বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ কার্যত গরহাজির দুই দশক হয়ে গেল। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচনের তোড়জোড় লক্ষ করা যাচ্ছে, দেখা যাক সেইটা জাতীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রহসন হয় নাকি রিয়্যাল হ্যাপেনিং কিছু।
বলছি পাব্লিক য়্যুনিভার্সিটিগুলোর কথা মাথায় রেখে। দেশে এরই মধ্যে প্রচুর প্রাইভেট য়্যুনিভার্সিটি হয়েছে। এই প্রাইভেট য়্যুনিভার্সিটিগুলোর ভিতরে বিস্তর ক্লাব ইত্যাদি রয়েছে, ডিবেইট ক্লাব, ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন ক্লাব, ফোটোগ্র্যাফিক সোসাইটি ইত্যাদি জিনিশের চর্চা আছে, কিন্তু ছাত্রসংসদের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না সেখানে। কেন? সংসদের একটা বলিষ্ঠ হিস্ট্রি রয়েছে যা অথোরিটি মানসিকতার জন্য সুখকর নয়।
অ্যানিওয়ে। একটা কাগুজে মুদ্রিত পত্রিকা দেখতে দেখতে এইসব কথা মাথায় আসছিল। পত্রিকাটা সাহিত্য সংসদের পক্ষ থেকে পাব্লিশড লেখা দেখতে পেয়ে ছাত্রসংসদ মনে পড়ল। সাহিত্য সংসদ আছে, বিতর্ক সংসদ থাকুক অসুবিধা নাই, সংস্কৃতি সংসদ চলতে পারে, কিন্তু ছাত্রসংসদে একটু অসুবিধা আছে।
যে-পত্রিকাটায় চোখ বুলাইতে যেতে এত কথা বলছিলাম, সেইটা ‘আলো-অন্ধকারে যাই’ শীর্ষক সুদৃশ্য ও নন্দনমানঋদ্ধ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সাহিত্যানুশীলন ও সংবেদনের শোভাযাত্রা ‘আলো-অন্ধকারে যাই’ পত্রিকাটিকে বিশেষ দ্রষ্টব্য হিশেবে উপস্থাপন করেছে নিঃসন্দেহে।
এই পত্রিকাটা ‘সাস্ট সাহিত্য সংসদ’-এর একটি নিয়মিত (অনিয়মিতভাবেই নিয়মিত) প্রকাশনা। আটপৃষ্ঠার ডিসি-ডিমাই তথা ক্রাউন্ সাইজের পত্রিকাদেহ ব্রডশিট বিন্যাসে পত্রসজ্জাগত দিক থেকে দৃষ্টিসুখকর হয়েছে। যে-ইশ্যুটা আমাদের নাগালে এসেছে এইটা ২০১৬ সনের, এরপরেও কন্টিনিউ করেছে কি না কে জানে। এ-পর্যন্ত স্ফূর্ত অনুশীলনমুখর সাহিত্যসংসদের মুখপত্রপ্রকাশনা ‘আলো-অন্ধকারে যাই’ তিনটি ইশ্যু প্রকাশিত হলেও সংসদের অন্যান্য কর্মতৎপরতা চালু রয়েছে অব্যাহতভাবে। সেইসব তৎপরতার মধ্যে রয়েছে নিয়মিতভাবে বিষয়ভিত্তিক আলোচনাচক্র সঞ্চালন, সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যক্তিভিত্তিক স্মরণ ও শ্রদ্ধার্ঘ তর্পণ, বইপড়া ও পাঠবৈঠকী আয়োজন প্রভৃতি।