লাইভ ফ্রম টাইটানিক || স্লাভো জিজেক

লাইভ ফ্রম টাইটানিক || স্লাভো জিজেক

টাইটানিকের সলিল সমাধি কিসের আলামত বহন করে? এইটা তো আমরা সকলেই জানি যে টাইটানিক কবে কোথায় কীভাবে ডুবেছিল, কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ডুবে যাবার পরের ইম্প্যাক্ট সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল আছি আমরা। জানি মোটামুটি এর স্ট্যান্ডার্ড রিডিং সম্পর্কে, সম্ভাব্য অনেকগুলা পাঠ-পাঠান্তর-পাঠভেদ মোটামুটি জানা। টাইটানিক ডুবেছিল। শুধু ম্যুভিতেই ডুবেছিল, তা তো নয়। বাস্তবেও টাইটানিক ডুবেছিল। ম্যুভির ডুবে-যাওয়া নিয়ে যেমন, বাস্তবের ডুবে-যাওয়া নিয়েও বহু কথাবার্তা চালু আছে।

এই জাহাজডুবির ঘটনাটা সাংঘাতিক অর্থবহ ঘটনা একটা। মানে, এই সিঙ্কিং ঘটেছে এমন একটা সোসাইটিতে যেখানকার চারপাশ মিলিয়েজুলিয়ে এর পাঠ যদি নিতে যাই আমরা, তাইলে দেখব যে এই সোসাইটির লোকগুলা আছে একটা খামাখা বড়াই আর বড়ত্ব নিয়া, ডাইনে-বাঁয়ের দিনদুনিয়া নিয়া তাদের তেমন চেৎবেৎ নাই। কিছুদিনের মধ্যেই যে একটা আজদহা যুদ্ধ তেড়ে আসছে তাদের দিকে, যেইটাকে আমরা প্রথম দুনিয়াযুদ্ধ নামে ডেকে যাব জিন্দেগিভর, যে ক্ষয়ক্ষতি আর বিপুল চৈতন্যের অবক্ষয় তাদেরে গ্রাস করতে আসছে, এইসব নিয়া তাদের গমচিন্তা নাই বিলকুল। সিনেমার জাহাজযাত্রীদের মধ্যে নাই, সিনেমার বাইরেকার সোসাইটিতেও নাই দেখতে পাবো। ১৯১২ সালে টাইটানিক ডুবেছিল। অল্পদিনের মধ্যেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ধেয়ে আসে। সেই ধাওয়া নিয়া যাত্রীদের মধ্যে হেলদোল ছিল না, তার মানে হেলদোল সমাজেই ছিল না।

আচ্ছা, আসলে এই পুরা ব্যাপারটায় একটাকিছু আছে যেইটা অতিরিক্ত, অন্তত অর্থের বা মিনিঙের দিক থেকে অতিরিক্ত। অর্থাতিরিক্ত একটাকিছু অর্থ দিতেছে বলেই টাইটানিকের ডুবিয়া যাওয়াটা কাহিনি হিশেবে ফ্যাসিনেইটিং হতে পেরেছে। জেমস ক্যামেরন সত্যিকারের টাইটানিক ডুবাডুবির বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্যে সাগরতলে এবং সাগর-উপরের স্থলভাগে একটা সন্ধানীটিমের ট্রিপ আয়োজন করেছিলেন এবং ট্রিপশেষে ক্যামেরন নিজেও অনুরূপ মন্তব্য করেছিলেন যে এই পুরা কাহিনিটার মধ্যে একটা অর্থোর্ধ্ব ঘটনা আছে বলিয়াই জিনিশটা এত ইন্ট্রেস্টিং হয়েছে। এক্সপ্লোরার অভিযাত্রীরা টাইটানিক-ধ্বংসাবশেষের যত কাছাকাছি হচ্ছিলেন ততই তারা বুঝতে পারছিলেন যে এইটা অলমোস্ট একটা মেটাফিজিক্যাল এক্সপেরিয়্যান্স এবং বুঝতেসিলেন তারা এমন একটা ফর্বিডেন এলাকায় ঢুকতেসেন যেখানে পুণ্য আর পাপ হুড়মুড়িয়া জায়গা বদলাতেসে।

— ইয়্যা, রজার দ্যাট, ওক্যে। ড্রপ ডাউন অ্যান্ড গ্য ইন্টু দ্য ফার্স্ট ক্লাস গ্যাংওয়ে ডোর।
— আই ওয়ান্ট য়্যু গাইস্ ওয়ার্কিং উয়িথ …

