জয়ধরখালী ১৯ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ১৯ || শেখ লুৎফর

নাম তার চান্দু মড়ল। তাই বলে মনে করার কোনো কারণ নাই যে রূপ-চেহারায় সে চান্দের মতন এক পুরুষ। সত্তর বছর পেরিয়ে আসা একজন রগচটা বুড়ো সে। একটু উনিশ-বিশ হলেই ক্ষ্যাপে গিয়ে খাউ খাউ শুরু করে। বেমানান লম্বা আর কাচা-পাকা লোমশ হাতদুইটা নাচিয়ে নাচিয়ে হাঁটার সময় থপ থপ শব্দ হয়, মাটি কাঁপে। গাট্টাগোট্টা গতরটায় এখনো অসুরের শক্তি রাখে। শরীরের কালো আর খসখসা চামড়াটা মহিষের পিঠের মতো টানটান। দেহের তুলনায় মাথাটা ছোট। ছোট আর গোলগোল চোখদুইটাতে একটা রুক্ষতা সবসময় জ্বলজ্বল করে। থুতনির দাড়িগুলা চৌদ্দআনা সাদা হলেও একটা দাঁতও পড়েনি।

‘দাঁত ভালো যার / আঁত ভালো তার’ — এই শর্তে চান্দু মড়লের হজমশক্তি আর চোখের নজরটাও বিলপাড়ের চিলের মতো ধারালো। থ্যাবড়া পা দুইটার ফাটাফাটা গোড়ালিতে সারাবছর খোদার জমিনের কালো মাটি আটকে থাকে। এই লোকটাই ওইল্ল্যা মড়ল।

জয়ধরখালীর মানুষ অণ্ডকোষের ঝোলাটাকে ওল বলে। ওইল্ল্যা মড়ল রোজ রোজ সকালে গাঙপাড়ের জংলায় হাগু দিয়ে, লুঙ্গিটা উপরে তুলেই গাঙের হাঁটু সমান পানিতে নেমে আসে। তারপর উবু হয়ে পাছা ধুতে থাকে। ঠিক যেন তিনমণ ওজনের একটা শিম্পাঞ্জি। গহিন বনের আদিম পৃথিবী থেকে এইমাত্র নেমে এসেছে। বাম হাত দিয়ে খেপে খেপে গাঙের পানি নিয়ে ঘষে ঘষে পাছা ধুয়ে চলছে। ঘষার তালে তালে বুড়োর শরীরটা সামনে-পিছে দোলে। দোলার ছন্দে তার বিরাট বড়ো ওলটাও দুলবে। সাথে টাট্টুর মতো মস্ত আর কালো চকচকে লিঙ্গটা তো দুলবেই। এই থেকেই চান্দু মড়লের নাম হয়ে গেল ওইল্ল্যা মড়ল।

ওইল্ল্যা মড়লের বাড়ি সুতিয়া নদীর ওপারে। নিত্য নিত্য তার নির্লজ্জ-আদিমতার উত্তাপ জয়ধরখালীকেও মাঝেমাঝে উত্তপ্ত করে। তাই জয়ধরখালীর কথকতায় ওইল্ল্যা মড়ল অবিচ্ছেদ্য।

জয়ধরখালীর পালপাড়ার ঠিক বিপরীতে ওইল্ল্যা মড়লের বাড়ি। গাঙপাড়ের জংলা, গাঙের ঘাট। মাঝে এক চিলতে সুতিয়া নদী। ভোর হতেই পালদের ঘাটে ঘাটে মেয়েরা নেমে আসে। কেউ কলসি নিয়ে এসেছে পানি নিতে। কেউ রাতে স্বামীর সোহাগ খেয়েছিল তাই এখন ভোর ভোর গোসল করতে এসেছে। কেউ কেউ ঘাটে এসেছে হাড়ি-পাতিল নিয়ে। পালাপাড়ার বাঁশঝাড় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বকপাখিরা বিল-বিলান্তের দিকে উড়ে যাচ্ছে। ভোরের শান্তি শান্তি নীল আসমানটা ছেয়ে গেছে শতশত বকের সাদা ডানায়। ওইল্ল্যা মড়লের কীর্তি দেখে পালপাড়ার মেয়েরা ঘাটে বসেই মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখে। মেয়ে-মহিলারা চোখ ঠারাঠারি করে, আবিল আনন্দে চুপে চুপে হাসে। কেউ কেউ মন্তব্য করে, বুইড়্যাডা পুংটা; দ্যাখ কীরহম ট্যারায়া ট্যারায়া আমগরে দ্যাহে।

নরেশের বউ খুব চালাক-চতুর মেয়ে, জগতের সব বিষয়েই সে একটু বেশি খোঁজখবর রাখে। সে বলে, হুনছি মাইনশ্যে কয়, ওইল্ল্যা মড়ল অহনও নাকি ল্যাঙ্গির কাছে গ্যায়া বইয়া থাহে।

ল্যাঙ্গি হলো স্বামীপরিত্যাক্তা মাঝবয়েসী এক নারী। একটা পা একটু খাটো। তাই সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। মড়লপাড়ার পশ্চিমে, নির্জন বিলপাড়ের উঁচু কান্দায় তার বাড়ি। গেরামের জোয়ান-বুড়া অনেকেই দরকারমতো চার-ছআনা খরচ করে ল্যাঙ্গির বাড়ি ঘুরে আসে।

নরেশের বউ ফিসফিস করে অমলের বউকে আবার বলে, জানো স, ওইল্ল্যা মড়ল ল্যাঙ্গির বাড়িত গ্যায়া হুঁক্কা টানে আর নাকি ল্যাঙ্গির জাম্বুরা আতায়।

বেশি ভাত খেয়েই হোক আর গ্রামের লুচ্চাদের আদর খেয়েই হোক ল্যাঙ্গির সামনদিকটা খুব পুরুষ্ট আর নজরকাড়া।

রোজ রোজ সকালে যখন ওইল্ল্যা মড়ল তার ওলের নাচন দেখায় তখন পালপাড়ার খিচর (পাজি) পুরুষদের কেউ কেউ মুখ আড়াল করে জোরে জোরে গলা খাঁকারি দেয়। কেউ কেউ গলা ছেড়ে খামাখাই ‘জাম্বুরা! জাম্বুরা!’ বলে চেঁচায়। তখন ওইল্ল্যা মড়ল গালিগালাজের তুফান ছুটায়, কোন নডির পুত জাম্বুরা কয় রে, কবে আমি তর মার বুনি টিপছিলাম?

ওইল্ল্যা বুড়োর এইসব গলাবাজিতে পালপাড়ার কেউ রাগ করে না; কোনো জবাবও দেয় না। তার বদলে গাঙপাড়ের ঘাটে ঘাটে এতক্ষণ আটকে রাখা হাসির গমকে মহিলারা খিলখিল করে ঢলে পড়ে।

পরেশ পাল রাগী মানুষ। শরীরটাও সেইরকম তাগড়া। মাটির বোঝা আর পাতিলের বোঝা টানতে টানতে গতরটা চিতাবাঘের মতো শক্তিধর। সে বিয়ে করেছে মাত্র তিন-চারমাস আগে। ছোটকাল থেকে সে ওইল্ল্যা মড়লের ওল দেখে আসছে। কিন্তু কোনোদিন তার কাছে জিনিসটা আজকের মতো এত জঘন্য লাগেনি। বউটা মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝি তার পৌরুষের দুর্বলতা আর পালদের অসহায়ত্বের বিরুদ্ধে তার বউয়ের কালো চোখদুইটা জ্বলজ্বল করে ধিক্কার দিচ্ছে!

