ত ধারাকে মহামতি জালাল উদ্দিন খাঁ মগ্ন-প্রাচুর্যে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। আসরে দাঁড়িয়ে সুরে-জ্ঞানে জগতকে, মানুষকে, সৃষ্টিকে, স্রষ্টাকে, ইহকাল-পরকালের রূপ-রূপান্তরকে জিজ্ঞাসা করছেন। বাংলার কৃষিজীবী, শ্রমজীবী মানুষেরাই এই গানের শ্রোতা। এরা ‘শিক্ষিত’ মানুষজনের দুর্মর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নয়। শহরের ইংরেজি-শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের বাইরে এঁরা দরদি ব্যক্তিত্বে, মুক্তজ্ঞানে এই জিজ্ঞাসার জ্ঞানমাধুর্যকে গ্রহণ করেন।
তত্ত্বগানের এই মহৎ ঘরানায় নিজের নাম লিখিয়েছিলেন সনতারা বেগম। সময়টা আশি-নব্বইয়ের দশক। নেত্রকোনার ভাটির তল্লাটে এমন কোনো মানুষ নেই যে সনতারা বেগমের নাম শোনেননি। মূলত তিনি গায়িকা। আসরের মালজোড়া গানের শিল্পী। সহজ বুদ্ধিতেই মালজোড়া গানের আসরে অবতীর্ণ হতেন। সনতারা বেগম এবং উকিল মুন্সির নাতনি আলেয়া বেগম সেসময় মালজোড়া গানে এই অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছেন। নেত্রকোনায় কে প্রথম নারী বাউল শিল্পী — এই প্রশ্নের মীমাংসা করা বেশ কঠিন হবে। কারণ এই দুইটা নাম পাশাপাশি সময়ে লোকমুখে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে। দুজনেই পাশাপাশি সময়ে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন। কী জনপ্রিয় যে তারা ছিলেন! আজাদ-সনতারা বেগম এবং আলেয়া বেগমের মালজোড়া গানের ডাক উঠলে দর্শক ধারণের ঠাই সংকুলান হতো না। এই অঞ্চলের মানুষ টিকিট কেটেও তাদের মালজোড়া শুনেছে। তারপর পিরের নিষেধে আলেয়া বেগম চলে গেছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। আর সনতারা বেগম ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায় পরলোকবাসী হয়েছেন।
.
৩
ধারণা করা হয় বাংলা ১৩৭৬ সনে তিনি জন্মেছেন। আটপাড়া উপজেলার দেওগাঁও গ্রামে তাঁর পৈতৃক নিবাস। তাঁর পিতা সৈয়দ সোনাফর শাহ ওরফে পোড়া শাহ ছিলেন একজন ফকিরপন্থী সাধকপির। সাধকের বাড়িতে পিরসাধুদের স্বাভাবিক গমনাগমন ছিল। ছিল বাউলদের আন্তরিক আনাগোনা। প্রতিদিনই সন্ধ্যার পরে গানের জলসা হতো। বাউল পন্থীরা ফকিরপন্থীরা সেখানে নিজেদের গান পরিবেশন করতেন। গানের এরকম একটি সহজে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সনতারা বেগম। জলসা গানে স্নাত হতে হতে একদিন তিনি বাউল গানে আত্মপ্রকাশ করেন। পিতার নিষেধ ছিল না। তাই সহজেই গানের জগতে নাম লেখাতে পারলেন। অত্যন্ত সুরেলা কন্ঠের অধিকারী হওয়ায় দ্রুত তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সময়টার কথাও একবার ভাবুন, আজ থেকে ৪০ বছর আগে একজন কুমারী নারী জলসার গান গাইতে, তত্ত্বগান গাইতে আসরে অবতীর্ণ হচ্ছেন — স্বাভাবিকভাবে দর্শকদের মধ্যে এ-নিয়ে প্রবল আগ্রহ থাকবে। এবং তা-ই হয়েছে। মানুষের ঢল নেমেছে তাঁর আসরে।