অত্যন্ত ইফেক্টিভ পোলিটিক্যাল এবং আইডিয়োলোজিক্যাল সিম্বল অথবা সিম্পটমগুলারে এই ধরনের পাথরজমাট ভোগবিলাসের ভিতর দিয়া জাহির হতে হয়। এই ধরনের বিপর্যয়মাত্রার উপরেই নির্ভর করতে হয় ইফেক্টিভ পোলিটিক্যাল এবং আইডিয়োলোজিক্যাল সিম্বল অথবা সিম্পটমগুলারে এক্সপ্রেস করতে গেলে। এক্সেসিভ বরফকাটা ব্যথার মধ্যে বল্গাহারা সুখ, প্লেজার ইন পেইন বলে ব্যাপারটারে।

— হোয়াট অ্যাম আই ডুয়িং হিয়ার ইন দি মিডল অফ দি ওশিন অ্যালোন ইন অ্যা বোট সারাউন্ডেড বাই ফ্রোজেন কর্পসেস?

… জ্যাক বলেছিল কথাটা টাইটানিকের সিনেমায়।

আমি এখন জেমস ক্যামেরনের টাইটানিক সিনেমার একটা সিনের উপর দাঁড়িয়ে কথা বলতেসি। সিনেমাটা সাম্প্রতিক হলিউডে আইডিয়োলোজি বুঝবার জন্য স্যুপ্রিম একটা কেইস বলা যায়।

— বুঝলাম না কিসুই।
— আমিও না। কাম নাই বুইঝা। কাইজকাম করো খালি। চিন্তা কইরো না।

আমরা দেখব যে অন্তত তিনটা স্তর আছে ব্যাপারটার মধ্যে। এক নাম্বার স্তরে যেইটারে লোকে জেমস ক্যামেরনের হলিউড মার্ক্সিজম বলিয়া জানে সেইটা আছে, এরপরে নিচা ক্লাসের লোকদের লাইগা ফেইক একটা সিম্প্যাথির স্তর দেখতে পাবেন, আর সবকিছুর উপরস্তরে প্যাসেঞ্জারগুলা আছে যাদের মধ্যে বেবাকতেই বলতে গেলে দেওলা-দানব, অহংভরা পাহাড় একেকটা, কাওয়ার্ড।

— য়্যু ন্য আই ডোন্’ট লাইক দ্যাট, রৌজ!

এই ডায়লগটা দেয় কেইট উইন্সলেটের ফিয়াঁসের রোলে যে প্লে করে সে। বিলি জেইন অভিনয় করেছেন এই ক্যারেক্টারে। এই পুরা ক্যারেক্টার ঘিরে যে ন্যারেটিভ গড়ে উঠেছে সেইটা আগাগোড়াই রিয়্যেকশনারি মিথ একটা।

— ডিড য়্যু সি দৌজ্ গাইস্’ ফেইসেস?

এইখানে এসে আমরা জিগাইতে পারি যে প্রেমকাহিনিটার বিকাশে যেই বিপুলদেহ বরফচাঁই বা আইসবার্গ জাহাজটায় আঘাত হানে, এই বরফপর্বত কিসের ভূমিকা পালন করেছিল।

— জাহাজ ডকে ভেড়ামাত্র আমি তোমার লগে এককাপড়ে নেমে যাব।
— দিস্ ইজ্ ক্রেইজি।
— আই নৌ।

এখন আমি যেই কথাটা পাড়ব এইটা অনেকটাই সিনিক্যাল মনে হবে আপনাদের কাছে। এই-যে এককাপড়ে প্রেমিকের বাহুলগ্ন হয়ে সুখের সাগর থেকে দুঃখের ডাঙায় নেমে যাওয়ার প্রণয়েচ্ছা, টাইটানিক সিনেমায় বিপর্যয়ের শুরু এইখান থেকেই হতে পারত। কল্পনায় আমরা দেখে নিতে পারি যে নিউইয়র্কের একটা-কোনো ঘুপচি টাইপের ফ্ল্যাটে প্রেমিক-প্রেমিকার পারস্পরিক শরীরদ্বীপ-আবিষ্কার-করা চাইর বা তিন হপ্তার ঘন রতিক্রিয়া শেষে একসময় তাদের আবেগ থিতিয়ে আসত। প্রণয়কাণ্ড ফুড়ুৎ করে উড়াল দিত ততক্ষণে বাস্তবের রুক্ষভরা দাবিদাওয়াচাহিদায়।

