জয়ধরখালী ১৬ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ১৬ || শেখ লুৎফর

১৯৬৯-এর এক ভোরের রক্তিম আভায় জয়ধরখালী গ্রামটা হয়ে উঠেছে প্রিয়তমার রাঙিন আঁচল। হাজার হাজার পাখির কলকাকলিতে সে আড়মোড়া দিয়ে ঘুমজড়ানো চোখ মেলছে। সামনে দুইটা বলদ আর কাঁধে নাঙল-জোয়াল; হাতের হলা (গরু-তাড়ানো চিকন লাঠি) দিয়ে গরুর দাবনায় খোঁচা মারতে মারতে কৃষকেরা মুখে হেইট…হেইট  শব্দ করে, গরু তাড়িয়ে মাঠের দিকে চলে যাচ্ছে। আম-জাম-কাঁঠাল গাছ কিংবা খড়ের পুঞ্জির ফাঁক দিয়ে, একজন-দুইজন করে এসে সড়কে উঠছে ঝকঝকে চেহারার তরুণেরা। পরনে প্যান্টশার্ট। বুকপকেটে ফাউন্টেনপেন, হাতে নোটখাতা, চোখে নতুন দিনের স্বপ্ন।

দেশজোড়ে চলমান পাকিস্তানবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের মহাপ্লাবনে ভেসে যেতে চাইছে আয়ুবশাহির সিংহাসন। তারই ধারাবাহিকতায় আজও গফরগাঁও কলেজের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল করবে। সাতখামাইর, কাওরাইদ, মশাখালী থেকে এক-দেড়শ ছেলে রোজ রোজ পেসেঞ্জারি করে গফরগাঁও কলেজে পড়তে যায়। গফরগাঁও রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে ট্রেন আসার আগেই আজ অসংখ্য পুলিশ স্টেশনটা ঘিরে ফেলেছে। গেটের কাছে চেয়ার-টেবিল পেতে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বসিয়েছে। যারা বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়ে আসবে তাদেরকে গ্রেফতার করা হবে। তারপর রেলপথবিধিমতে করা হবে জেল-জরিমানা। আসলে টিকিটের কথাটা একটা উছিলা মাত্র। বাঙালিদের পাকিস্তানবিরোধী গণঅভ্যুত্থান দমন করার জন্য এইসব নানান বাহানায় সারাদেশ জুড়ে গ্রেফতার, জেল-জুলুম চলছিল।

পুলিশ রাইফেল উঁচিয়ে, গরুর বাতানের মতো তাড়িয়ে ছাত্রদেরকে নিয়ে আসলো ম্যাজিস্ট্রেটের টেবিলের কাছে। বিনা টিকিটে রেলভ্রমণের জন্য প্রত্যেককে পাঁচটাকা করে জরিমানা করা হলো। বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে ঢাকার ভাড়া পাঁচটাকা। ইচ্ছা করলে তারা জরিমানার টাকা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জমা দিয়ে মুক্তি পেতে পারে। ছাত্ররা পাঁচটাকা পাবে কোত্থেকে! একমণ ধানের দাম সাতটাকা, সাড়ে-সাতটাকা। কৃষকের ঘরের এইসব ছেলেরা খুব ভোরে লবণলঙ্কা দিয়ে একপেট পান্তাভাত খেয়ে বেরিয়েছে। ক্লাস শেষে দুপুরের ট্রেনে ফিরে গিয়ে আবার মায়ের হাতের ভাত খাবে। যদি ট্রেন আসতে দেরি হয় তাহলে চারআনা দিয়ে দুইটা শিঙ্গারার সাথে একগ্লাস পানি আর এককাপ চা খাবে। প্লাটফর্মে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে মারতে কেউ হয়তো ফস করে একটা রমনা সিগারেট ধরাবে। নিচু কণ্ঠে টেনে টেনে নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ কবিতাটা আবৃত্তি করবে। কেউ হয়তো গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠবে, ও আমার দেশের মাটি…।

