করপুটের ঈশ্বরী ও অমিত রেজা চৌধুরী || হাসান শাহরিয়ার

করপুটের ঈশ্বরী ও অমিত রেজা চৌধুরী || হাসান শাহরিয়ার

 

করপুটতল একটা আয়না,
আমার করপুট-আয়না থেকে বেরিয়ে এসো
ময়ূরের পেখমে নেমে আসা বর্ষাগোধূলির অনিশ্চয়তা ধরে,
কাঁটাঝোপে কেঁচোর মাস্তানিকে পরাগায়ন শিখিয়ে,
জাতীয়তাবাদী আদর্শে ছোট ছোট হাতের করতালি ছিটিয়ে
বেরিয়ে এসো তুমি, গল্পহীনতার অধিক।

বেরিয়ে এসো এ-হাতের ভাগ্যরেখা ছিঁড়েফুঁড়ে,
আমার দিঠি-ফুরিয়ে-আসা চিকিৎসার পিছুপিছু,
চা-বাগানে ছায়াগাছের আভিজাত্য মুছে আমার করপুটে
বেরিয়ে এসো তুমি মার্ক্সিজমের শেষ ঝাণ্ডা হয়ে,
নুহের দরিয়ায় সার্ত্রের দুপুর হয়ে, পাল্প  ফিকশনের
রহস্য হয়ে এসো তোমার তাবৎ কমফোর্ট জোন ছেড়ে

অসংখ্য নাগাসন্ন্যাসীর ভিড়ে যেমন শিবস্বয়ম্ভুকে খুঁজে পাওয়া কঠিন,
নিজের মাজারে নিত্য ছিটানোর জন্য প্রিয় খুশবুর আতর ও রুবাই
আমি লুট করেছি তোমার শরীরে আর তোমার মৌমাছিরা
ডুবুরির পিপাসায় তালাশ করে এনেছে কামার্ত উলফের জিহ্বালালা—
ধাত্রীবিদ্যার ছলে সেই প্রলোভনে আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছি তোমার
লিবিডো-করুণার ব্রিজ থেকে, যেভাবে অথৈ খাদে পড়ে যাওয়া প্যারাট্রুপার
মরতে মরতে কেবল তার ছেলেবেলায়, মা-র স্তনে
অবুঝ হয়ে ফিরতে চায়, একটিবার।

ভালোবাসলে মানুষ ওয়ায়েস  কারনির মতো অস্পষ্ট এক মোরাকাবা,
ভালোবাসলে মানুষ বোর্ডবিহীন জুয়ার ঘুটি হয়ে
পত্রিকার উপর গড়াতে গড়াতে একই খবর বারবার পড়তে থাকে,
ভালোবেসে  চশমখোর পশুব্যবসায়ীটিও নিজের একমাত্র সচল কিডনি
বিক্রি করে দেয়, নাফনদীতে হারিয়ে যাওয়া তার
পোষা কুমিরটিকে ফিরে পেতে, ফ্যাসিবাদীকে পোষ মানাবার ছলে!

অভয়ারণ্য পেরিয়ে যাওয়া তাহলে চোরাশিকারীর ট্রমাই পেরোনো!
ইনটক্সিকেটেড আলাপে তোমাকে স্মৃতিমেদুর হতেই দেখলাম,
তবু এই মনিপুরী নৃত্যালেখ্যে, কিংবা স্বজনহারানোয়…
তোমার ক্রুশভাগ্যই আমার অধিক প্রিয় ওগো বনকুঠার।

আমি নিত্য মরে যাই, নিত্য বাঁচি কেবল তোমায় ভালোবাসব  বলে,
আমি তো কেবল তোমার র‍্যাপ-গাওয়া ময়নাটার কণ্ঠ থেকে
‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই, শেষপর্যন্ত তোমাকে চাই’
গানটার প্যাথেড্রিনটুকু চুরি করতে চেয়েছিলাম!

আমার মাজারে বাৎসরিক ওরশের মিলাদ মেহফিলে
ব্যাকুল অশ্বগন্ধার চোরাবালি-আঁকা আগরবাতি জ্বালিয়ে,
আমার ফোঁটা-ফোঁটা স্নায়ুবিন্দু দিয়ে গড়া মোমবাতির আগুনে
প্রজাপতি হয়ে মরতে চেয়েছ তুমি, প্রতিবছর!
পৃথিবীর প্রতিটি শ্রেণী-অসন্তোষের দায় হয়ে,
মোমবাতি থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তবিন্দুর, জবা-পাপড়ির
ভিতরে অশ্রুত জিকির হয়ে, প্লিজ ফিরে এসো।

জেনো, এ শুধু আমার জাগ্রত রওজা নয়,
এ আমাদের ঝুলনযাত্রা, পরস্পরের অন্তর্ধান
আমার সাকার তুমি হে শ্যামাঙ্গিনী, আমার করোটির আয়ু,
তুমি আমার ফাতেমা, আমি তোমার পাগলঝরা রাসুল,
আমার লক্ষ লক্ষ সুরত, পর্দা, সহস্র মন থেকে বেছে বেছে
গড়ে তুলছ এক আশ্চর্য চাঁদমহলা — আরশেল আজিম,
তুমি আমার শহিদ — মওলা, আমি তোমার অকূল ইবলিশ

আমার তো কোনো পুণ্য, পূর্ণতা নেই, সত্যমিথ্যা নেই
কোনো জেন্ডার নাই, টীকাটিপ্পনী নাই, রুমি নাই,
জল বিনেই এক অনন্ত অন্তর্জলী যাত্রা আমি,
এই কাফেরকে এই অধীনকে কবুল করুন ওগো করপুটের ঈশ্বরী
(করপুটের  ঈশ্বরী, অমিত রেজা চৌধুরী)

সময় শুধু বিশাল একটা স্পেইস না;—সময় সাথে সাথে তার বিশাল স্পেইসের ইতিহাসও। একটা ইমেইজের দিকে তাকাইলে কী মনে হয় আপনের?—ইমেইজ একটা সময়। আবার সময় এই ইমেইজের ভিতরে একটা না,—অসংখ্য সময়ের রং ধইরা রাখে; ধইরা রাখে রঙের আঘাত। সময়ের বাইরে কী?—এই দরবারও সময়ের ভিতরে বইসা আপনে করতে পারবেন। সময় জাদুঘরের মতো। মনে হয়, একজন কবির দিকেই এই জাদুঘরের সকল বিলাপ, গৌরবও। কবি অমিত রেজা চৌধুরীর ‘করপুটের ঈশ্বরী’ কবিতাটা পড়তে পড়তে মনে হইতেছিল, সময়ের ভিতর গাঢ় আহ্বান আর গহিন আত্মসমর্পণের সাথে মুখোমুখি হইতেছি আমি এক অমাময়ী অবরোধের। মুহুর্মুহু দৃশ্য আর প্রতীকের ভারে যেই অবরোধ ইতোমধ্যে মহিমান্বিত। অতএব ‘ময়ূরের  পেখমে  নেমে  আসা  বর্ষাগোধূলির  অনিশ্চয়তা  ধরে / কাঁটাঝোপে  কেঁচোর  মাস্তানিকে  পরাগায়ন  শিখিয়ে’ পৃথিবীর যেই খরার ভিতর প্রেমের মতো কাতরের প্রার্থনা অবিরাম বৃষ্টির স্তুতি করে, শুধু সেইখানে সাড়া পাওয়া যাবে এই মিনতির; হেরার অন্ধকারে ধ্যানের তাপে।

শাদা বকের মতো কবি অমিত রেজার তপস্যা।  তবে তপস্যার ফিতরত ভিন্ন; বকের শিকার ধরার কৌশল না।  বরং এমন এক আত্মচষা লাঙলের মতো, যে তার সময়ের ক্ষয় নিয়া ভীত। করপুটের ঈশ্বরীতে তাই কবির প্রার্থনা যেন এক ভরা নিরাময়ের প্রত্যাশা। যেন এক হেকিমের প্রাণান্ত চেষ্টা। কবিতায় তাই যেইসব শব্দ আর প্রতীক রূপক হইয়া হাজির হয়, তা এমন সব সময়রে টাইনা নিয়া আসে যেই সময় নিজের আঘাতে এরমধ্যে এক অসীম অহঙ্কারের ইতিহাস। কবি যেন তার আহ্বানে ইতিহাসের এই আঘাতের প্রত্যাশা করতেছেন ফের। ‘মার্ক্সিজমের শেষ ঝান্ডা হয়ে’, ‘নুহের দরিয়ায় সার্ত্রের দুপুর হয়ে’, ‘পাল্প ফিকশনের রহস্য হয়ে’ —রূপকগুলার দিকে তাকাইলে দেখবেন, এরা নিজেরা নিজের নিজের সময়ে ছিল বিশাল ঝড়ের তান্ডবের মতো। কবির প্রার্থনা কি এই ছারখার সময়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা? ফলে অস্থির এই কবি মার্ক্সের আধুনিক সময় থেইকা একটানে নূহের ব্যাবিলনীয় সময়ে চইলা যান। ফের আধুনিক সার্ত্রের দুপুর হইয়া তারান্তিনোর পাল্প ফিকশনে সফর কইরা বেড়ান।

The path of the righteous man is beset on all sides by the inequities of the selfish and the tyranny of evil men. Blessed is he who, in the name of charity and good will, shepherds the weak through the valley of darkness, for he is truly his brother’s keeper and the finder of lost children. And I will strike down upon thee with great vengeance and furious anger those who attempt to poison and destroy my brothers. And you will know my name is the Lord when I lay my vengeance upon thee. (Ezikiel 25:17)