— অ্যাজ অ্যা পেয়িং কাস্টোমার, আই এক্সপেক্ট টু গেট হোয়াট আই ওয়ান্ট।

কেইট উইন্সলেট এই সিনেমায় এক উঁচা ক্লাসের মেয়ে যে কিনা সাইকোলোজিক্যালি ডিসট্রেসের ভিতর দিয়া যাচ্ছে এবং কনফিউজড অবস্থায় আছে। মেয়েটার ইগো রুদ্ধদ্বার গুমরে মরছে ভিতরে ভিতরে। লেনার্ডো ডিক্যাপ্রিয়ো গল্পে এসেছে মেয়েটার ইগো পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে মেয়েটারে হেল্প করবে বলে।

— লাই ডাউন।

রৌজের, বা কেইটের, আত্মচিত্র। নগ্ন। সত্যি সত্যি চিত্রটা আঁকে ক্যাপ্রিয়ো তথা জ্যাক।

— টেল মি হোয়েন ইট ল্যুকস্ রাইট।
—পুট ইয়োর আর্ম ব্যাক দ্য ওয়ে ইট ওয়্যজ।

এইটা আদ্দিকালিক ইম্পেরিয়্যালিস্ট/সাম্রাজ্যবাদী মিথগুলার মধ্য থেকে একটা আনকোরা ভার্শন বলতে পারি। মিথের আইডিয়াটা হচ্ছে এমন যে, যখনই উঁচা ক্লাসের লোকেরা তাদের জীবনশক্তি নিয়া অনটনে পড়বে তখনই নিচা ক্লাসের লোকগুলার দরকার পড়বে উঁচাদের লাইফ চাঙ্গা করে তুলতে। ভ্যাম্পায়ারের লগেই মিল পাওয়া যায় এইখানে উঁচাদের, তারা নিচাদের জীবনশক্তি শুষিয়া খায় লাইফে একটুখানি ঝিমানি এলে। এরপর নিজেরা খানিক ধাতস্থ হয়ে এলে, একটু চাঙ্গা হয়া উঠলে, একটু রিভাইট্যালাইজড হলে পরেই ফিরিয়া যায় তারা তাদের উঁচা আলাদা আয়েশি ক্লাসের আসমানে।

— মাই হার্ট ওয়্যজ্ পাউন্ডিং দ্য হোল টাইম।
— ইট ওয়্যজ্ দি মোস্ট ইরোটিক মোমেন্ট অফ মাই লাইফ।

হ্যাঁ, আমারও। অন্তত তখন পর্যন্ত।

চলবে


অ্যা পার্ভার্ট’স্ গাইড টু ফ্যামিলি  থেকে বাংলায় জাহেদ আহমদ।

উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে এই লেখাটা মূলত একটা ভিডিয়ো কন্টেন্ট হিশেবে বেরোয়, লেখক যেখানে অ্যাঙ্কর বা কমেন্টেটরের ভূমিকায় অ্যানালিসিসটা চালান। টাইটানিকের নিমজ্জনমুহূর্তের ফেইক রিয়্যালিটি নির্মাণ করা হয় ভিডিয়ো কন্টেন্টের সেটে এবং ম্যুভিসিনগুলা থেকে কাট-কাট অংশগুলো শো করা হয় লেখকের আলাপফোকরে। এইটা অ্যাভেইলেবল ভিডিয়ো কন্টেন্ট হিশেবে। একটি/একাধিক স্ক্রিপ্ট ভার্শন পাওয়া যায় এই কন্টেন্টের। ভিডিয়ো কন্টেন্ট দেখে নেয়াই ব্যেটার, শুধু শুধু পড়ার চেয়ে। ট্র্যান্সলেশন নয়, এইটা ভাষান্তরের সময় স্বাধীনতা নেয়া হয়েছে বাক্যে-বাক্যান্তরে। নেক্সট পার্টে টেন্ডেন্সিটা থাকবে আরও বেশি, জিজেকের বিভিন্ন কথিকা থেকে টাইটানিক বিষয়ক কৌতুক-ফোঁড়নগুলা এনে জুড়ে দেয়া হবে। এই বাংলা লেখার নামটাও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নেয়া। — জা. আ.


 

আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you