চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ২৬ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ২৬ || শেখ লুৎফর

নবী শেখের একদিন

চেমননগরের গুলবাগিচায়
গোলাপ মজে ডালে ডালে,
মরিব আমি,
মরিব প্রাণনাথ।
আজ মরিতে সাধ জাগে…

পরীর আর দিন যায় না। রাত কাটে না। খেলা থাকে হাটে-মাঠে, ছাত্রদের সাথে। সে এখন দেশের কাজে মহাব্যাস্ত। সবাই বলাবলি করছে, পাকিস্তানিরা গুলি করে বাঙালিদেরকে মারতে মারতে ঢাকার শহর উজাড় করে ফেলছে! বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছে, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। তাবাদে বাঙালির রক্তে বুড়িগঙ্গার পানি নাকি লাল হয়ে উঠেছে!

ঢাকা শহর থেকে প্রাণ নিয়ে মানুষ পঙ্গপালের মতো দিগ্বিদিক পালাচ্ছে। পুবের সড়ক দিয়ে দলে দলে মানুষ আসছে ঢাকা থেকে। দিনের পর দিন শতশত মাইল হেঁটে তারা ঢাকা থেকে পালিয়ে আসছে। শহরের রাস্তায় রাস্তায় দেখে এসেছে হাজার হাজার মানুষের লাশ পড়ে আছে। কাক, কুকুরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু হুকুম করে গেছে, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়তে, যার যা আছে তা-ই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বর্তমানে দেশে এক হুরুন্টি অবস্থা। কামলা-কিষাণ সহ সব মানুষের মুখে মুখে এক জপনা, — সংগ্রাম লাগছে; স্বাধীনতার সংগ্রাম…।

ভয়-আতঙ্কে মানুষের চোখে ঘুম নাই। ঘরে ভাত থাকুক আর না থাকুক, সন্ধ্যা হলে সবাই রেডিয়োর পাশে এসে ভিড় জমায়। মাসের পর মাস বায়না নাই, রঙ্গমঞ্চ নাই। এইসব ছাড়া একজন শিল্পী কি করে বাঁচে?

এইসব ভাবতে ভাবতে পরী নদীপারের কড়ুইতলা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সে এখন কী নিয়ে বাঁচবে? রঙ্গমঞ্চের বানেছাপরী কী আর কোনোদিন মানুষের বাড়িতে গরুরাখালী করতে পারবে?

খেলা আসে রাত বারোটা-একটার পরে। হাঁটু পর্যন্ত ধুলা, খিদা-তিরাসে মুখ শুকনা-কটা, শখের বাবরিটা ধুলায় উলুঙ্গাজুলুঙ্গা। কাওরাইদ, মশাখালী, মুখীরবাজার, গফরগাঁও মাইল-কে-মাইল পথ খেলা ছাত্রদের সাথে সাথে হাঁটে। ঢাকা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা নাকি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে! এদেরকে সবাই বলছে দখলদার বাহিনী। কেউ বলছে পাকহানাদার বাহিনী।

হানাদার বাহিনীরা ট্রেনে ট্রেনে বন্দুক-কামান বোঝাই করে নাকি সারাদেশ দখল করে নিচ্ছে। এই দখলদার বাহিনীকে আটকে দেওয়ার জন্য দেশের নানান স্থানে স্থানে নাকি বীর বাঙালিরা বাঁশের লাঠি আর দুই-একটা বন্দুক সম্বল করে মুখোমুখি লড়াই করতে গিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ দিচ্ছে। এই হানাদার বাহিনী যেখানে যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে, বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে। অথচ পরী আজ সত্যি সত্যিই বানেছাপরীর মতো কুখাবনগরে বন্দিনী।

পরীর চোখ টলটল করে। খেলাবিহীন পরী জোড়ভাঙা কৈতরের মতো বেজার মনে নদীর পারে পারে একলা ঘুরে বেড়ায়। প্রাণে একটুও সুখ নাই। দেশে ঘাটুগান নাই, পরীরও কদর নাই। আগের দিন থাকলে কুখাবনগরের আমজাদ ঢালী কবে তাকে হরিয়াবাজ পাখির মতো ছোঁ মেরে উড়াল দিত।

পাটের চালান নিয়ে নবী শেখ গেছিল ভাটিতে। পনরো দিন পর আজ তার নাও গয়েশপুরের ঘাটে এসে লগি পুঁতেছে। বাজারের সেই গমগমানি নাই। নবী শেখ নাওয়ের আগা-গলুই থেকে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে নিচে নেমে মাঝিদের উদ্দেশ্যে বলে, — দিনকাল ভালা না, নাও ছাইড়্যা তাড়াতাড়ি বাড়িত্ যা। আমার আইতে দেরিং অইব।