মানুষেরা সনতারা বেগম বলত না। ছোট্ট করে বলত, সনতারা। ‘আজ সনতারার গান আছে’ — এই কথা শুনলে ছেলে-যুবক-পৌঢ়-বৃদ্ধ সবাই গানের আসরে হাজির হতো। আসরের গান গাইতে গাইতে তিনি আসরের শিল্পী হয়ে গেলেন। মালজোড়া গান একা গাওয়া যায় না। গাইতে গাইতে একসময় খাটপুরার বিখ্যাত বাউলসাধক চান মিয়া সাহেবের ছেলে বাউল আজাদ মিয়ার সঙ্গে তাঁর জুটি হয়ে যায়। লোকের মুখে প্রচারিত হতে থাকে আজাদ-সনতারা জুটি। আসরে-জলসায় গানে গানে প্রেমের উন্মেষ। প্রেম থেকে বিয়ে।
বিয়ের পরেই তাঁর শশুর বিখ্যাত বাউলসাধক চান মিয়া সাহেবের কাছে মালজোড়া গানের তালিম গ্রহণ করেন। শিখতে থাকেন গানের জ্ঞান, রীতি ও পদ্ধতি। সাধনা ও আন্তরিকতায় সনতারা বেগম এই জনপদের মানুষের মুখে মুখে ছিলেন। তিনি নিজে গান লিখেননি। তাঁর শশুর চান মিয়া সাহেবের গান গেয়েছেন। তাঁর স্বামী আজাদ মিয়া সাহেবের গান গেয়েছেন। মূলত আজাদ মিয়ার উৎসাহ ও প্রেরণাতেই মালজোড়া গানের বিখ্যাত শিল্পীতে পরিণত হন সনতারা।
আজাদ-সনতারা জুটির কোনো তুলনা হয় না। এই জনপদের মানুষের মনের মণিকোঠায় তাদের স্থান। তারপর আজাদ মিয়ার সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। এই বিচ্ছেদে তাঁর অনেককিছু শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় সংসারে আর তেমনভাবে গান গাওয়া হয় না। কমে যেতে থাকে গানের বায়না। জুটির মৃত্যু হলে জুটির শিল্পীবৃন্দকেও মানুষ আর তেমন পছন্দ করে না। তারপরও তিনি গান ছাড়েননি। ডাক পেলেই আসরে উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু সমাজ থেকেই যেখানে গান মরে যাচ্ছে সেখানে সনতারাকে আর কে গানের জন্য ডাকে? তারপরেও দু-একটি ডাক আসে, আন্তরিকতার সঙ্গে সেসব আসরে নিজেকে ঢেলে দেন সনতারা।
.
৪
২০১৬ সালে তাঁর সাথে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়। বড় স্টেশন সংলগ্ন কেডিসি গুদামের পাশে ছোট্ট একটি চায়ের দোকানে কথা হয়। আত্মজীবনের কথা, আত্মপরিচয়ের কথা। গুরুর কথা। চান মিয়া সাহেবের কাছে কীভাবে গান শিখেছেন সেই কথা। বললেন, আজ আব্বার ওরস। প্রতিবছর ফাল্গুনের ১৭-১৮-১৯ তারিখে এই তিনদিনভরা আব্বার ওরস অনুষ্ঠিত হয়। কথায় কথায় বলি, চলেন আজকে আপনার গুরু চান মিয়া সাহেবের বাড়ি যাই। ওরসে যাই। তিনি বললেন, তাঁর সাথে (বাউল আজাদ মিয়া) তো আমার বিচ্ছেদ হইছে। তাঁর সাথে দেখা হয় না। তিনি আমার সাথে কথা বলেন না, আমিও কথা বলি না। চলেন আপনারা বলতেছেন যাই। সেদিনের সে-কথামালায় উপস্থিত ছিলেন কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ। কথাবলার সূত্র ধরেই সেদিন সন্ধ্যায় চুচুয়া বাজার সংলগ্ন খাটপুরায় চান মিয়া সাহেবের ওরস মোবারকে হাজির হই। স্বপনভাই ভক্তদের জন্য তবারক হিসেবে জিলাপি কিনে নিয়েছিলেন। সারারাত ছিলাম। মচ্ছবের খাদ্য গ্রহণ করেছি। দেখেছি ভক্তবৃন্দের গান ও প্রার্থনা। নারী-পুরুষের সম্মিলনে রাতের গানের আসরে দেখেছিলাম বাংলার মরমের এক আদিরূপ।
