সবার কাছেই নিজ গ্রামের স্মৃতি অক্ষয় আর মধুর। কৃষকের বীজ আগলে রাখার মতো নিজের গ্রাম আজীবন হৃদয়ে অবিকল থেকে যায়। আমারও জন্ম থেকে যৌবনের শুরুটা কেটেছে নিজ গ্রামে। এখনো মায়ের কথা মনে হলে নিজের গ্রামের কথা মনে পড়ে। তখন পাকা-হাড়ের শরীরটা ছোট হতে হতে একেবারে পাঁচ বছরের একটা আবু হয়ে যায়।
লিকলিকে আর ত্যাঁড়াব্যাকা সুতিয়া নদীর পাশে পাশে গ্রামটাও প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে গেছে। সাথে সহবত হয়েছে মাথার চুলের মতো ঘন বাঁশঝাড়। তাদের মাঝে মাঝে বিচিত্র গাছ, লতার ঘন ঝোপ। প্রায় নিচ্ছেদ বিরাট সে-বনে পাখির কোনো অন্ত ছিল না। নানান জাতের প্রাণীও চোখে পড়ত আমুদা।
গরমের রাতে প্রায়ই ঘুম আসত না। মা পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে কিচ্ছা বলত। মায়ের কথার মাঝেই একদিন আমি জিজ্ঞেস করি, — আমাদের গ্রামের নাম জয়ধরখালী কেন?
মা বলেন, — এই গ্রামের মানুষ যেখানে যাইত জয় কইরা আসত; তাই আগের মানুষ শখ কইরা গেরামের নাম দিছিল জয়ধরখালী।
যখন আরেকটু বড় হয়েছি, হঠাৎ হঠাৎ বাবার সাথেও ঘুমাতে যাই। একদিন রাতে ঠিক এই প্রশ্নটাই বাবাকেও করলাম। বাবা কিচ্ছার মতো করে বললেন, — অনেক অনেক বছর আগের কথা, এই গেরামের ফুটবল দল ভাওয়ালের রাজার মাঠে খেলে পরপর তিনবার কাপ জিতেছিল। শেষবার রাজা খুশি অইয়া গেরামের নামটাই বদলে জয়ধরখালী কৈরা দিলো।
হিন্দু-মুসলমান প্রায় সমান সমান। একজন হোমিও ডাক্তার ছিল। ফর্সা আর হুঁতকা শরীর। দর্জির দোকানও ছিল একটা। সবই দক্ষিণের হিন্দুপাড়ায়। একেবারে শেষ দক্ষিণে রায়বাড়ি। এককালে রায়েরা জমিদার ছিলেন। এখন সব ধসে গেছে : পুকুরের ঘাট ভাঙা, সমীহ-জাগানিয়া দালানগুলা ফাটাফুটা, জোড়াতালি দেওয়া রথের চাকাগুলা আধাভাঙা, বাড়ির ভাঙা প্রাচীরটা মরা হাতির মতো হাইস্কুলের দিকে কাত হয়ে পড়ে আছে।
আমাদের বাড়ির দক্ষিণে কয়েকটা ক্ষেতের পরে পালপাড়া, দাসপাড়া, সাহাপাড়া, রায়পাড়া, যোগিপাড়া, বাজারের পাশে চামারও ছিল দুই ঘর। হিন্দুবাড়ির বিয়ে আর পূজাতেই শুধু মুসলমানরা ভিড় করত না, তাদের রক্ষার জন্য দুর্দিনে রাত জেগে পাহারাও দিয়েছে।
গ্রামের একমাত্র আখড়াটা ছিল অবনী সাহার বাড়ির পাশে। মন্দিরের সামনে পশ্চিম কোনা ঘেঁষে শতবর্ষী একটা বেলগাছ ছিল। পাশে একটা তমালগাছ। শত শত বছরের ভারে তার দেহ ন্যুব্জ। মন্দিরের পিছনে একটা বটগাছ। চারপাশে প্রাচীন পৃথিবীর সাক্ষীর মতো বিরাট বিরাট গাছ। মন্দিরের সামনের বিশাল চত্বরটা ছিল শেখপাড়া-হিন্দুপাড়ার ছোটদের খেলার মাঠ আর তমালতলাটা দুইপাড়ার আড্ডাবাজদের তাসের আস্তানা।
পূজার সপ্তাহ-দুই আগ থেকে মেলা জমে যেত। ঘাটুগান, পালাগান আর কলেজ পড়ুয়াদের শখের নাটকে প্রায় একটা মাস আমুদের শেষ ছিল না। আজান হলে যারা মসজিদে যায়, দাড়িও রেখেছে। রাত একটু ঘন হলে গামছায় মুখ বেঁধে তারাও গোপনে শামিল হতো ঘাটুগান, পালাগান কিংবা কীর্তনে।
ব্যানারে ব্যবহৃত ছবির শিল্পী সত্যজিৎ রাজন
… …
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ ৯ || শেখ লুৎফর - July 8, 2022
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৮ || শেখ লুৎফর - November 20, 2021
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৭ || শেখ লুৎফর - October 30, 2021
COMMENTS