সন্ধ্যার আগেই পাটমহাল, ধানমহাল সব খালি। মাছমহালে হাতেগনা কয়জন মানুষ। শূন্য বাজারটা মরাখলার মতো খাঁ খাঁ করছে। বিরাট বড় বড় পাটগুদামগুলার সামনের সড়ক দিয়ে নবী শেখ হন হন করে হাঁটে। এবার ছোট তালুকদারের পাটের গুদাম ভাড়া নিয়েছে ‘লতিফবাওয়ানী।’ পাটকম্পানির অফিসের পাশেই ছোট তালুকদারের গদিঘর। রাস্তা থেকেই নবী শেখের চোখে পড়ে তালুকদারের জিন্না টুপি। হাঁটার মাঝেই নবী শেখের শরীরটা রাগে জ্বলে ওঠে। সে ত্বরিৎ-পায়ে রেলসড়কের দিকে চলে আসে। সন্ধ্যার পরে মাউড়াপট্টি আর রেলসড়কে তাড়িখোররা ভিড় জমায়। রেলসড়কের পশ্চিমে মাউড়াপট্টি, পুবে ইরিধানের সেচ-প্রকল্প অফিস। মাঝখানের এই উন্মুক্ত রঙ্গমঞ্চে এসে তালের পচা রসের গন্ধে নবী শেখের জিবে কলকল করে পানি উথলায়। কাঁধে গামছা, হাতে টিনের গ্লাস, সমানে একটা করে মাটির কলস নিয়ে জনে জনে বসে আছে। কলসের চারপাশে ভোমা-নীল মাছিরা ভনভন করে উড়ছে, তাড়িখোররা বকর বকর আলাপ করছে :  পাকিস্তানি হানাদাররা রেলগাড়িতে করে, গুলিবৃষ্টি বর্ষণ করতে করতে ঢাকা থেকে সারাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে। এরই মাঝে তারা দখলে নিয়েছে, তেঁজগাও, টঙ্গী, জয়দেবপুর।

নবী শেখ ঢক ঢক করে একগ্লাস গিলে ফেলে। বসে থাকার সময় নাই। সামনে পাহাড়-পরিমাণ ঝক্কিঝামেলা। আর মাত্র এক-দেড়দিনের মধ্যে হানাদারদের সেই জংবাজ ট্রেন গুলি চালাতে চালাতে এইদিকেও চলে আসবে! ঢাকার মতো রণখলা হবে সারাদেশ।

মাগরেবের আযান হলে নবী শেখ শেষ গ্লাসটা গলায় ঢেলে দাঁড়ায়। পা টলছে। চোখের নজর ঘোলা হয়ে এলেও জানালা দিয়ে দেখা ছোটতালুকদারের জিন্নাটুপি মনের মাঝে আগুন ঢালছে। প্রতি চার-পাঁচটা চালান অন্তর অন্তর ছোটতালুকদার নবী শেখের একটা চালানের ভাড়া আটকে দেয়। এই করে করে বর্তমানে তালুকদার তার একশ সত্তুর টাকা আটকে দিয়েছে। গরিবের কসুর, সে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। ছোটতালুকদার মুসলিম লীগের ইউনিয়নপান্ডা।

নবী শেখ ছোটতালুকদারের গদিঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতরে টেবিলের উপরে একটা হারিকেন জ্বলছে। তালুকদার গদির কোলবালিশে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছে। জিন্না টুপিটা এখন মাথাতে নাই। পাশের মসজিদে মাগরিবের তিন রাকাত ফরজ নামাজের আকামদ দিচ্ছে মোয়াজ্জিন, — আল্লাহু আকবার…আল্লাহু আকবার…, তুমিই শ্রেষ্ঠ!

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কলিমদ্দি। দেড়হাত চওড়া বুকের কলিমদ্দি ছোটতালুকদারে ঘনিষ্ঠ চামুণ্ডা ও চাকর এবং সে কুকুরের মতো প্রভুভক্তও। নবী শেখ হাতে ইশারা দিয়ে কলিমদ্দিকে ডাকে। তাকে দেখেই লোকটার চোখ চকচক করে ওঠে। নবী শেখ জানে, কলিমদ্দি শুধু ছোটতালুকদারের ভক্ত না, তালের তাড়িরও ভক্ত। নবী শেখ পকেট থেকে একটা পাঁচটাকার নোট বের করে কলিমদ্দির হাতে দেয়, — মগবুলরে কৈয়া আইছি তর লাইগ্যা তাড়ি রাখত।

মগবুলের তাড়ি এই বাজারের সেরা জিনিস। সে রসের সাথে পানি মিশায় না। পাঁচটাকার তাড়ি খাইলে কলিমদ্দি আজ আর মাথা সোজা করতে পারবে না।