কারো পকেট থেকে দুইটাকাও বেরোলো না। যাদের পকেটে পাঁচটাকা ছিল তারাও জরিমানা দিলো না; জেলে গেলে সবাই একসাথে যাবে।  তাই আবার বন্দুক উঁচিয়ে পুলিশ তাদেরকে ট্রেনে তুলল। এক-দেড়শ ছেলেদের সাথে জয়ধরখালীর লালু, ফটিক লাল, কাসেম, আবুলী, গৌরাঙ্গ, ইদ্রিস, হাবিবুর সহ বিশ-পঁচিশজনকেও ট্রেনে তোলা হয়। এদের মধ্যে লালু দীর্ঘদেহী। সকলের মাথার উপর দিয়ে ভেসে উঠেছে তার কুঁকড়া চুলে ভরা মাথাটা। গ্রেফতারের পর থেকেই সে আমোদে আছে। দেশের জন্য জেলে যাওয়া, পুলিশের হাতে নির্যাতন ভোগ করাটাও বহুত ইজ্জতের কথা। তাই পুলিশের হাতে বন্দী ছাত্রদের সকলেই একটুও মনখারাপ না করে, হাসিঠাট্টা-ইয়ার্কিতে এখন ট্রেনের কামরায় নরক গুলজার করছে। একফাঁকে লালু হাতের হ্যান্ডকাফ বাজিয়ে গাইতে শুরু করে, ‘কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট…।’

মহূর্তে ট্রেনের কামরার চেহারা পাল্টে যায়। ছেলেরা সবাই যার যার হাতের লৌহশিকল বাজিয়ে গর্জে ওঠে, কারার ওই লৌহকপাট…

দেশের সোনার টুকরা ছেলেদেরকে পুলিশে বন্দী করে জেল-হাজতে নিয়ে যাচ্ছে! এই খবরটা মুহূর্তে দিকে দিকে আগুনের লহর সমান ছড়িয়ে পড়ল। তাই আশপাশের গ্রামগুলো থেকে শতশত শিশু-নারী-পুরুষ রেলপথের পাশে ছুটে আসতে থাকে। ট্রেন ছুটে চলছে …

ঝুক্কুর ঝুক্কুর মইমনসিং
আইতে-যাইতে কতদিন।

রেলসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে নারীরা আঁচল দিয়ে ভেজাচোখ মুছছে। চ্যাংড়া পোলারা একটা কামরার দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠে, অই যে, অই যে দ্যাহ…

দরদের ভাই আর দেশের এই বীরদের জন্য মেয়েরা উড়নার কোনা দিয়ে গালের পানি মুছতে মুছতে ছাত্রভরা ট্রেনের কামরাটার দিকে আকুল চোখে তাকায়। মাঠের কাজ থেকে ছুটে আসা, দা-কুড়াল-খুন্তি হাতে, ল্যাংটিকাছা কৃষকেরা বিষণ্ণ চোখে সেই বিশেষ কামরাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পারলে তারা থাপা দিয়ে আস্ত ট্রেনটাই ধরে রেখে দেয়।

ধলা স্টেশনে আগে থেকেই ভিড় করেছিল গামছা কাঁধে উদাম গতরের শতশত কৃষক। ট্রেন থামতেই তারা ছুটে এসে ছেলেদের হাতে ধরিয়ে দিতে থাকে নিজের ঘরের পাকা কলা-আম-কাঁঠাল। কেউ কেউ জানালা দিয়ে ছাত্রদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে সিগারেট আর বিস্কুটের প্যাকেট। ময়মনসিংহ স্টেশনে পুলিশের কড়া পাহারায় ছাত্ররা ট্রেন থেকে নামে। ট্রেনের শতশত যাত্রীরা যে যা পারে স্টেশনের টং-দোকানগুলো থেকে কিনে ছাত্রদের হাতে হাতে জোর করে গুঁজে দেয়।

সেই রাতে জয়ধরখালীর ছোট-বড় কারো চোখেই ঘুম নাই। শুধু ইদ্রিস-কাসেম-হাবিবুরের মা না, জয়ধরখালীর সব মায়েরাই জেলে বন্দী ছেলেদের জন্য সারারাত নামাজ পড়ল, চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে সুর করে কোরান পড়ল, জারেজারে কাঁদতে কাঁদতে পুত্রদের মঙ্গলকামনায় খোদা-ভগমানের কাছে প্রার্থনা করল। পুরুষেরা দলবেঁধে কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে গিয়েছিল। জয়ধরখালী থেকে দশ-বারো মাইল দূরের গফরগাঁও কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। তারা এসে দেখে সারা গেরামটাই জেগে আছে।

জয়ধরখালীর এই দুর্বিপাকের কথা শুনে বিকালেই মফিনানা ছুটে আসে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলকে সান্ত্বনা দেয় : দ্যাহ, আমারে দ্যাহ; তিনদফায় পাঁচবছর জেল খাটছি বিটিশের কারাগারে। এই তোমরা কানবানা রে…কানবানা; বিনা টিগেটে গাড়ি চড়বার জন্য কেউর জেল-ফাঁসি অয় না। পাঁচ-দশদিনের হাজতবাস কিংবা দশ-বিশ টাকা জরিমানা ছাড়া আইয়ুব খান আমার নাতিগরে কিছুই করতা পারব না।

সন্ধ্যার পরে  মফিনানা আখড়ায় কিচ্ছার আসর জমিয়ে বসে : এক দেশের রাজা ছিল এক রাক্ষস। দিনে সে মাথায় হীরার মুকুট চাপিয়ে, সোনার সিংহাসনে বসে রাজ্য চালায়। আর রাত হইলে রাজা মানুষের বেশ ছেড়ে, এই আসমান উঁচা রাক্ষস হয়ে যায়। দশহাত লম্বা জিব্বাটা বেরিয়ে এসে লকলক করতে থাকে। তারপর বড় বড় পা ফেলে চলে যায় মানুষের বসতির দিকে। রোজ রাতে খাওয়ার জন্য তার একশ মানুষ চাই। রাক্ষস বনের পাশে, ক্ষীরু নদীর ধারে একটা বটগাছের নিচে হা করে বসে থাকে। তার চেলা-চামুন্ডারা গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে, রাতের অন্ধকারে মানুষ ধরে নিয়ে এসে, তার সেই বিশাল আর কুৎসিত হা-মুখের মাঝে অসহায় প্রজাদেরকে ছুঁড়ে দেয়। এইভাবে সে গ্রামের পর গ্রাম মানবশূন্য করে ফেলেছে। অবশেষে একদিন প্রজারা আসল জিনিস টের পেয়ে যায়। দিনের আলো ফুটতেই তারা তলোয়ার, সড়কি-বল্লম নিয়ে রাক্ষসপুরীতে হানা দেয়। লক্ষ লক্ষ দা-সড়কি-বল্লমের আঘাতে রাক্ষসের দেহটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

পাঁচদিন পর কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব মাথাপিছু পাঁচটাকা হারে জরিমানা দিয়ে, ছেলেদেরকে আদালত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। বিকালের ট্রেনেই জয়ধরখালীর ছেলেরা এসে কাওরাইদ স্টেশনে নামে। সুতিয়া নদীর দক্ষিণপাড়ে কাওরাইদ, উত্তরপাড়ে গয়েশপুর। সেদিন ছিল গয়েশপুর বাজারের দিন। হাজার হাজার মানুষ আয়ুবশাহির কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ছাত্রদেরকে এক-নজর দেখার জন্য গয়েশপুরের মাউড়াপট্টিতে এসে ভিড় করে। সরকারবাড়ির সিরাজ সাব তরুণ বয়সে সিরাজউদ্দৌলা নাটকে নায়ক সিরাজউদ্দৌলার পাট করতেন। তিনি বুকভরা ভালোবাসা আর মুখভরা হাসি নিয়ে, সমস্ত এলাকার পক্ষ থেকে, হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে, গেন্দাফুলের মালা দিয়ে ছেলেদেরকে বরণ করে নেন।

এই উৎসবে অঞ্চলের ছোট-বড়, জ্ঞানী-অজ্ঞান, পাপী-তাপী সকলেই এসে মিলিত হয়। শুধু আসে না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, তালুকদারবাড়ির বড়তালুকদার আর সরকারবাড়ির এহুন আলী সরকার। চাঁদতারাখচিত পাকিস্তানের পবিত্র ঝাণ্ডার নিচে তারা চিরকাল মুসলিমলীগের সম্মানীত পাণ্ডা।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you