বাচালতাভারাক্রান্ত হুমায়ূনের টেলিপ্লেগুলো

বাচালতাভারাক্রান্ত হুমায়ূনের টেলিপ্লেগুলো

বইপত্রের বাজারটা বাংলাদেশে যেটুকু উন্নত/অবনত প্রোফিটমেইকিং হয়েছে গেল তিন/চার দশকে, এর পেছনে হুমায়ূন আহমেদ একটা ক্যাটালিস্টের ভূমিকায় নেপথ্যে ছিলেন বলিয়া আমরা বাজারবিশারদদের মুখে হামেশাই শুনি। ঈদসংখ্যা আর ফেব্রুয়ারি ঘিরে গড়ে-ওঠা বাংলাদেশের বইবাজারে লেখক/ফিকশনরাইটারদের কাজে খেয়াল করলে কেবলমাত্র হুমায়ূনেরই ছায়া দেখি। বিনোদনব্যবসা বা নাটকসিনেমার বাজারেও বোতল পাল্টে একই জিনিশ হুমায়ূনপদার্থ তৈরিরই মহোৎসব। ফলে জেনারালাইজেশন হলেও কথাটা বলেই শুরু করা যায় যে বাংলাদেশের বিনোদনব্যবসায় উত্থান/ধস উভয়টাই হুমায়ূনসংলগ্ন।

হুমায়ূন আহমেদের টেলিপ্লেগুলো লক্ষ করে এগোলে — ভ্যেরি বিগিনিং টু এন্ড — একটা ব্যাপার ঠাহর হয় তাঁর পুরো রচনাজীবন সম্পর্কে। এইটা আমার হয়েছে, এইটা কাজেই প্রামাণ্য কিছু না, এখানে একটু টুকে রাখতে চাইছি। কিন্তু তথ্যপ্রমাণ-সাক্ষীসাবুদ জড়ো করে বেশ একটা ভালো ও দশাসই নিবন্ধাকৃতি জিনিশ বানিয়ে ওঠা যেত না তা নয়। যেত, দরকার মনে করছি না। আমি ডিপে যেতে পারি না, আপে থাকি, আমার বলবার কথা আমি বিঘৎখানিক জমিতেই নিতে পারব সেরে।

ব্যাপারটা হলো, হুমায়ূনরচনায় বাচালতা আর বাগবাহুল্যের অনুপ্রবেশ। কথাটা আমার মাথায় এসেছে একদম সম্প্রতি, ঠিক দানাও বাঁধে নাই ভাবনাভাবনি ঠিকমতো, পাছে ভুলে যাই তাই লিখিয়া ফালাই। ইদানীং যখন হুমায়ূন আহমেদের টিভিড্রামাগুলো হুমায়ূনপ্রয়াণের অব্যবহিত পরে মোহাফেজখানা থেকে বের করে পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে টেলিভিশনে, বিটিভির জন্মলগ্ন থেকে এ-পর্যন্ত গৃহীত কররেখায়-গণনীয় সাধু সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগগুলোর মধ্যে এইটি শীর্ষস্থানীয় সন্দেহ নেই, এর ফলে একটা সুযোগ মিলছে ছেলেবেলায়-দেখা আমার প্রিয় টিভিফিকশনগুলো পুনরীক্ষণের এবং সেইসঙ্গে বাংলাদেশের টিভিনাট্যের হিস্ট্রিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো রিক্যাপ করে দেখার। ফলে ইউটিউবে অ্যাভেইল করতে পারছি জিনিশগুলো বছরভর। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যেই কথাটা বলার জন্য এই প্রসঙ্গের অবতারণ, সুযোগ পাচ্ছি বিশেষ একভাবে তুলনামূলক অবলোকনের। হুমায়ূনের সামগ্রিক রচনাজীবন যদি দ্বিভাগ কল্পনা করি, তবে সেই অবলোকনপূর্বক তুলনা তাঁর প্রথম রচনাজীবনের সঙ্গে দ্বিতীয় রচনাজীবনের। এবং সমগ্র দেখাকর্ম, এই নিবন্ধানুচ্ছেদে, তাঁর টেলিপ্লেভিত্তিক। ফলে এইটি খুবই খণ্ডিত একটা দেখা, খোঁড়া বীক্ষণ, আগেই স্বীকার করে নিই। কিন্তু হলেও, অবলোকন টেলিপ্লেভিত্তিক হলেও, কথাগুলো হুমায়ূনের বইভিত্তিক সাহিত্য সম্পর্কেও মোর-অর-লেস প্রযোজ্য হয় আন্দাজ করি।

বাচাল চরিত্রের উপস্থিতি হুমায়ূনসাহিত্যের গোড়া থেকেই লক্ষ করা যাবে, সেইটা লাগামের আওতায় ছিল, একটা কমিক রিলিফ হিশেবে দেখা যাইত হুমায়ূনচরিত্রগুলোর বাচালতা প্রায়শ। অনেকসময় এই ফটফটে স্রেফ-চাপানোতোরে-স্বভাব কথাবাজ ক্যারেক্টারগুলোর মুখ দিয়ে তীক্ষ্ণ প্রবচনপ্রতিম কথাও বলিয়ে নিতে পারতেন রচয়িতা। শার্প কথাবার্তা সারাক্ষণ বলে গেলে সেই কথা-বলিয়ের শার্পনেসের ঠেলায় ভিরমি খায় লোকে। এবং অনিবার্য কারণবশত লোকে একসময় সেই শার্পনার মেশিনটা হাতের নাগালের দূরে রেখে চলা শুরু করে। হুমায়ূননাট্যের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে ঘটেনি বলে মনে হলেও, গরিষ্ঠাংশে সেইটা সত্য হলেও, ঘটেছে কিন্তু! মুখ ফিরিয়েছেও প্রচুর তাঁর একদা পাঁড় দর্শক, লক্ষ করেছি, বিরক্ত হয়েছে একটা বেশ বড় অংশ তাদের। খোঁড়া হলেও একটা এভিডেন্স দিচ্ছি, নিচের প্যারাগ্র্যাফে, দেখুন তো মনঃপূত হয় কি না আপনার।

হুমায়ূনজীবনের অন্তিম একদশকে ডিভিডিবাহিত হুমায়ূন ওয়ার্ল্ডট্যুর করে বেড়িয়েছেন, বিশেষত এই স্যাটেলাইটবেষ্টিত প্ল্যানেটে, এইটা বলা তো যায়ই। ইন দ্য পাস্ট ডিকেড যারা ফ্রিকোয়েন্ট বাসজার্নি করেছেন ইন্টারডিভিশন, তারা জানেন, তারা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন হুমায়ূননাট্যকীর্তি পাব্লিকপরিবহনচালকের মাথার উপর রাখা টিভিমনিটরে প্লে করার প্রতিক্রিয়ায় বাসকন্ডাক্টর লক্ষ করে ডিভিডিখানা পাল্টে প্লে করার রিকোয়েস্টসম্বলিত সম্মানিত যাত্রীসাধারণের বিরক্তিগুঞ্জন। উল্টোটা তো হুমায়ূনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকই ছিল, সজোরে কেতুকুতু দিয়া হাসানোকেও লোকে অ্যাপ্রিশিয়েট করে গেছে তাঁর ক্ষেত্রে, অ্যাডমায়ার করেছে তবু তাঁরে, এইটা কাজেই আলোচনার কিছু নয়।

