বাতায়নপাশে গুবাকতরুর সারি। দিনভর বরিষন ভারী। হেভি রেইনফ্যল। বরিষনাচ্ছন্ন চরাচর, তলাতল। হাঁস ও গাইগোরুগুলোর ভোগান্তি। শিশুরা দাপাদাপি শেষে তোয়ালেশুষ্ক খাটে এলিয়েছে গা, প্রায়-বিকেল, সুনিদ্রা ও শান্তি। কিন্তু বৃষ্টির হিয়া বিরাম পায়নাকো। সন্ধেজোড়া বৃষ্টির সিজদা ও রুকু।
আণবিক ছাই, কাচ ও তেজস্ক্রিয় হাহাকার নিয়ে বৃষ্টি ঝরছে।
পৃথিবীর সব ঘড়ি গিলে ফেলে বৃষ্টি ঝরছে এখন।
বৃষ্টির বর্ণনা প্রায়শ মনোটোনাস। মনোরম মনোটোনাস? না, আখতার ইলিয়াসের খতে টিপসই না-দিয়েই বলি, মোস্টলি মনোরম নয়। বৃষ্টির বর্ণনা ঠাকুরের পরে, কিংবা তারও আগের কালিদাসের পরে, জীবনানন্দের পরে প্রায়শ মনোটোনাস। মনোরম নয়, মনোক্লান্তিকর বৃষ্টির ম্যাজোরিটি বর্ণনাবাদ্যি।
বৃষ্টির জিভ ক্রমাগত লম্বা হয়ে চেটে খাচ্ছে বৃষ্টির ঘা …
চা-দোকানের মজুর বাচ্চাটা সাতকাপ চা হাতে নিয়ে এই বৃষ্টির ভিতর পার্শ্ববর্তী বড়দোকানির পার্সেল ডেলিভারি দিতে এঁকেবেঁকে অ্যাক্রোব্যাটিক্স কৌশলে চলেছে হাতের চা না-ভিজিয়ে। ফের যখন ফিরে আসছে হাত-পনেরো দূরের ডেস্টিনেশন থেকে আপন মোকামে, একটুও শরীর ভেজে নাই সেই ম্যাজিশিয়্যানের।
ঝরছে নিহত কবুতরের বৃষ্টি কুকুরদের বৃষ্টি
পচা কালোজামের ফলন্ত অসূয়ার বৃষ্টি
ন্যাতা ছেঁড়া কাগজ সমস্তকিছু পণ্ড হয়ে যাওয়া
অভিশাপ ও ঝগড়ার বৃষ্টি।
কিন্তু কই বৃষ্টিনির্বিকার ওই দোকানবালকটি? কই তার মালিকের ধমকাধমকি? দিনের খোরাকি কেটে রেখে দেবে বলে শাসিয়েছে যে একটু আগে, সেই বৃষ্টিজনিত ভোগান্তি ও উপভোগ্যতা বাংলা বর্ণনায় কই? জীবনানন্দের ‘এই জল ভালো লাগে’ সনেটের আদলে এখনও ওই একঘেয়ে ভালোলাগালাগি।
কালো টায়ারের বৃষ্টি, ঘুমিয়ে-পড়া ও ঘুম-না-হওয়া
অম্বল ও ধাতুদৌর্বল্যের বৃষ্টি
যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা ও ছুরিতে শান দেওয়ার
বৃষ্টি ঝরছে ফুটপাতে।
দেখা যাবে যে নাগরিক বৃষ্টি বলতেই সমর সেন আর শহীদ কাদরীর মনোপোলি। কিংবা আরও গুটিকয় যারা শাহরিক বৃষ্টি নিয়া কাজ করতে চেয়েছেন, অবচেতনে হলেও সমর/শহীদবৃত্তীয় অনুষঙ্গের রেখাপাত রয়ে গেছে বা এড়িয়ে যাওয়া যায় নাই পুরোপুরি। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও, সবার বৃষ্টিই আলাদা ফিচারবাহী।
শুধু ঐখানে, প্রখ্যাত ব্যবসায়ীর আঠারো তলার ফ্ল্যাটে একজন
বিরাট সাহিত্যিক, দুঁদে অফিসার ও জাঁদরেল সাংবাদিক
হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে হঠাৎ গদগদ স্বরে বলে উঠছেন —
দ্যাখো দ্যাখো, বৃষ্টি ঝরছে আনন্দের বৃষ্টি
কালিদাসের বৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের বৃষ্টি যেখানে উদ্ভূত
ঠিক সেখানেই মিশে যাওয়ার বৃষ্টি, ধ্রুপদী গানের বৃষ্টি
ঝরছে ঐ ঝরছে দ্যাখো কৃষিমন্ত্রীর বৃষ্টি।।
নিউজফিডে সেল্ফি ও অন্যান্য প্রযুক্তিপ্রীত ফটোগ্র্যাফিঋদ্ধ বৃষ্টির লোকেশন অবশ্য কমন কয়েকটা চিহ্নের বাইরে যেতে দেখা যায় কালেভদ্রে। হয় বারিস্তায় একদিন ফ্রুটজুসে সিপ করার মুরদ দেখাবার গরজে গগনে-ভাসানো বারিধারা, না-হয় ধুম গ্রামের কোনো কচুঝোপের বিরল বিলুপ্ত বৃষ্টিস্ফটিক। ফেইক রিয়্যাল। অথবা অ্যাস্থেটিক রিয়্যাল, অ্যাস্থেটিক ফেইক।
এখন বৃষ্টি ঝরছে
লক্ষ লক্ষ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম-অসুখের
কানা এবং খোঁড়া লোকেদের বৃষ্টি
ঝরছে … জানলার শার্শিতে।
দেখি বরং। বাতায়ন থেকে ফেরায়ে এনে নয়ন বসাই বইয়ের তাকিয়ায়। দেখি সেখানকার বৃষ্টিপাত। এইখানে যে-রেইনগ্র্যাফ আবছা পাওয়া যাচ্ছে ডিমলাইটেড, সেই বৃষ্টিকারিগরের নাম শামশের আনোয়ার। কবিতার নাম বৃষ্টি। কবিতাটা পাওয়া যায় কবির তৃতীয় তথা অন্তিম বই ‘শিকল আমার গায়ের গন্ধে’-র আওতাধীন। অথবা দে’জ প্রকাশিত সংকলনের প্রথম প্রকাশ পঁচাশি পৃষ্ঠায়।
— জাহেদ আহমদ ২৪ জুলাই ২০১৫
- টিপু দ্য কিপার - May 12, 2025
- সাহিত্যিক সাংবাদিকতা, সাংবাদিকী সাহিত্য - May 3, 2025
- রাজন যখন ছবি আঁকেন - April 23, 2025
COMMENTS