মাঝবয়সে মানিক

মাঝবয়সে মানিক

টানা দুটো গল্প পড়ে উঠলাম, শর্ট স্টোরি, যাকে বলে ছোটগল্প। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এখনো গল্প দুটোর ঘোর কাটে নাই। কি জানি, শিল্পের বা ভালো রচনার লক্ষণই বোধ করি এমন যে, বুঝে উঠবার আগেই সে অধিকার করে নেয়, রেখাপাতই করে না শুধু উপরন্তু মন ও চিন্তন ছেয়ে ফেলে। অথচ এই গল্প-দুটো ও গল্পকারের অন্যান্য অধিকাংশ রচনাপত্র দুনিয়ার তাবৎ বাংলাভাষাভাষী পাঠক পড়ে ওঠে পড়াশোনার শুরুতেই। আর আমি কি না পড়লাম সবার শেষে এই মাঝবয়সে এসে!

এ আর নতুন কী, আমার সঙ্গে ওরিয়েন্টেড সকলেই সম্যক অবগত, বিলম্ব ভূষণ আমার সর্বত্রই জীবনে। এত দুঃখ কোরো না, বাছা, বাঁচো! যদিও গদাইলস্কর বলে না লোকে, সামনাসামনি, কিন্তু অন্তরালে অন্তত গদাইশর্মা না-ডাকার কোনো কারণ দেখি না। যাক, অগত্যা। এই দেখুন, গল্প পড়ার কথা বলতে বসে নিজেরই গল্প জুড়ে দিলাম! উঠে যাবেন না আসর ছেড়ে, মুহতারাম শ্রোতাবৃন্দ!

বলছিলাম মানিক বাড়ুজ্যের কথা। মানে তাঁর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের, অতসীমামি  আর সরীসৃপ  গল্প-দুটোর কথা। আমার মানিকপাঠ বলতে, এর আগে, ছিল কেবল সমুদ্রের স্বাদ,  প্রাগৈতিহাসিক   এবং পদ্মানদীর মাঝি । শেষেরটি উপন্যাস, পড়েছি ও দেখেছি সিনেমাও যেখানে কপিলারূপী রূপা গাঙ্গুলীকে মাইরি যা লেগেছিল না! আমাদের ল্যাংড়া চম্পাও মন্দ করেছেন বলছি না। তা, এর বাইরে দেশি-বিদেশি লিটলম্যাগাজিনে মানিকরচনা ও মানিকরুহানির সম্মানে বেশকিছু মননশীল   নিবন্ধ পড়ে অজস্র গল্পোপন্যাসের স্টোরিলাইন জেনে রেখেছিলাম অবশ্য। কোনো-একটা ম্যাগাজিনে মানিকের একটি কবিতাপাণ্ডুলিপি পড়েছিলাম একসময়, ইন্টারেস্টিং, এখনও মনে আছে সেটি সম্পাদনা করেছিলেন যুগান্তর চক্রবর্তী। ইনি সম্ভবত মানিকের মেয়েজামাই এবং নিজেও কবি হিসেবে বেশ পরিচিত পশ্চিমে। এটুকুই চিনপরিচয় মানিক ও আমার মধ্যকার।

এখন প্রশ্ন করুন আপনারা, কারো কিছু জানার থাকলে জিগ্যেশ করুন, তারপর আমরা চা-বিরতিতে যাব। ওই তো একজন হাত তুলেছেন, মুখের কাছাকাছি নিয়া যান মাইক্রোফোনটা, হ্যাঁ, এবং পদবী ও পরিচয় বিস্তারিত দিয়া সাইরা প্রশ্ন করুন সংক্ষেপে। হ্যাঁ, এত দেরি ও ধীরগতি কেন আমার মানিকপাঠে — এ-ই তো প্রশ্ন আপনার? আর কিছু? আর কেউ? অসুবিধা নাই, দুই-একটা বাত-সওয়াল হইলেই হয়, কালচার অফ সাইলেন্স ভাঙে এবং কি-নোটস প্রেজেন্টারের হ্যাপি স্মাইল এবং সেমিনারের জাস্তি টি-স্ন্যাক্স জমেও ভালো। অধিক প্রশ্ন-প্রতর্ক সেমিনারের ডেকোরাম-হানিকর এবং সর্বোপরি কন্সপিরেসি অফ মেস্ মানে কন্সপিরেসি অফ আটারেন্সের এনভায়রনমেন্ট ক্রিয়েট করে। সেইদিকে না-যাই।

দিই তবে উত্তর। কী যেন প্রশ্ন, ও হ্যাঁ, হোয়াই দিজ্ ডিলে? সে আমার মরণদশা স্বভাবের জন্যই। নামজাদা, দাম-আক্রা, ডাকাবুকো ও লোকের-মুখে-মুখে-ফেরা কামেল লেখকদের পড়তে আমি সহজে প্রবৃত্ত হই না। তাতে করে আবিষ্কারের আনন্দ ও রোমাঞ্চ পাই না বলেই হয়তো-বা। আমার পড়াশোনা, আমার পছন্দ-অপছন্দ তথা চয়নাধিকার, আমার পাঠকৃতি ইত্যাদি অন্যে ডিক্টেট করবে কেন! আমি নিজে বেছে নেব আমার করণীয়, আমার পঠনীয়। সে-যা-হোক, কেমন লেগেছিল প্রোক্ত গল্প-দুটো? এককথায়, একপাতায়, উত্তর দেয়া মুশকিল। শুধু মুশকিল নয়, প্রায় অসম্ভব। আর আমার পক্ষে হেন কাজ দুঃসাধ্য তো বটেই। কেননা আমার ভেতরের সমালোচক-সত্তাটা নেহায়েতই দুর্বল, উইক। এবং দুর্লভ আমার মধ্যে ক্রিটিকসেন্স, অন্যে বলবে কি নিজেই আমি জানি, ওই ফ্যাকাল্টিটাই আমার ভেতর গরহাজির। জনসমক্ষে এই কনফেশনের পর তো আমার জিনা হারাম হয়ে যাবে, তাই একটা আলগা ইমেজ বজায় রেখে চলিফিরি। আর্টের সুঘ্রাণ ও এসেন্স না যদি নিতে পারি তবে তো লাইফের প্রাইড বলে কিছু রইল না।

আজ্ঞে, যা বলেছেন! বক্ষ্যমাণ কথালাপে এইটুকু শুধু বলতে পারি যে, একটা-লেভেল-পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মানিকপাঠ ব্যতিরেকে এখন আর আমার উপায় নাই। এতটাই গ্রাস করে নিলেন মানিক, এই বয়সে এসে প্রায়-পড়ালেখাবিচ্যুত ও বিদ্বান-ব্যক্তিবর্গের-সাহচর্যসংশ্রবহীন আমাকে! এত বড়-কলেবরের রচনাবলি উনার, সম্ভবত বিশখণ্ড বা তারচেয়েও অধিক, পঞ্চাশও তো পুরা করে যেতে পারেন নাই আয়ুর গণনায়, এত লিখলেন কেমন করে! কাজেই, মানিকের পূর্ণাঙ্গ পড়ব মানে ম্যাজর কাজগুলাই পড়তে সচেষ্ট হব। অত বেইল তো নাই হাতে যে বুকের উপর বই নিয়া আধশোয়া শুরু করব পড়তে এবং থামব না পরীক্ষার পূর্বরাত্রি পর্যন্ত। সবকিছুতে একটা ভাটার টান টের পাই। দিনের ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না।

জাহেদ আহমদ (২০১৩)

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you