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কবিতা ছাপানোর পাশাপাশি পত্রিকার এই সংখ্যায় ছাপা হয়েছে দু-দুটো স্বল্পায়তন প্রবন্ধ, অনুবাদিত কবিতা এবং সংবাদভিত্তিক দুটো প্রতিবেদনসংক্ষেপ যথাক্রমে ‘সাস্ট সাহিত্য সংসদ সংবাদ’ এবং ‘সাস্ট সাহিত্য সংবাদ’ শিরোনামে। প্রকাশিত প্রবন্ধদ্বয় যথাক্রমে ‘মতাদর্শ ও নৈরাজ্য : দাসত্ব ও স্বাধীনতা’ এবং ‘প্রসঙ্গ : রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান’ শীর্ষক। দুটো গোছায় ছাপা হয়েছে ওয়ালেস্ স্টিভেন্স এবং মায়া অ্যাঞ্জেলার কবিতার বঙ্গানুবাদিত রূপ।
মূলত সাস্ট-এ (এসইউএসটি) অধ্যয়নরত ও অধ্যয়নের পাট সদ্য চুকানো শিক্ষার্থীরাই লিখেছেন পত্রিকাটায়। একটি বিশেষ অংশে সযত্ন মুদ্রিত হয়েছে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অকালপ্রয়াত শিক্ষার্থী মুহাম্মদ শাহরিয়ার মজুমদারের চারটে কবিতা, যা পত্রিকাটাকে একটা আলাদা মর্যাদায় উন্নীত করেছে।
একটু নজর দিলে পত্রিকাটা আরও পঠনবান্ধব ও নয়নশোভন হতে পারত নিশ্চয়। সেই সুযোগটা আছে এখনও, উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধি আনয়নের সুযোগ, ভবিষ্যতের সংখ্যাগুলোতে। বিশেষত ফর্ম্যাট করার বেলায় একটি লেখা থেকে আরেকটি লেখার বিন্যাসগত বিভাজিকা আরেকটু স্পষ্টরেখায় দেখানো দরকারও ছিল। রচয়িতানাম রচনার নামের নিচে রেখে এই দৃষ্টিপীড়ার ব্যাপারটা এড়ানো যেত সহজেই।
তৃতীয় সংখ্যা ‘আলো-অন্ধকারে যাই’ প্রকাশকাল ২০১৬ ফেব্রুয়ারি এবং এর মূল্য ধরা হয়েছে ১৫ টাকা। মাস্টহেডের তলায় সম্পাদকীয় সংযোগ হিশেবে মেইলঅ্যাড্রেস্ থাকলেও সশরীর যোগাযোগের জন্য পত্রিকার সমাপ্তিরেখায় ঠিকানা ‘শাবিপ্রবি গেইট, আখালিয়াঘাট, সিলেট’ ছাপা হয়েছে। কে বা কারা এর সম্পাদক কিংবা সম্পাদনাসংশ্লিষ্ট কারোর নাম ছাপা হয়নি।
সাহিত্য জিনিশটা আজকাল শাসকদের অত্যন্ত পছন্দের বিনোদন হয়ে উঠেছে, একসময় এইটা শাসকমানসিকতার উচ্ছেদে ব্যাপক ভূমিকা রাখত বোধহয়। এখন সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র প্রভৃতি জিনিশ ক্ষমতাকাঠামোর সাপোর্ট উয়িংস্ ছাড়া আর-কি। শিক্ষকরা উদ্যোগী হয়েই জিনিশগুলা পাঠশালা-বিদ্যায়তনে অ্যারেইঞ্জ ও অর্গ্যানাইজ করিয়া থাকেন। ওতে সমাজ সুন্দর থাকে, শাসকের সুবিধা হয়, দেশের বাতাস সুশীল রাখা যায়। কিন্তু ছাত্রসংসদ? সত্যিকারের ছাত্রগণতন্ত্র? স্টুডেন্টলাইফে গণতন্ত্রের সবক নেবে কেন! অসুবিধা আছে। অ্যানিওয়ে। এই কথাগুলো প্রোক্ত পত্রিকার কোথাও লেখা নাই, কিন্তু সংসদ শব্দটার উপস্থিতি চোখের সামনে দেখে এই কথাগুলো বলতে ইচ্ছে হলো, বলে ফেলা যাইল, গুস্তাকি নিয়েন না কেউ।
প্রতিবেদন / সুবর্ণ বাগচী
… …
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS