জয়ধরখালী ১৮ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ১৮ || শেখ লুৎফর

ছয়েব আলী মিয়াকে জয়ধরখালীর মানুষ ছয়বালী ডাকে। মানুষের লম্বা লম্বা আর সুন্দর নামগুলাকে তারা এক কোদাল পরিমাণ ছেঁটে ফেলে নাগালের মধ্যে নিয়ে আসে। সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যু এইসব তাদের কাছে বিশেষ কিছু না। কলেরা-বসন্ত কিংবা সাপের ছোবলে হঠাৎ মরে যাওয়াটাও তেমন আচান্নক কোনো ঘটনা না। তারা সংসারের সহজ নিয়মে জেনেছে, জীবন চলবে জীবনের ধর্মে আর তারা চলবে বাপদাদার পায়ের দাগ ধরে ধরে। এ থেকেই তারা জগদীশ পালকে ডাকে জগা পাল; অফির মিয়াকে ডাকে অইব্ব্যা। খালবিল, নদীনালা, বনজঙ্গলের মতো হাজার বছর ধরে তাদের রক্তেও মিশে আছে এক অদম্য-আদিম প্রেম। সভ্যতার চোখে তাদের এই জীবন যতই কটু হোক তবু তারা সাপেকাটা ভাইকে কবর দিয়ে ফেরার পথে মনকে সান্ত্বনা দিতে শোনায় :

সাপে খায় ল্যাহাত ( নসীবের লিখন)
বাঘে খায় দ্যাহাত (দেখে ফেললে)

তারপর দুই-একদিন কেঁদেটেদে হাল নিয়ে মাঠে যায়, একটুতেই ক্ষ্যাপে গিয়ে গালিগালাজ করে, খায়দায়, জমিনে কামের সময় গলা ছেড়ে গান গায়।

জয়ধরখালী আখড়ার একটু আগে, মাটির সড়কের পশ্চিমে বস্তিবাঁধা দীর্ঘ পালপাড়া। আর ঠিক সড়কের পুব দিকেই তিনঘর মুসলমানের মধ্যে ছোট কিন্তু ঝকঝকা পরিষ্কার মাটির দেওয়ালের উপর, চমৎকার করে ছনে-ছাওয়া ঘরটাই ছয়বালীর। ঘরের দক্ষিণে তালপাতায়-ছাওয়া একটা বারান্দা আছে। এইটা তার পাকঘর। সামনে একচিলতে উঠান। কলাপাতার দেউড়ি ঘেঁষে একটা ডালিম গাছ। পাশেই তুলসিপাতার মস্ত ঝাড়। বাইরে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় ছয়বালী কয়টা তুলসিপাতা মুখে দিয়ে চিবায়। তাই কথা বলার সময় ঔষধির সুঘ্রাণ মিলে।

ছয়বালী ছোটখাটো চেহারার ফর্সা মানুষ। তার চিকন গোঁফের নিচে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। পরনের পরিষ্কার লুঙ্গি-গেঞ্জি কিংবা কাঁধের গামছাটাও তার সামর্থের চে বেশি দামের। ঘর থেকে বেরোবার সময় কোমরে গুঁজে গেঞ্জির তলায় লুকিয়ে সাথে একটা বাঁশিও নিবে। একটু সময় পেলে গাঙপারের নিরালায় বসে, সুরে সুরে হৃদয়টা উজাড় করে দেবে। জয়ধরখালীর ছোট-বড়ো, জোয়ান-বুড়া, নারী-পুরুষ সকলেই তার বাঁশির সমঝদার। তাই ছয়বালীর বাঁশির সুর শুনলে দুই-চারজন রসিক জুটতে বেশি সময় লাগে না।

সকালে বেরোবার সময় ছয়বালীর হাতে চকচকে ধারালো একটা দাও থাকতে পারে। ঘর বানানো, ছন দিয়ে চাল ছাওয়া কিংবা বাঁশ-বেতের নানান জিনিস বানাতে সে ওস্তাদ। মানুষের দরকারে সে শুধু শৌখিন জিনিস বানায় না; নিজেও সখিনদার মানুষ। তার ছিমছিমা পাতলা আর ছোটখাটো ফর্সা শরীরটার দিকে তাকালে অচেনা কেউ ভাবতেও পারবে না যে, চল্লিশ-উর্ধ্ব ছয়বালী দুই সন্তানের জনক। এই-যে মানুষটা শুকনা মরিচপোড়া দিয়ে একপেট লবণ-পান্তা খেয়ে সকালে বেরিয়েছিল; এখন দুপুর ধরে ধরে তবু তার মুখে লেগে আছে সকালের সেই তাজা হাসিটা।

ছয়বালী না-খেয়ে থাকলেও কারো কাছে ধার চাইবে না। দিনের পর দিন বেকার থাকলেও ক্ষেত-গিরস্তি কামে কামলা দিতে প্যাক-পানিতে নামবে না। কিন্তু সৈয়ালগিরী কাম পেলে সে বেতন নিয়ে কোনোদিন মলামলি করে না। যখন কোনো কামই থাকে না, বাঁশের বাঁশি বানাতেও মন চায় না তখন সে ইঁদুর কিংবা কাঠবিড়ালি ধরার ফাঁদ তৈরিতে মন দিবে। সুপারি-নারিকেল সহ নানান জাতের ফসল ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষার জন্য জয়ধরখালীর সকলেই তার কাছে ছুটে আসে। তখন সে মুখের নরম হাসিটা একটু চওড়া করে বলবে, ফান (ফাঁদ) পাইবা কিন্তুক কৈলাম দাম পড়ব পাঁচ ট্যাহা।

ইঁদুরের উৎপাতে ছুটে-আসা লোকটা জানে, ছয়বালীর এক ফাঁদ যাবে বছরের পর বছর, ইন্দুর পড়বে শতশত; কটিবান্দর (কাঠবিড়ালি) মরবে দশে-বিশে।

শীতকাল ফুরিয়ে আসতেই পিঠে একব্যাগ বাঁশি ফেলে ছয়বালী বেরিয়ে পড়বে। ফাগুন-চৈত-বৈশাখ এই তিন মাস মেলায় মেলায় ঘুরে তার খুব আমোদে কাটে। রুজিও হয় দুই হাত ভরে। নিজের তৈরি একেকটা বাঁশিতে সে একেক ধরনের সুর তোলে।  একখানে দশমিনিটের বেশি দাঁড়ালে ভিড় উপচে ওঠে। বাঁশি কিনুক আর না-কিনুক শুধু তার বাঁশির সুর শোনার জন্য অনেকেই সারা মেলা জুড়ে ছয়বালীর পেছন পেছন হাঁটে।

বর্ষা এলেই ছয়বালী জয়ধরখালী ছেড়ে ভৈরব চলে যাবে। সেখানে তার ইয়ারদোস্তের সীমা-সংখ্যা নাই। তার আগে সে বাঁশি বেচার বাড়তি তহবিল থেকে ঘরের জন্য পাঁচমাসের খোরাকি কিনবে। তেল-সাবান-নুন ঠিক ঠিক পরিমাণমতো বউকে বুঝিয়ে দিয়ে বিসমিল্লা বলে বেরিয়ে পড়বে। পাটকল সুপারভাইজারদের সাথেও খাতির-মহব্বত কম না। মিলের পাকিস্তানি ম্যানেজার নিজেই তার বাঁশির মহাভক্ত। মাঝে মাঝে রাত দশটার পরে ম্যানেজারের বাংলোতে ছয়বালীর ডাক পড়ে। বেতের সোফায় শরীর এলিয়ে সাহেব মদের বোতল-গেলাস নিয়ে বসেছে; — বাঁশরি বাজাও ছয়বালী; মে আগিলা মাহিনা মে তোমকু পারমানেন্ট কর-ল্যাঙ্গে। (ছয়বালী তুমি বাজাও, সামনের মাসেই তোমাকে আমি পারমান্টেট করে নেব)।

ছয়বালী হাসে। সাহেব এখন মালে টাল। শুধু পারমানেন্ট কেন আস্ত মিলটা চাইলেও কলমের একখোঁচায় তাকে দিয়ে দিবে। কিন্তু সকালে গিয়ে সামনে দাঁড়ালে ছয়বালীকে চিনতে ম্যানেজারের অনেকক্ষণ সময় লাগবে।

আগামীকাল ছয়বালী জয়ধরখালী ছেড়ে ভৈরব চলে যাবে। তার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে। নাম ফালু। ফালুর বাড়ি জয়ধরখালী থেকে পুবদিকে, কান্দিগ্রামে। তার পেশা চাষবাস হলেও নেশায় সে সাপের ওঝা। বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য সন্ধ্যার দিকে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। তার আগে হুক্কার কল্কিতে ভরে একছিলিম সিদ্ধি টেনে নেয়। বুকটা আজ খাঁ খাঁ করছে। জয়ধরখালী ছেড়ে যেতে প্রতিবারই তার এইরকম লাগে। ঝিঁঝি আর জোনাক পোকায় সন্ধ্যাটা সবেমাত্র জমে উঠেছে। গাঙপারের ক্ষুধার্ত শিয়ালগুলা ঘনঘন চিকফাক (চিৎকার) দিচ্ছে। আষাঢ়ের পূর্ণিমায়া চাঁদের জোছনায় দুনিয়াটা হয়ে উঠেছে খুবসুরত নারীর মতো রহস্যময়ী।

পুবের সড়ক দিয়ে দপ্তরিদের বাইদের (নিচু জমি) কাছে এসে ছয়বালী থমকে দাঁড়ায়। জোছনার ঝিলমিলা রোশনাইয়ে সিদ্ধির নেশাটা এখন বসন্তের মাউত্তাল হাওয়া। বাইদটা বৃষ্টির পানিতে সয়লাব। শতশত পানিব্যাঙ কেটর কেটর করে ডাকছে। শুধু ছোট মাছ নয়, পানিব্যাঙও জলঢোঁড়া সাপের পছন্দের আহার। বাইদের বাতরের গর্তগুলা তালাশ করলে নিশ্চয়ই দুই-একটা জলঢোঁড়া (নির্বিষ সাপ) সাপ মিলবে। সে যাচ্ছে বন্ধুর বাড়ি। পরানের বন্ধু সাপের ওঝা। হাতে একটা সাপ প্যাঁচিয়ে সেখানে হাজির হলে জিনিসটা খুব জুতসই হয় না?

সিদ্ধির নেশাটা চমৎকার জমেছে। তাই ছয়বালী ন্যাংটি কষে, বিসমিল্লা বলে, বাইদের হাঁটুপানিতে নেমে পড়ে। উঁচা উঁচা বাতরগুলা সারাবছর ইঁদুরে কাটে। তাই তাকে খুব বেশি পেরেশান হতে হয় না। দ্বিতীয় বাতরের প্রথম গর্তটাতে হাত দিতেই জিনিস মিলে যায়। শব্দের কম্পনের চে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারা শীতল রক্তের জীবটাকে সে ঘুমন্ত অবস্থাতেই টুঁটি চিপে ধরে কাবু করে ফেলে, আইজ খুব মাছ খাওয়া হইছে? মাছ খাইয়া খাইয়া পেটটা দ্যাহি ডুম্বুস কৈরালাইছো!

সাপটাকে এইসব বলতে বলতে সে নিশ্চিত হয়, হাত-দুইয়েক লম্বা জীবটা অবশ্যই জলঢোঁড়া। জলঢোঁড়া সাপগুলা মাছের জন্য পাগল। লখিন্দরকে দংশনের জন্য পৈদ্মাকানি (মনসা দেবী; যার একটা চোখ ট্যাঁরা বলে চান্দু সদাগর তাকে পৈদ্মাকানি বলে উপহাস করত।) সবার আগে সবচে বিষাক্ত সাপ জলঢোঁড়াকে পাঠিয়ে ছিল। জলঢোঁড়া খালপাড়ে এসে মাছের লোভে আটকে যায়। তারপর কচুপাতায় বিষ রেখে খাওয়া শুরু করে। মাছে পেট বোঝাই করে গিয়ে দ্যাখে কচুপাতায় বিষ নাই। দুনিয়ার যত বলা-ভিমরুল, পিঁপড়া-বিছা সবাই চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে।

হাত-দুইয়েক লম্বা সাপটা মুহূর্তে ছয়বালীর ডানহাতের কব্জি পেঁচিয়ে ধরে। পেটের আঁইশগুলা খাড়া করে হাতের চামড়ায় ব্লেডের মতো ধারালো চাপ দিচ্ছে। শিকার মিলেঙ্গা তো বন্ধুর বাড়ি যায়েঙ্গা, বলতে বলতে নেশায় বুঁদ ছয়বালী বাইদ থেকে সড়কে উঠে আসে।

ছয়বালীর চিকন গোঁফের নিচে নরম হাসি। কথায় বলে, ‘সিদ্ধির নাও পাহাড় বায়া যায়।’ তেমনি জোশে হাঁটতে হাঁটতে সে সাপের সাথে গপ্পো জুড়ে দেয় : বুঝলে, বন্ধুর বাড়ি যাইতাছি। বন্ধু ওঝা। সকাল হইলেই আমি পাটকলের কামে ভৈরব যাইয়াম গ্যায়া। যাইবার আগে বন্ধুরে একটা খেইল দ্যাহায়া যাইতাম চাই। দ্যাখতাম ক্যাডা বড় ওঝা; আমি না বন্ধু?

ধীরে ধীরে সাপটা তার লতানো শরীরের বাঁধগুলোকে শিকলের মতো টাইট করে বাঁধতে থাকে। হাতটা ঝিমঝিমিয়ে অবশ হতে শুরু করে। সে বাম হতে হাতড়ে হাতড়ে সাপের বাঁধনগুলো দেখে। ফ্যাংলা ফ্যাংলা মেঘ কেটে যেতেই জোছনায় দুনিয়াটা আবার ঝলমল করে ওঠে। কথায় বলে, ‘আষাঢ়ের পূর্ণিমায়া জোছনায় বিলের কই মাছ পর্যন্ত ঘুমায় না।’ তো ছয়বালী আজ কেমন করে চুপ থাকে? হাতের মাংস কেটে হাড়ে বসা সাপের বাঁধনগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে আবার সে গপ্পো জোড়ে : বুঝলে বন্ধু, একবার ভৈরব গ্যায়া দ্যাহি সাদা সাদা রাশিয়ান মানুষ বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাইতাছে। বৈকাল হইলে মেঘনার পাড়ে আইয়া তারা বাতাস খায়। ইটিং-ফিটিং-সিটিং ভাষায় কতা কয়। বৈকালডা আমার অবসর। জয়ধরখালীর গাঙপাড়ে জন্ম-কর্ম। গাঙের বাতাস আর পানি না দ্যাখলে আমার দমফোট দমফোট লাগে। হেলিগগ্যা আমি বৈকালে মেঘনার পাড়ে বৈয়্যা বাতাস খাই,বাঁশি বাজাই।

ছয়বালী এখন একটু বেশি বেগে হাঁটছে। ডান হাতটা সাপের শরীরের ঠাণ্ডা চাপে অবশ হয়ে গেছে। অবশ্য সাপটা এখন আর আগের মতো জোর খাটাচ্ছে না। একটা আচমকা পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার জন্য একটা টাইট বাঁধন দিয়ে হয়তো সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিংবা হয়তো ভেবেছে মরার মতো পড়ে থাকলে আদমের হাত থেকে সহজেই সে নিস্তার পাবে। অথবা কী সে ছয়বালীর দিলখুশ-গপ্পো শুনতে শুনতে শত্রুতা ভুলে গেছে!

নতুন উৎসাহে ছয়বালী সাপটার শরীরে মোলায়েম ভাবে হাত বোলায় আর গপ্পো জোড়ে : তে বুঝলে বন্ধু, দ্বিতীয় দিনই দ্যাহি বৈকাল টাইমে মেঘনার পাড়ে সাদা মানুষের সংখ্যা অনেক বাইড়্যা গ্যাছে। সাথে মেয়েলোকও আছে। এই এই লাম্বা হুর-পরীর মতন একেকটা মেয়েলোক। বাঁশিত টান দিতেই হেরা সবাই আমার চৌপাশে ঘিরাট দ্যায়া বসে। টিনের কৌট্টাভরা মদ খায় আর ঝিমায়া ঝিমায়া বাঁশির সুর হুনে। চইলা যাইবার সময় ট্যাহা দিতে চায়। আমি লই না। নাতাশা নামের পাঁচ আত (হাত) লাম্বা মেয়েলোকটা বাঁশি হুনতে হুনতে চৌখ মুছে। মাঝে মাঝে ডিঙ্গিনাও ভাড়া কৈরা আমারে লইয়া মেঘনায় ভাইস্যা যায়। সারা রাইত তার কোলের কাছে আমারে বসায়া বাঁশি হুনে। এর মাঝেই হে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কয়ডা বাংলা কতা শিখে ফেলেছে। এখন হাইঞ্জা নাই, মাঝরাইত নাই যখন-তখন আমার ঘরে আইয়া হাজির হয়। মাঝে মাঝে আমারে পুতুলের মতন জড়ায়া ধইরা কয়, আমি টোমারে ভালোবাছি। আষাঢ়ের বিশ তারিখ গ্যাছিলাম; ঠিক করলাম আঘুন মাসে ফিইর‌্যা আইয়াম। কতাডা নাতাশারে জানাইতে হে মেঘলা আসমানের মতন মলিন অইয়া গ্যালো। আইবার আগেরদিন রাইতে তার কী কান্দুন! শেষমেষ আমারে কৈল তার লগে রাশিয়া যাইতে। তারে আমি কৈলাম, দ্যাখ, তুই মইরা গ্যালেও আমি দেশত্যাগী হইতাম না। তর দেশের গাঙপাড়ে এইরহম বাতাস আছে? আসমানে চান উঠলে গাঙ্গের বুক বারো মাস এইরহম ঝিকমিক করে?

ছয়বালী অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে সাপের বাঁধনগুলা আলতো করে পরখ করে। জীবটার খসখসা ঠাণ্ডা শরীরে বার বার হাত বুলিয়ে আদর করে : বুঝলে, আমার বন্ধু ওঝা। খুব তার বড়াই। দ্যাহা-সাক্ষাৎ হইলেই লাম্বা লাম্বা গপ্পো মারে। তারে আইজ একটু চমকায়া দিতে অইব।

সাপটা বুঝি ইচ্ছা করেই তার কঠিন বাঁধনগুলা আলগা করে দিয়েছে। হাতটা এখন আর আগের মতো ঠাণ্ডা পাত্থর পাত্থর লাগছে না। ছয়বালীও অকৃতজ্ঞ না। তাই সে সাপটার সারা শরীরে যতন করে হাত বোলায় : আরেকটু সইহ্য (সহ্য) কর। তরে আমি খাঁচার ভিত্তে ঘুম পাতায়া বন্ধুর উঠানে বাঁশি বাজায়াম। দ্যাখবে বাঁশির সুরে ঘুম কত মধুর অয়।

ফালুকে তার বাড়ির উঠানেই পাওয়া গেলো। গপ্পোবাজ মানুষ ফকফকা জোছনায় উঠানে বসে ইয়ার-দোস্তদের সাথে বিড়ি টানছে আর গপ্পো মারছে। কালাই-বিলের দিক থেকে কলকল করে হাওয়া আসছে। উঠানে পা দিয়েই ছয়বালী ডেকে ওঠে, ফালু কৈ? দ্যাখ তর লগে দ্যাহা করার লাইগ্যা ক্যাডা আইছে।

ফালু উঠে গিয়ে ঘর থেকে কুপি বাতিটা নিয়ে আসে। বাতির ম্যাড়ম্যাড়া লাল আলোতে উস্থিত সকলেই দেখে, ছয়বালীর হাতে পেঁচ দিয়ে ধরা বিজাতীয় জীবটা গোক্ষুর সাপ!

ছয়বালীও মনে মনে ধাক্কা খায়। কিন্তু পলকেই নিজেকে সামলে ফেলে সাপের মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, যা আছে কপালে, আইজ কিন্তুক খৈল দিতে অইব।

ছয়বালীর হাবভাব, কথাবর্তায় উপস্থিত সকলেই ভড়কে যায়। ফালু হাউমাউ করে লাফিয়ে উঠে, এইডা কী করছত্? জাতিসাপ ধইরা লইয়া আইছত! অহন তরে আমি ক্যামনে বাচাই?

হাঁকডাক, হুলস্থুল কাণ্ডে সাপটার বুঝি নিদ্রা টুটে যায় কিংবা ছয়বালীর ওপর ধীরে ধীরে গড়ে উঠা আস্থাটা হঠাৎ ভেঙে পড়ে খান খান। এই বিকট পরিস্থিতি ও অনিশ্চিত আতঙ্কে সে আবার তার লতানো শরীরটাকে শিকলের মতো টাইট দিতে থাকে। এই সংকেতে ছয়বালীও চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে, তুই ওঝা ন ওঝার চুদা? এই এত্তানি ছোডু একটা সাপ দ্যাইখ্যা ডরে বান্দরের মতন লাফাছ!

ফালু একদৌড়ে ঘর থেকে ধানকাটার একটা কাঁচি নিয়ে ছুটে আসে। কাঁচি দেখেই সে একলাফে তিনহাত পিছিয়ে যায়, যুদিন সাপের শৈল্ল্যে কাচি লাগাইবে তে কিন্তুক খুব মশকিল অইব।

এই কথায় ফালু থমকে দাঁড়ায়। উপস্থিত সকলেই পাগলের মতো চেঁচাতে শুরু করে, দ্যাখ তর চৌখ-মুখ ক্যামুন নীল অইয়া গ্যাছে। এক মিনিটের মইধ্যে তুই বেচেত অইয়া মৈরা যাইবে।

ছয়বালী আর কোনো কথা বলে না। সে সাপের শরীরটায় ধীরে ধীরে হাত বুলায়। স্বজনের মতো ভরসা দেয়। এবং এই ভাবেই সে আস্তে আস্তে বিলপাড়ের দিকে একলা সরে আসে। সাপটা আবার ধীরে ধীরে তার বাঁধনগুলা আলগা করে দিচ্ছে। এবার সে বাম হাতে সাপের লেজটা ধরে আস্তে আস্তে পেঁচ খুলতে থাকে। তারপর এক ঝটকায় সাপটাকে একটা আকন্দ ঝোপে ছেড়ে দিয়ে, হো হো করে হাসতে হাসতে ফালুকে শুনিয়ে সাপটাকে বলে, চইলা যা, তাড়াতাড়ি চইলা যা, ওঝা তরে খুব ডরাইছে।

ছয়বালীর এই কথায় ফালুর উঠানে আচান্নক নীরবতা নেমে আসে।

বিলপার থেকে ফিরে আসার সময় জোছনার জোয়ারে আর পুবাল হাওয়ার শনশন মাতনে ছয়বালী একটুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। সাদা দবদবা চাঁদটার দিকে তাকিয়ে তার জানতে বড়ো ইচ্ছা করে, শিশুর মতন নরম মনের নাতাশা অহন কই?

তারপর বিলপাড় থেকে ফালুর উঠানের দিকে ফিরে আসতে আসতে ছয়বালীর হঠাৎ মনে হয়, শুধু নাতাশা না; জগতের সব প্রিয়তমারাই শিশুর মতন নরম আর নিষ্পাপ হয়।

প্রিভিয়াসলি অন জ য় ধ র খা লী

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you