শ্বেতশুভ্র-নির্মল শাড়িতে হাজির ছিলেন সনতারা বেগম। বেহালা বাজিয়ে তাঁর গুরু শ্বশুরসাহেবের গান করছিলেন। মাজারের রূপালি ঝালরের মতো চকচক করছিল প্রেম ও দরদ। বোঝা যাচ্ছিল গানে গানে তিনি সমর্পিত হচ্ছেন। প্রকৃত নিবেদনে একটা স্নিগ্ধতা থাকে — সেই স্নিগ্ধতা সবাইকে স্পর্শ করে। সনতারা বেগমের দরদ ও স্নিগ্ধতাই আমাদেরকে স্পর্শ করেছিল। কারণ তাঁর কণ্ঠে সুর ছিল না। রাতজাগার গাঢ় কুয়াশায় কণ্ঠ ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু গানটা খুব ভালো লাগছিল। যেভাবে তিনি গাইছিলেন, মনে হচ্ছিল, কণ্ঠ থেকে নয়, অন্যত্র থেকে এই সুর নামছে। মালজোড়াগানের প্রবীণ গায়িকা আজ সুরে সুরে সবাইকে ভিজিয়ে রাখবেন। মনে হচ্ছিল মালজোড়াগানের একটা আসরেই হাজির হয়েছেন তিনি।
তিনি গাইছিলেন :
তোর বুকে থাকিয়া পাইলাম বেদনার ব্যথা
তোর সনে কিসের মায়ামমতা।
সাধের দুনিয়া, তোর সনে কিসের মায়ামমতা।।
আগে যদি জানতাম আমি তুমি যে বাসিবে ভিন
তবে কি আর খেটে খেটে এই দেহ করতাম মলিন
ফুরাইয়া গেল গনার দিন খাইয়া লাথিগুতা।
তুই যে এত ভেল্কি জানিস আগে যদি জানিতাম
তবে কি মানবকুলে তোর বুকেতে আসিতাম গো (২)
পশু হইয়া দিন কাটাইতাম খাইয়া গাছের পাতা।
না লাগিত বেহেস্ত-দোজখ না হইত আচারবিচার
ইচ্ছামতো বেড়াইতাম কারণ না ছিল চিন্তার গো (২)
পুলছেরাত না হইতাম পার শুনতাম না কারো কথা।
হাতি-ঘোড়া হইতাম যদি লাগিতাম কোন কাজে
আমার ঘাড়ে চইড়া মানুষ বেড়াইত মাঝেমাঝে (২)
চান মিয়ায় কয় বুঝেসুজে চামড়ায় বানাইত জুতা।
গানটি সাধক-পুরুষ বাউল চান মিয়া সাহেবের।
.
৫
এরপরে আরো কয়েকবার তাঁর সাথে কথা হয়। দু-একবার তিনি নেত্রকোনা কলেজের বাংলা বিভাগেও এসেছেন। তাঁর ছেলে হাবিব বাউলাকে নিয়ে প্রায় পুরোদিন একটি গানের ভিডিও রেকর্ডিং করেছিলাম। বারীণ ঘোষকে যারা জানেন তারা বুঝতে পারেন বারীণ ঘোষের সাথে কাজ করা কতটা কঠিন। কোনো-একটা বিষয়ে প্রস্তুতি নিতেই তিনি দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। সেই বারীণ ঘোষের ক্যামেরায় কলেজের পুকুরপাড়ে তালগাছতলায় সনতারা বেগমের গান ভিডিও করা হয়েছিল। পরে বারীণ ঘোষকে অনেকবার বলার পরেও সেই ভিডিও আর পাওয়া যায়নি। মনে হয় শিল্পীর খেয়ালে এই ভিডিও তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। ভিডিও থাকলে ভালো হতো, তাহলে জগতসংসার বাংলার মালজোড়া গানের এক মহৎ শিল্পীকে চিনতে পারতেন, বুঝতে পারতেন এই মাটির গানের উত্তরাধিকার।
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে বঙ্গাব্দ ও বৈশাখ
- মুস্তাফা জামান আব্বাসী : অবদান তাঁর অবিনাশী - May 14, 2025
- কিছু পরিপ্লুত ভালোবাসা, কিছু দুঃখের খাতা - May 13, 2025
- সহজ সম্পন্ন সরদার || সরোজ মোস্তফা - May 1, 2025
COMMENTS