নিজের পিতার হত্যার দায়ে অভিযুক্ত (যদিও পুরো নাটকে তাকে আসামী বলে দাবি করা হয়েছে) একজন কিশোর। সাক্ষ্যপ্রমাণ সবই তার বিপক্ষে অথচ সে বলছে সে নির্দোষ! মামলার শুনানি শেষ। তথ্যপ্রমাণ সবকিছু পর্যালোচনা করাও শেষ। এখন রায় দেওয়ার পালা। তার বাঁচা-মরার সিদ্ধান্ত গিয়ে পড়ল জুরিবোর্ডের হাতে যেখানে ১২জন জুরিসদস্য আছেন। ১২জনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছেন। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ, বিচারবিশ্লেষণ সবই তারা শুনেছেন। এখন তাদের হাতে দায়িত্ব পড়েছে আসামী দোষী না নির্দোষ সেটা প্রমাণ করার।
নাটকের শুরুতেই দেখা যায় ১২জন জুরির মাঝে ১১জনই অভিযুক্ত কিশোরকে দোষী বলেই ধরে নিয়েছেন এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কক্ষ ত্যাগ করতে চাইছেন। ব্যতিক্রম শুধু একজন। তিনি জানালেন তিনি নিশ্চিত নন কিশোরটি দোষী না নির্দোষ। তার কাছে মনে হয়েছে বিচার প্রক্রিয়াটি সঠিক ছিল না। তিনি শুরু থেকে সবকিছু পুনরায় বিচারবিশ্লেষণ করে রায় দিতে চান। সেই থেকে শুরু হয়ে জুরিদের একেকজনের কাছ থেকে একেক ধরনের বিশ্লেষণে উঠে আসছিল পুরো ঘটনাটি। শেষ পর্যন্ত ১২জন জুরির বিশ্লেষণে কিশোরটি নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া পর্যন্তই এই নাটক।
সাধারণ চোখে দেখতে গেলে নাটকটি এইটুকুই। আর দশটা নাটকের মতো এখানে রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, ঠাট্টা, কান্না সবই আছে। তবুও কেন নাটকটি বিখ্যাত হলো? আমি শুধু আমার মতামতটুকু তুলে ধরছি। দর্শক হিসেবে প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গিই আলাদা। সবাই একই রকম বুঝবে সেটা আশা করাও বোকামি। তাই নিজে যেটুকু বুঝেছি সেইটুকুই বলতে চাই।
প্রথমত, মানুষকে সাধারণ চোখে যেমনটা দেখা যায় আসলেই কী সে এমন? পুরো নাটক জুড়ে এই প্রশ্নটা খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল। ১২জন মানুষ ১২টি আলাদা এলাকা থেকে এসেছেন। তাদের চিন্তাধারা ভিন্ন, অতীত ইতিহাস ভিন্ন, মতাদর্শ-জীবনাচার-দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুই ভিন্ন। তাদেরকে শুরুতে যেভাবে দেখা গিয়েছিল, ধীরে ধীরে মনে হতে লাগলো এই মানুষগুলো আসলে এমন না। মানুষের বাইরের আবরণ বাহ্যিক ব্যবহার তার পরিচয় বহন করে না, শুধুমাত্র তার অস্তিত্ব নিশ্চিত করে। আসল মানুষ লুকিয়ে থাকে মনের গহিনে। সেই মানুষটি কখনো হয় খারাপ, কখনো উদার। আর এই বোধটিই নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নাটকে।