দিবালোকের মতো সোজাসাপ্টা চাক্ষুষ-চক্ষুগোচর ছিল হুমায়ূনজনপ্রিয়তা, তারা পাঠক-দর্শক নয় কেবল, নন-পাঠক নন-দর্শক লোকজনও হুমায়ূনকে অজ্ঞাত কারণে নিজের ধরনে গ্রহণ করে নেন। উদাহরণ চয়ন করা যাইতে পারে। একটা আপিশের ক্যান্টিনে পাচক-পরিচারক পদে ব্যাপৃত জনাদশেক লোক টিভি দেখছিলেন, হুমায়ূনপ্রস্থানের ঠিক পরের হপ্তায়, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার টোল-পড়া হাস্য ও তার টাটকা শরীরী ইলিশঝিল্কি-মারা লাস্য, বিজ্ঞাপনবিপদকালে চ্যানেল সার্ফ করে যেয়ে আটকে গেলেন উল্লিখিত দর্শকবর্গ হুমায়ূনে। তা, তাঁর নাটক-সিনেমা না, সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন হুমায়ূন নিজে। সেখানে তিনি তাঁর আপাত-অনাকর্ষণীয় নেত্রকোণাঞ্চলিক কক্নি বাংলায় নিজের লেখালেখির পূর্বাপর বলে যাচ্ছিলেন। মোহাফেজখানা থেকে রিপ্লে দেখানো হচ্ছিল। উপস্থিত দর্শকদের কেউ হুমায়ূনবইয়ের সনে সেভাবে ওরিয়েন্টেড না তা সহজেই অনুমেয়। হুমায়ূনের লেখাপত্রের কিচ্ছুটিই তারা পড়ে দেখেন নাই কেউই। কিন্তু হুমায়ূন যে একজন বড় লেখক এইটা তাদের জানা, তারা তাঁর টিভিপ্লেগুলো যথাসাধ্যসম্ভব অদেখা যাইতে দেন না। বা অন্য কোনো কারণে যেভাবেই হোক হুমায়ূনের প্রতি তাদের আগ্রহ এতটাই যে, এমনকি প্রিয়াঙ্কাও সরে যান তাদের প্রায়োরিটিলিস্ট থেকে, এইটা যা-হোক সিগ্নিফিক্যান্ট মনে হয়েছে আমার কাছে। একজন লেখকের প্রতি নির্বিশেষ সর্বশ্রেণিমানুষের এমন ঔৎসুক্য সমাজে লেখালেখিবিকাশের সম্ভাবনা খানিকটা হলেও প্রচার করে বৈকি।

কিংবা আরেকটা উদাহরণ তোলা যাইতে পারে টেবিলে। যেমন হুমায়ূনপ্রণীত কাগুজে বইয়ের পাঠক না-হয়েও শুধু তাঁর শেষদিককার ডিভিডিধৃত টিভিপ্লেগুলোর সাবস্ক্রাইবার ছিলেন এমনকি বঙ্গজ পণ্ডিত প্রতিনিধিদেরও কেউ কেউ। অন্তত একজন এমন স্বীকারোক্তি দিবালোকে এক্সপ্রেস করেছেন যে, হুমায়ূননির্মিত অনাবিল মজাক-তামাশা-হাসিবিকিরণকারী টিভিনাট্য উপভোগ করা তাঁর ফেব্রিট প্যাস্টাইম। বলছি যার কথা মাথায় রেখে, তিনি গোলাম মুরশিদ, অবিতর্কিত পণ্ডিত ব্যক্তি তিনি এবং এখানে তা বলাও হচ্ছে সদর্থেই, হুমায়ূন-প্রস্থানোত্তর স্মৃতিচারণ ও শ্রদ্ধাতর্পণমূলক একটি লেখায় স্বীকারোক্তিটি জ্ঞাপন করছেন ডক্টর মুরশিদ। বলতে চাইছি যে, এক-ধরনের অদ্ভুতুড়ে স্ট্যাটাস-ক্যু, ওভাররেইটিং-আন্ডাররেইটিং, উত্তোলন-অবতলন, পদায়ন-পদদলন, কথিত সমালোচকদের আন্দাজিপনা আর বিবিধ ধান্দাবাজির বাইরে যেয়েও হুমায়ূনপঠনের আনন্দ-বিনোদন উপজীব্য করে একপ্রকার রিডার্স-রেস্পোন্স তথা পাঠবান্ধব ডাইজেস্ট গড়ে উঠতে পারে। কেবল সমালোচকের শাদন্তকিড়িমিড়ি, আলোচকের ওঠবস মুখব্যাদান খিস্তিখাস্তা কানমলা, আর সাহিত্যিক ও সাহিত্যপাঠকৃতি ওঠানো-বসানো-ধ্বসানো দিয়া দুনিয়া আবিল কিংবা ঋদ্ধ করিয়া রাখার কোনো মানে নাই।

কিন্তু হুমায়ূনের টিভিফিকশনগুলোতে ক্যাচরম্যাচর কথার ক্যারিক্যাচার কবে থেকে অনুপ্রবেশ করল, ব্যাপারটা সংক্ষেপে খেয়াল করা যাক। আদিতে ছিল না এমন, এইটা ক্লিয়ার। নৈরব্যের নিক্কণ শোনা যাইত তাঁর আখ্যানভাগের ভেতরে-বাইরে একসময়, স্পেস পাওয়া যাইত প্রচুর না-হলেও অনেকানেক, অল্পবিস্তর পরিসর বজায় রইত চিন্তার ও অনুভবের ও অনুভূতি-উপলব্ধিমালা জারণের, সর্বোপরি বিমোক্ষণ তথা ক্যাথার্সিস ঘটত — সমস্তই ছিল তো সংলাপ/কথাবাহিত। পরকালে, শেষের দশকে, কথা পর্যবসিত হয় বিলকুল কোলাহলে। কেবল ডামাডোল, কথাচাপে সঙ্কুচিত কল্পনাস্থান, হুমায়ূনকে তদ্দিনে পেয়ে বসেছে এলোপাথাড়ি কথার নেশায়। ভাগ্যিস, খুব বেশি দিঘল নয় এই চ্যাপ্টার, হুমায়ূনে অপচয়ী কথাকারবার শুরু হয়েছে একেবারে শেষদিকে এসে। একসময় যা ছিল হিউম্যর, যে-সংলাপ ছিল শক্তিশেল, কালক্রমে সেই শেলগুলো অতিপ্রয়োগে হয়ে দাঁড়াল কর্ণ ও মর্মপীড়নকর অত্যাচার। তৎসত্ত্বেও তাঁর নাটক ব্যবসাবাদ্য তুমুলভাবে একচেটিয়া বাজিয়ে গেছে, এর একটা কারণ হতে পারে যে মানুষ ন্যাচারালি মর্ষকামী। কিংবা আরও কারণ রয়েছে হয়তো। হুমায়ূনের টিভিপ্লেরিট হিশেবে ক্যারিয়ারের প্রথমভাগের সঙ্গে দ্বিতীয়ভাগ মিলিয়ে একটা মূল্যাঙ্কন মুসাবিদা করতে পারলে এইটা ভালো বোঝা যাবে। এইটাও মনে রাখতে হবে, প্রথমভাগের হুমায়ূন শুধু স্ক্রিপ্ট লিখে দিতেন, দৃশ্যরূপায়িত হতো অন্য কোনো নাট্যপ্রয়োগকর্তার হাতে। এই তথ্য এ-প্রাসঙ্গিক আলাপের একটা সম্ভাব্য ক্ল্যু হতে পারে। এছাড়া আরেকটা ব্যাপার, যেইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, নব্বইয়ের দশকের একেবারে শেষপাদে এসে বাচালতা বা প্রগলভতা ভর করছে হুমায়ূননাট্যে।

সেইসময়ের চারপাশে একটু মনোনিবিষ্ট চোখ রেখে এক্ষণে এমন অনুমিতিসিদ্ধান্ত হয়তোবা টানা যাবে যে, ডেমোক্রেসির একদশক ধরে হ্যাঁচড়াটানা আশাভঙ্গে বীতশ্রদ্ধ হয়েই হোক বা অন্য যে-কোনো কারণে, এপিস্টেমোলোজিক্যাল ডোমেইনে তো বটেই, ইভেন সমাজে এবং সবিশেষ নগর-পরিসরে তখন শুরু হচ্ছে ফাঁপা কথার কারবার, যা কিনা পরবর্তী দশকের রাজনীতি-সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিল্পকলা-বিদ্যায়তন সর্বত্র জাঁকিয়ে বসবে। ঠিক ওই সময়েই হুমায়ূনের দৃশ্যায়নমাধ্যমের কুশ ও লব সবাই মিলে শুরু করে অবাধে অসার ফটরফটর, মুখে যেন মশামাছিও বসে না বাছাদের! আরও লক্ষণীয়, ওই সময়েই, নব্বইনিঃশেষিত প্রথম দশকে টেরিস্ট্রিয়াল ও অন্যান্য টেলিভিশনচ্যানেল জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো শুরু করতে যাচ্ছেন তৎকালে-তরুণ প্রতিভালোকিত প্রযুক্তিদক্ষ টিভিনাট্যনির্মাতাগণ, যাদের হাতে এই বিনোদনগরিব জাতির দর্শক অপূর্বকল্পিত-অভাবিত প্রোডাকশনে আশাকরোজ্জ্বল নির্মিতিঋতু উপহার পেলেও সেই সময়সীমাটি ছিল অত্যন্ত স্বল্পমেয়াদী। অচিরে এই ভাই-ব্রো নটগোষ্ঠীর হাত থেকে বেরোতে থাকে একাদিক্রমে রঙ্গনাট্য, রগড়, পেটে-খিল-ধরানো সব রঙচঙে কেচ্ছাকাণ্ড। শুরুতে সকলের হাতে একটা আইডি সিগ্নেচারটিউন থাকলেও ক্রমে এরা একঘাটে-জলপানরত মহিষে পরিণত হন। অভিনয়ে মহানায়ক হয়ে ওঠেন মোশাররফ করিম এই সময়েই, বাকি সবাই নির্ব্যতিক্রম মহানায়কের অনুকার। নাফ নদী থেকে পিয়াইন নদী, নির্জন সুন্দরবন থেকে জনমোচ্ছব কাঁটাবন, সর্বত্র একই ভাষা একই ভঙ্গিতে কথা ও অভিব্যক্তি। শত শত জলঝর্ণার ধ্বনিচিত্র অভিন্ন, বৈচিত্র্যরহিত, শত ফুলের বাগানসম্ভবা জায়গাটা পারিজাতভরা। সাম্যবাদ কায়েম হইল অবশেষে, লেকিন ইয়া মাবুদ, ভুল জায়গায়!

এই সিলসিলায় একটা আস্ত দশক অতিক্রান্ত হলো, অনেক পেছন থেকে ইন্ডিয়ান বাংলা বাণিজ্যের বাহারী সিনেমা আবারও গল্পেশিল্পেশৈলীতে ও নির্মাণসৌকর্যে পেল্লাইপোষ্টাই হতে শুরু করল। বড় বেদনার মতো বেজে ওঠে একসময় ফের-একবার-ভরসা-জাগানো তরুণাস্থির ক্ষয়ঘণ্টা। আমরা দেখতে পাই এই সিনেমাস্বাপ্নিক প্রিপেয়ার্ড তারুণ্য থুবড়ে পড়ে সিনেমা বানাতে যেয়ে। এখানে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, দাপুটে এই তারুণ্য হয়তো হুমায়ূননাট্যের আয়ূধগুলো তথা তাঁর উইট-পান্-হিউম্যর প্রভৃতি জিনিশগুলোকে বেঁকিয়ে বিকৃত করে দিতে প্রভাব রেখেছে। কে জানে, ব্যাপারটা ভাইস-ভার্সাও হতে পারে। এই শেষোক্ত তরুণদের রগড়ভরা নাট্যকাণ্ডে চ্যাপ্টা হয়ে হুমায়ূনকর্ম অতি ফিচেল হবার মরিয়া ট্রাই করে গেছে শেষদিকে। কেননা হাসিকান্নাদুঃখের মেলোড্রামা দিয়া বাজারে রোজকার গদিটা পাকাপোক্ত রাখতে চাইছে সকলেই, নিত্যনতুন টেক্নিক বেরোচ্ছে দুধে পানি মিশাইয়া খাঁটি গোদুগ্ধ বলিয়া বাজারে বেচার, ইয়াং জেন দুধবেচুয়াদের লগে টেক্নিকে পেরে উঠতে যেয়ে হুমায়ূন নিজের নাটক-সিনেমা নামধেয় ফানআইটেমগুলোকে খেলো করে তুলেছেন অনেক বেশি। বিরক্তির চূড়ান্ত হলেও হুমায়ূনের হাত থেকে নিস্তার মেলে নাই টিভিভিয়্যুয়ারদেরে শেষ একদশক।