পরেশের মগজটা দপ করে জ্বলে ওঠে। সে রুক্ষ-কঠিন গলায় অসম্ভব জোরে একটা গলাখাঁকারি দেয়। ওইল্ল্যা মড়লকে নিয়ে গাঙপাড়ের ঘাটে ঘাটে চিটকিবিটকি চলে, হাসিঠাট্টা চলে, কেউ কেউ গলাখাঁকারিও দেয় কিন্তু পরেশের মতো এতটা আক্রমণাত্বক নয়। পরেশের অবদমিত রাগ-ঘৃণার ক্রুদ্ধ-কঠিন গর্জনে ওইল্ল্যা মড়ল চট করে মাথা তোলে। গোল গোল চোখদুইটা মুহূর্তে বুনো জন্তুর উল্লাসে ঝলসে ওঠে। জোয়ান জোয়ান সাতটা ছেলে তার। বস্তিবাঁধা পাড়াটাও মড়লদের। একজনে তিনজনের ভাত খায়। ডাইনে গাঙ, বাঁয়ে বিল; সারাবছর মাছে করে কিলবিল। যত ইচ্ছা ধরো আর খাও। সারা বিলপাড়ের কান্দায় কান্দায় আর মড়লদের বাড়ির আশপাশে শুধু কাঁঠালগাছ আর কাঁঠালগাছ। চৈতের শুরু থেকে কাঁঠাল পাকা শুরু হয় আর শেষ হয় শাওন-ভাদ্দর মাসে। রোজ রোজ সকালে হাগুটাগু দিয়ে পেট খালি করে একেকজন মড়ল আস্ত-একটা করে কাঁঠাল খায়। মড়লদের রেওয়াজটাই এইরকম, যে যে-কাঁঠাল ভাঙবে সে সেটা খেয়ে শেষ করবে।

এক বরোধান ছাড়া আর কোনো ফসল নাই। নাস্তার সময় জামড়িবরন ধানের সুমিষ্ট জাউ আর সানকি সানকি কাঁঠালের কোয়া; দুপুরে টেপির চালের মিঠা মিঠা ভাত আর ছোট-বড় মাছের নানান পদের ঝাল তরকারি। সুরুজটা একটু পশ্চিমে কাত হতেই বিলপাড়ের পতিত পালানে বাপে-পুতে-ভাইয়ে মিলে শুরু করে দেয় ফুটবল-হাডুডুডু-দাড়িয়াবান্দা খেলা। একজন আরেকজনকে ডাকলে কিংবা বউকে গালি দিলে পালপাড়া থেকে পষ্ট শোনা যায়। এই গব্দা-গব্দা হাতপা, এ্যাবাড্যাবা নাকমুখ, মোটা-মোটা হাড্ডির ভরাট স্বাস্থ্যের মানুষগুলা একটুতেই রাগে গরর..গর শুরু করে।

পরেশ আরেকটা গলাখাঁকারি দিয়ে বুড়োর কাছে জানতে চায়, গাঙ্গের পানি আর কত হিচবাইন (সেচ দিবেন)? গাঙ কী হুগায়ালবাইন (শুকিয়ে ফেলবেন)?

এইবার বুড়ো সোজা হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু পেটের সাথে চেপে-রাখা লুঙ্গিটা নিচে নামায় না। পরেশের কথায় ঘাটের সব মেয়ে-মহিলারা বুড়োর দিকে তাকিয়েছিল তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। তাই এইবার শুধু ওল নয় কালো চকচকে টাট্টু সাইজ যন্ত্রটাও সকলে দেখে। বুড়ো পরেশের দিকে খেঁকিয়ে ওঠে, তর কী অসুবিধা?

পরেশ রাগে অন্ধ হয়ে গেছে; তাই আজ জীবন কী মৃত্যু। তার বাঘা শরীরটা শূন্যে লাফিয়ে উঠতে চায়, আমরা পালেরা ত মানুষ না; আমগর আর কী অসুবিধা অইব!

বুড়োর ওলে বুঝি পরেশ বিড়ির আগুনের ছ্যাঁকা দিয়েছে তেমনি করে সে লাফিয়ে ওঠে, আমারে এই কতা জিগাইবার তুই ক্যাডা?