টাকাটা হাতে পেয়ে কলিমদ্দি একমিনিটের মাঝে হাওয়া হয়ে যায়। ছোটতালুকদার দরজার উল্টাদিকে পাশ ফিরে সিগারেট টানছে। নবী শেখ ঝুলতে ঝুলতে গিয়ে ছোট তালুকদারের চেয়ারে বসে পড়ে। বর্তমানে দেশের যা অবস্থা ছোটতালুকদারকে এখন খুন করে পালালেও কারো কিছু করার নাই। তাবাদে পাঁচ-ছ সের তাড়ির চাপে নবী শেখের তলপেটটা টনটন করছে। টেবিলে জগ-গ্লাস, সিগারেটের ছাইদানি। নবী শেখ টেবিল থেকে খালি জগটা নিয়ে নেয়। সে চেয়ারে বসে থেকেই নিচের লুঙ্গিটা তুলে ফেলে। ডান হাতে জগটা পজিশনমতো ধরে চেয়ারে বসে বসেই পেশাব করতে শুরু করে। প্রায় পানিশূন্য জগটাতে চ্যানচ্যান শব্দ হয়।

নবী শেখ জগ থেকে একচুমুক পরিমাণ পেশাব গ্লাসে ঢালে। এই ফাঁকে তালুকদার পাশ ফিরে তার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যায়। দেখতে দেখতে তালুকদারের নাক-মুখ রাগে লাল হয়ে উঠছে। তালুকদারের মতিগতি দেখে নবী শেখ কোমর থেকে ড্যাগারটা বের করে টেবিলে রাখে। ড্যাগার দেখেই তালুকদার চমকে গিয়ে চিৎকার দেয়, — এই কলিমদ্দি, কলিমদ্দি…।

নবী শেখ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, — ডাইক্যা লাভ নাই; তাড়ি খাইবার গ্যাছে।
তালুকদার ঠাণ্ডা চোখে নবী শেখের দিকে তাকিয়ে থাকে, — তুমি কি চাও?
—আমার পাওনা একশ সত্তুর ট্যাহা চাই।

নবী শেখ তালুকদারের চোখে চোখ রেখেই টেবিল থেকে ড্যাগারটা হাতে নেয়, — ভালায় ভালায় একশ সত্তুর ট্যাহা এই টেবিলে রাহেন।

তালুকদার আগেই টাকাপয়সা গোছগাছ করে রেখেছিল। আজ রাতটা গিয়ে থাকবে কলিমদ্দির বাড়িতে। কাল ভোর-বিহানে পালাবে। কিন্তু তার আগেই একটা ছালপড়া কুত্তা এসে তার চেয়ারে বসে ঘেউ ঘেউ করে তাকেই শাসাচ্ছে!

তালুকদার গুনে গুনে একশ সত্তুর টাকা টেবিলে রাখে। নবী শেখ ছোঁ মেরে টাকাটা তুলে নেয়। তারপর সে জোশের চুটে দাঁড়িয়ে পড়ে, — সারাজীবন জিন্না টুপি মাথাত্ দ্যায়া খালি পাকিস্তান পাকিস্তান যপছ আর কৈছ, শেখ মুজিব ইন্ডিয়ার দালাল। অহন কিন্তুক জয়বাংলা কৈতে অইব।

তালুকদার কিছু না বললেও চোখমুখে আগুন ঝরছে। নবী শেখ মুঠিতে শক্ত করে ধরা ড্যাগারটা তালুকদারের নাকের কাছে নাচাতে নাচাতে বলে, — আউজক্যা হয় জয়বাংলা কৈবা, নাইলে গেলাসের মুত খাইবা।
তালুকদার সিংহের মতো গর্জে ওঠে, — কি কইলে ফকিন্নির পুত?

নবী শেখ মিটি মিটি হাসে, — হয় জয়বাংলা কৈবা, না-হয় আমার মুত খাইবা। আর এক মিনিট টালবাহানা করলে ছুরিডা আস্তা ঢুহায়্যা দ্যায়াম।

নবী শেখের তাড়ির নেশা জমে উঠেছে। দুই কান দিয়ে শাঁ শাঁ করে গরম বেরোচ্ছে। ভাটি থেকে ফিরতে ফিরতে সে দেখে এসেছে মানুষের দুর্দশা, সর্বনাশ। এইসব সর্বনাশের মূলে কি তালুকদারদের হাত খুব কম?

নবী শেখ আবার গর্জে ওঠে, — তালুকদারগিরির দিন শেষ। আমরা অহন যুদ্ধ কৈর‌্যা বাংলাদেশ স্বাধীন করাম। হেই যুদ্ধডা আজকোয়া তোমারে দ্যায়া শুরু করলাম। আমি এক থাইক্যা দশ পরযন্ত কৈয়্যাম, এর ভিত্তে হয় জয়বাংলা, নাইলে মুত…।

বলতে বলতে নবী শেখ ড্যাগারটা তালুকদারের বুকের দিকে তাক করে পিটপিট করে হাসে। সে নিশ্চিত, তালুকদার তার মুত খাবে তবু জয়বাংলা বলবে না।

(সামনের পর্বে সমাপ্য)

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you