যেইখানে আহ্বান, সেইখানে সমর্পণের প্রশ্নও আসে। একজন বিশ্বাসী সৃষ্টির সবখানে আল্লাহর ন্যায়বিচার দেখবেন। আর যেহেতু মানুষ এই দুনিয়ায় আল্লাহর খলিফা, আল্লাহ মানুষের কাছেও এই ন্যায়বিচারই আশা কইরা থাকেন। এই ন্যায়বিচার আল্লাহর প্রতি, এই ন্যায়বিচার আল্লাহর সব সৃষ্টির প্রতি। আর আল্লাহর প্রতি মানুষের প্রথম ন্যায়বিচার হইলো আল্লাহরে নিজের রব হিসাবে মাইনা লওয়া। করপুটের ঈশ্বরীতে কবির সমর্পণ মুমূর্ষু প্যারাট্রুপারের মতো, বনিকের শেষ সম্বল বাজি ধরার মতো, ঋষির গভীর মোরাকাবায় জ্বলা তুমুল আগুনে যেইভাবে ঝলসাইয়া যায় পৃথিবীর সব প্রলোভন। কবির সমর্পণ দশ শতকের এক অ্যানোনিমাস চারণকবির লেখা ‘Dream of the Rood’-এর কাঠের টুকরার মতো, যার নিয়তি ছিল ক্রাইস্টের ক্রুসিফিকশন, যার নিয়তি ছিল পেরেকের আঘাতে রক্তাক্ত ক্রাইস্টের আর্তনাদ আর যন্ত্রণার রক্তে ভিইজা যাওয়া।

‘করপুটের ঈশ্বরী’ কবিতায় এমন এক শক্তির দিকে কবির আহ্বান, যেই শক্তি স্তুতি আর ভক্তির ভারে ক্লান্ত হইয়া পড়ে। যেই স্তুতি আর ভক্তির ভিতর সবরকম সৃষ্টির হক আর মর্যাদা রক্ষা হয় না, সেই স্তুতি আর ভক্তির প্রতি এই ঈশ্বরী যেন উদাসীন। ঈশ্বরী এইখানে ধরা দিতে রাজি না। আবার কবির কাছে, এই ঈশ্বরীর নিশ্চিত হবার মতো কোনো অবয়ব নাই। নিরাকার, কায়াশূন্য। এই ঈশ্বরী অজস্র মনের ভিতর অজস্র চেহারায় আর পর্দায় নিজেরে একরকম ব্লার কইরা রাখেন। আত্মসম্মান আর মর্যাদাবোধ যেই প্রার্থনায় নাই, এই ঈশ্বরী সেইখানে বরাবর উধাও হইয়া থাকেন। অতএব, নিপীড়িতের জিকির হইয়া কবি ঈশ্বরীর আগমনের প্রত্যাশা করেন। কবি মানবিক সম্পর্কের ভিতর এই শক্তির একটা চেহারা দাঁড় করাইতে চেষ্টা করেন। এই শক্তি রাসুল আর মেয়ে ফাতেমার সম্পর্কের মতো গভীর, প্রেমময়ী; দুই প্রাণ এক আত্মার মতো।

‘করপুটের ঈশ্বরী’ কবিতাটা কবি অমিত রেজা চৌধুরী এমন এক সুরে আগাইয়া নেন, মনে হয় দূর সমতলে কোথাও কোনো সুফির মনে বাজতেছে বাঁশি। মানে গাঢ় এক আকুতি নিয়া জিকির করতেছে সুফির আত্মা। ফলে সুস্পষ্ট এক লক্ষ্যের দিকে কবিতার বয়ান ধারাবাহিক। তবুও কবিতায় ‘অভয়ারণ্য  পেরিয়ে  যাওয়া  তাহলে  চোরাশিকারীর  ট্রমাই  পেরোনো! / ইনটক্সিকেটেড আলাপে তোমাকে স্মৃতিমেদুর হতেই দেখলাম’ … অথবা, ‘আমি  নিত্য  মরে  যাই, নিত্য  বাঁচি  কেবল  তোমায়  ভালবাসব  বলে / আমি  তো  কেবল  তোমার  র‍্যাপ-গাওয়া  ময়নাটার  কণ্ঠ  থেকে’… এইরকম কিছু জায়াগায় একাগ্রতা বা মনোযোগ কিছুটা ব্যাহত বইলা মনে হইছে আমার। কিন্তু এই কবিতা সময়ের বিশাল স্পেইস নিয়া হাজির। যেইখানে পৃথিবীর অনেক দূর প্রান্ত হইয়া এই বঙ্গের সবুজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, আকুতি সবকিছুরে একতালে নড়তে দেখা যায়। মনে হয় সবকিছু একেকটা ভারী ইমেইজে ভর কইরা কবিতার সবখানে নিজের নিজের জায়গা লইয়া সওদা করতে প্রস্তুত। ফলে এই সকাতর আহ্বান আর সমর্পণের যাত্রায় সাড়া না দিয়া আপনে দূর কোথাও পালাইয়া থাকতে পারবেন না।


হাসান শাহরিয়ার রচনারাশি
অন্যান্য
নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
আশির কবি, আশির কবিতা
আরও দ্রষ্টব্য
শামীম কবীর সংক্ষিপ্ত : কবিতার সংকলন
শামীম কবীর : বিষাদঘন শিরোনাম  

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you