হিতাহিতশূন্য পরেশ রাগে কাঁপতে কাঁপতে একদৌড়ে ঘাটে নেমে আসে, আমগর মা-বউ আছে, ঘিন্না-শরম আছে।

পরেশের এই কথায় গর্জাতে গর্জাতে বুড়ো একটানে লুঙ্গিটা খুলে মাথায় পাগড়ি বেঁধে ফেলে, অতবড় মা-বউওয়ালা ব্যাডা অইছৎ তে জাগাত থাহিছ।

একে তো সুতিয়া নদী ছিপছিপা চিকন তার ওপর ঠিকমতো বর্ষা এখনো শুরু হয়নি। তাই মাঝগাঙে কোমর-সমান পানি। বুড়ো সাঁ সাঁ করে পানি চিরে পরেশের দিকে ছুটে আসছে!

 ভেড়ার পালে বাঘ লাফিয়ে পড়ার মতো পালপাড়ার ঘাটে ঘাটে মেয়েদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একে তো তারা হিন্দু তার ওপর গরিব পাল। তাই ছুটে-আসা ওইল্ল্যা মড়লের দানবীয় গর্জনে তাদের পায়ের নিচের নরম মাটি হড়কে যায়। ফলে তাদের ভয়ার্ত চিৎকার-চেঁচামেচিতে গাঙের দুইপাড়েই নারী-পুরুষের ভিড় জমে ওঠে। কালা মিয়া মড়লও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। সে ওইল্ল্যা মড়লের ভাতিজা এবং ইউপিমেম্বার। লেখাপড়াও করেছে কিছুটা। গ্রামে বিচার-সালিশ করে। হককথা বলতে বাপকেও ছাড়ে না। দরকারমতো অপরাধীর পাছায় বেতও মারে। সে পালপাড়ার মেয়েদের আতঙ্ক-আর্তনাদে সোজা গাঙের ঘাটে এসে দাঁড়ায়।

উলঙ্গ, উবস্ত্র বুড়ো তখন মাঝনদীর কোমর-সমান পানি চিরে পরেশের দিকে ছুটছে। কালা মিয়ার মাথায় চিড়িক করে আগুন জ্বলে ওঠে। ছোটকাল থেকে সে এ-ই দেখে আসছে। এখন মানুষটার মরবার কাল তবু খাছিলত একটুও বদলালো না। সে বাড়ির দিকে মুখ করে গর্জে ওঠে, মাজেদ কই রে? মাজেদ…, একটা দড়ি লইয়া আয়; পাগলরে নিয়া বাড়িত বাইন্দ্যা রাহি।

মাজেদ হলো ওইল্ল্যা বুড়োর বড় ছেলে। তাকে এই হুকুম দিয়ে কালা মড়ল আর দাঁড়ায় না। কালা মড়লের গর্জনে ওইল্ল্যা মড়ল মাঝগাঙে থমকে দাঁড়ায়। তারপর দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে একান্ত অনিচ্ছায় নিজের ঘাটে ফিরে আসে।

এই ঘটনায় পালপাড়ার ছোট-বড় সকলেই শুধু খুশি না, মহাখুশি। কেউ বলছে, ওইল্ল্যা মড়ল আইজ খুব জব্দ হইছে।

কেউ বলছে, — হায়াশরম থাকলে এইবার স্বভাবটা বদলাইব।

পরেশ পাল গাঙের পানিতে নামতে নামতে একটু জোরেই বলে, —

শুঁটকির বয় যায় না ধুইলে,
কমিনের লয় যায় না মইলে।

তারপর গাঙের পানিতে ভুরুৎ ভুরুৎ কয়টা ডুব দিয়ে পরেশ বুঝি শরীর-মনের সব গলিজ-ঘিন্না ধুয়ে ফেলতে চায়!

প্রিভিয়াসলি অন জয়ধরখালী

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you