এখন মাঝেমাঝে মনে হয়, বিনোদনব্যবসায় তিনদশকেরও অধিক সময় কাটায়েও হুমায়ূন ন্যূনতম দাগরাখা ম্যাচিউর একটা ছায়াছবি বা ড্রামা বানাইয়া যাইতে পারেন নাই, কিন্তু তার হাতে লেখা কাহিনিগুলো, বইগুলো, লোকে বেশ আনন্দ নিয়াই পড়ে। ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানো হুমায়ূন তাহলে ব্যর্থ ম্যুভিমেইকার? পয়সাপাতি কামিয়েছেন দেদার, ব্যর্থ বলি কি করে? আবার, অন্যদিকে ভেবে দেখলে, হুমায়ূনপরবর্তী সিনেমাবানানেঅলা তারুণ্য পথ খুঁজতে খুঁজতে বুড়ো হয়ে গেল শুধু ভাইবেরাদরি আর ব্যুসান ফিল্ম ফেস্টে ছুটে, সিনেমার সরস্বতী ড্রিমভরা তারুণ্যের কাছ দিয়া যাইতে লেগেও গেলেন না, আমরা ভরসা করেছিলাম হবে এইবার বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমায় বিপ্লব, ভরসার বারোটা বাজাইলেন তৎকালীন তরুণ এই প্যাকেজনাটকমিস্ত্রীরা। ছায়াছবিনির্মাতা হুমায়ূন যদি সিনেমায় বাণিজ্যিকভাবে সফল হতেন, তাইলে এত গুচ্ছেগাদায় টিভিনাট্য প্রসবের দরকার তাঁর হতো না, একসিনেমায় তিনবছর চলার মতো পয়সা আর্ন হতো, পরবর্তী তরুণরাও হুমায়ূনের দেখাদেখি নিত্য শতপর্বের ধারাবাহিক আর দৈনিক সোপঅপেরা বানাইয়া হাত কালা করত না, যাদের মধ্যে কেউ কেউ সিনেমার নামে অ্যাড/ফ্যাশনপ্যারেড বানাইয়া জাতীয় অনুদানের পয়সাটা পানিতে ফালাইত না।

আজকে যে-তরুণ সিনেমা বানাইতে এসেছে সে যদি নিজের লেখা আগামাথাছাড়া কাহিনিচিত্রের বদলে লেখক হুমায়ূনের বা আরও যারা বাংলাদেশের খান্দানি লেখক তাদের বেস্টসেলার বইয়ের কাহিনিগুলোর চিত্রনাট্য করে, টেক্নিক্যালি ফিল্মমেইকিঙের ল্যাঙ্গুয়েজে যদি বাংলাদেশের ভালো গল্পগুলো ম্যুভিরূপান্তরে উদ্যোগী হয় আজকের তরুণ ফিল্মমেইকার, হুমায়ূন নয়া জিন্দেগি পাবেন, বাংলাদেশের উৎকট গল্পের যুক্তিপারম্পর্যহীন সিনেমা বানানোর বেদিশা ট্রেন্ডটা দূরীভূত হবে, লোক্যাল সিনেমাবাজারে একটা প্রাণ প্রতিষ্ঠা পাবে। এই ফারুকী-তৌকির-সৌদ প্রমুখ বিজ্ঞাপননির্মাতাদের ‘মৌলিক লেখক’ হবার খায়েশ একটু রদ করতে পারলে বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমার মোড় ঘুরতে পারে। বাণিজ্য ছাড়া সিনেমার মুক্তি নাই। সিনেমা স্বাধীন হবার পথে ব্যবসা যেমন অন্তরায়, তেমনি সিনেমা স্বাধীন করে তুলতে গেলে এর কমার্শিয়্যাল সাক্সেস খুব জরুরি।

লেখা : জাহেদ আহমদ

… … 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you