দ্বিতীয়ত, সমাজে হরেক রকমের মানুষ থাকে। বুদ্ধিদীপ্ত, ন্যায়পরায়ণ, বিচক্ষণ, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী লোক যেমন থাকে, তেমনি থাকে রাগী, কাণ্ডজ্ঞানহীন, অবিবেচক, মেরুদণ্ডহীন, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম লোকও। এই নাটকটিতে খুবই স্পষ্টভাবে সকল চরিত্রের মানুষকে তুলে আনা হয়েছে। এখানে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ যেমন আছে, তেমনই আছে ভণ্ড, জ্ঞানপাপীও। চমৎকারভাবে এদের সকলের সঠিক সন্নিবেশন করেছেন লেখক। বোধ করি এজন্যই নাটকটি এত বিখ্যাত।
তৃতীয়ত, একজনমাত্র সুবিবেচক মানুষ কীভাবে ন্যায়ের পথে থেকে সঠিক উপায়ে অন্যদের অন্যায় সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করতে পারে তার সুন্দর উপস্থাপন এই নাটক।
একটা সুস্পষ্ট বার্তা ছিল নাটকটিতে। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে মাথা গরম করে কিংবা তাড়াহুড়া করে নেওয়া উচিত নয়। ঠান্ডা মাথায় পর্যাপ্ত বিচারবিশ্লেষণ করে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
রিজিনাল্ড রোজের এই নাটকটি আমি আগেও ইউটিউবে দেখেছি। সিনেমাটিও দেখেছি। যতবার দেখি ততবারই আমি ভাবুক হই। ভাবতে থাকি, আমি কী সত্যিকারের মানুষ হতে পারছি? সত্যিকার অর্থেই মানবতাবাদী পারছি হতে পারছি আমি? সবাই কি পারে সত্যিকারের সুচিন্তক হতে? ভাবি, ভাবতেই থাকি।

এইবার আসি সিলেটে মঞ্চায়িত হওয়া নাটক প্রসঙ্গে।
আগেই বলেছি নাটকটি আমি আগেও দেখেছি। ইউটিউবে বেশ কয়েকটি ভার্শন আছে নাটকটির। নানাভাবে উপস্থাপনার স্বাদও পেয়েছি। তাই আগ্রহ নিয়েই চিহ্নর দ্বিতীয় প্রযোজনা এই নাটকটি দেখতে যাওয়া। নাটকটি দেখার পরপরই সংক্ষেপে কিছু কথা লিখেছিলাম। তাই তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।
যেহেতু নাটকের কয়েকটি ভার্শন আমি দেখেছি তাই বলছি, ‘চিহ্ন’-র প্রযোজনায় আমি আলাদা কিছু পাইনি। আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে নির্দেশকের কোনো ‘কারিশমা’ খুঁজে পাইনি আমি। বরং অধিকাংশ জায়গাই আমি আগে দেখে ফেলেছি বলেই মনে হচ্ছিল। পরে সার্চ করে দেখলাম ইংরেজি একটা প্রযোজনার সাথে অনেকটাই মিলে গেছে এই প্রযোজনা। অনেকটাই কপি-পেস্ট মনে হয়েছে। সেই প্রযোজনার লিঙ্কটা প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এইখানে দিয়ে রাখলাম।
নাট্যনির্দেশনাগত কপি-পেস্ট একটা প্রযোজনায় ব্যবহৃত মঞ্চকুশীলব ও অভিনয়কলার ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলার আর দরকার আছে বলে মনে করি না। আশা করব চিহ্ন প্রযোজিত ‘টোয়েলভ অ্যাংরি মেন’ নাটকের সিলেট মঞ্চায়ন সেপ্টেম্বর ২০২৫ যারা দেখেছেন তারা বাংলাদেশের নিস্তেজ নাট্যচর্চা আরও সবল করবার স্বার্থে নিজেদের সুচিন্তিত মতামত জানাবেন যাতে প্রযোজনাটি পুনর্মঞ্চায়নকালে চিহ্ন কর্তৃপক্ষ পূর্বের ভুলভ্রান্তিগুলো শুধরে নিতে পারেন।
জয় হোক নাটকের। জয় হোক মানুষের।
গানপারে মঞ্চনাটক
- রিপ্রিন্ট রিফ্রেশিং - November 7, 2025
- কোচবিহার ও আব্বাসউদ্দীন - November 7, 2025
- দেবেশ রায়ের ফ্যাসিবাদের বিত্তান্ত - November 6, 2025

COMMENTS