মগরাতীরের মা-পাখির নাম পরিমল স্যার || সরোজ মোস্তফা

মগরাতীরের মা-পাখির নাম পরিমল স্যার || সরোজ মোস্তফা

এই মগরার তীরে কিংবা রূপসী বাংলায় পরিমল স্যার একজন প্রজ্ঞান শিক্ষক। চলিষ্ণু পৃথিবীর মা-পাখি। মা-পাখি ছাড়া পৃথিবীতে কেউ উড়তে শেখেনি। শেখেনি লোকবৃত্ত, ভাষা, প্রবচন ও সংস্কৃতি। সময় ও পৃথিবীর সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে ভাষা। শিক্ষক ভাষাই শেখান। প্রকৃত শিক্ষক জানেন, ভাষা ছাড়া কেউ দাঁড়াতে পারে না। কল্পনার পরিসর কিংবা সামনে তাকাতে পারে না। পরিমল স্যার এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের গণিতের ভাষা শেখাতেন। ছোট্ট এই শহরের গণিতপাখি তিনি। স্নেহ ও দরদে মা-পাখির মতো সন্তানদের ডেকে ডেকে গণিতের ভাষা শিখিয়েছেন।  স্যারের ছোট্ট আঙিনায় প্রবেশ করলে একটু একটু করে চলে যেত গণিতভীতি। শুধু শ্রেণিকক্ষ নয়, ছোট শহরের ছেলেমেয়েরা উনার চারপাশে গোলাকার হয়ে গণিতের ভাষা শিখত। স্যার বলতেন, ‘গণিত হচ্ছে কল্পনা। কল্পনায় কল্পনায় তলদেশ দেখা। কল্পনায় কল্পনায় অন্ধ পৃথিবীর জানালাগুলি খুলে খুলে দেখা’।

দুই
স্যার শিক্ষার্থীদের কল্পনার জানালা খুলে দিয়েছেন। কল্পনার চেয়ে শক্তিমান কিছু হতে পারে না। পরিমল স্যার লেবুপাতার মতো সুবাসমাখানো প্রজ্ঞার দীপ্তিতে ডাক দেয়া সহজ শিক্ষক। শাসনে-আদরে-অধিকারে-মায়ায় আমাদের তিনি গণিত শিখিয়েছেন। গণিতের সাথে বসবাস করলে এই কথা সহজেই বোঝা যায়; আজ ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ সকাল ৭.৩০ মিনিটে থেমে গেছে স্যারের জীবন। কংসের তীরে বারহাট্টার রামভদ্রপুরে পৈতৃক শ্মশানে দাহ হবে স্যারের দেহ। শ্মশানের উজ্জ্বল চিতায় কাউকেই সাথে নিলেন না তিনি। চিরযাত্রায় মানুষ কাউকেই সাথে নিতে পারে না। শুধু দিয়ে যেতে পারে। সূত্রে, সুরে, ভাষায়, দার্শনিকতায় স্যারও দিয়ে গেছেন।

তিন
মৃত্যুর মলাট চিরায়ত ও দুর্ধর্ষ। একজীবনে অনেক স্বজনকে এই মলাটে বেঁধে ফেলতে হয়। এমন ভোরও আসে, দিলদরিয়ায় নেমে আসে বিষাদতুষার! কী সুন্দর একটা জীবন আরেকটা জীবনকে চিতায় সাজিয়ে দেয়! হাত কাঁপে; ভিজে থাকে দিল; কিন্ত নিয়মের ব্যত্যয় হয় না।

প্রত্যেকটা মানুষ একটা অর্ধসমাপ্ত বাগান রেখে যান। অন্যেরা, অনুজরা, অনুগামীরা সেটা পরিপূর্ণ করেন। জীবনের শুরু আছে, কোনো সমাপ্তি নেই। জীবন চলতে থাকে। জীবন রিলেদৌড়ের মতো। পরিমল স্যার যতক্ষণ পেরেছেন দৌড়েছেন। এখন এই কাঠি অন্যের হাতে। হয়তো তার ছাত্রী তাজরী কিংবা ঈষিকার হাতে। জীবন একটা লম্বা অঙ্ক। অনেকের সম্মিলনে সেই অঙ্কটা খাতায় খাতায় উঠানো হচ্ছে। কখন থামবে, আমরা কেউ জানি না।

চার
সময় একটা আশ্চর্য ডাস্টার। সবার নামই ধীরে ধীরে মুছে দেয়। সময় মোছার আগে স্যার নিজের নামটাকে এই শহর থেকে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। কেন নিয়েছিলেন? মনে হয় অভিমান ছিল। তাজরী নামের তার কলেজপড়ুয়া এক স্টুডেন্ট বলছিল, কিছুদিন আগে স্যারের বাসায় এসেছিলাম; স্যার বলছিলেন, ‘আমি সবার জন্যই তো কতকিছু করেছি, কই আমার কথা কেউ তো কিছু বলে না’।

এটা কি আক্ষেপ! না অভিমান? এই শহরের মুক্তবুদ্ধির চর্চায়, সংস্কৃতিচর্চায়, উদীচীর প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারে পরিমল স্যারের নাম কি কেউ মুছে ফেলতে পারবে? উদীচী অফিসের বোমা হামলায় সেদিন শেলীদি, হায়দারভাই সহ আটজন শহিদ হয়েছিল। অনেকের শরীরে স্প্রিন্টার ঢুকেছিল। মনে ও মর্মরে স্যার খুব আহত হয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি আহত ছিলেন সহযাত্রীদের বিপন্নতায়। এই শহরে তিনি চুপ করে বেঁচে ছিলেন। কোনো সংস্কৃতিকর্মী স্যারকে দেখতে যাননি। কেন? স্যার তো এই বয়সে কারো সাথে পদ নিয়ে কম্পিটিশনে ছিলেন না। আজ মৃত্যুর পর এই দেখানো শ্রদ্ধানিবেদনে কিংবা পুষ্পবিতরণে কী আসে যায়! যায়! ফেইসবুকে নিজেদের কিছু ছবি আর স্ট্যাটাস দেয়া যায়। নিজেদের আত্মপ্রচারণাটা করা যায়।

স্যারকে যারা মনে রাখার তারা অবশ্যই মনে রাখবেন। গণিতের সূত্র কেউ ভুলে যায় না। গণিত একটা দর্শন। এই শহরের গণিতপাখিকে তার শিক্ষার্থীরাই মনে রাখবে। পরিমল স্যারের বাগানের সাথে যুক্ত করবে নিজেদের বাগান। স্যারের হাত থেকে নেয়া রিলের কাঠিটা নিয়ে তারা দৌড়ুতে থাকবে। তারাও হবে নতুন দিনের মা-পাখি।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you