জয়ধরখালী ২২ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ২২ || শেখ লুৎফর

আষাঢ়-শ্রাবণ মাস এলে সুতিয়া নদীর পাড় ধরে উত্তর দিক থেকে শুয়রের বাথান আসে। বর্ষার শুরুতে রংপুর-দিনাজপুরের বড় বড় মহাজনেরা চার-পাঁচটা ধাড়ি বয়ারের সাথে চল্লিশ-পঞ্চাশটা শুকরি আর দুই-তিনজন ডোম দিয়ে ভাটির দিকে ছেড়ে দেয়। বিশাল বিশাল ঝাড়জঙ্গল পতিত খানাখন্দভরা নদীর পাড় ধরে ধরে ওরা ঢাকার দিকে এগিয়ে আসে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে শুয়রের বাতান ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছলে মহাজন এসে আণ্ডাবাচ্চা সহ সবগুলা কসাইয়ের কাছে চালান করে দেয়। নদীপাড়গুলার জঙ্গল, পতিত প্রান্তর ভরা কাদা, কচুঘেঁচু আর আদমপক্ষীর গু; সুখাদ্যের এই অঢেল প্রাচুর্যে তারা আত্মহারা হয়ে থুতনি দিয়ে খোদার জমিন খুদতে খুদতে, শতশত মাইল পেরিয়ে এসে জয়ধরখালীতে উপস্থিত হয়। রংপুরের সেই ছোট্ট বাথানটা আজ নাতিপুতি সহ দেড়শ-দুইশ শুয়রের একটা বিশাল বাথানে পরিণত হয়েছে। তাদের কলেরা নাই, বসন্ত নাই, পূর্বপাকিস্তানের মানুষের মতো খরা-বন্যা আর নীরব দুর্ভিক্ষ নাই।

জয়ধরখালীতে শুয়রের বাথান এসেছে! এই খবরে ইস্কুল-কলেজের ছাত্রদের মাঝে একটা উত্তেজনার শিহরণ বয়ে যায়। তক্ষণি সবাই হাতে হাতে দা নিয়ে গাঙপাড়ের জঙ্গলে চলে আসে; কাঁচা বাঁশের পাকা লাঠি বানাতে হবে। শুয়র পিটানোয় যে কী সুখ! যে পিটিয়েছে খালি সে-ই বলতে পারবে; এইসব বলাবলি করতে করতে তারা বাঁশঝাড়ে বাঁশঝাড়ে ঘুরে আর মনমতো বাঁশ খোঁজে।  তারা দেশের হালচাল বোঝে, পূর্বপাকিস্তানের রাজনীতির খবর রাখে, দরকারমতো বড়ভাইদের সাথে গলা মিলিয়ে আইয়ূবশাহীর বিরুদ্ধে গ্রামের বাজারে বাজারে মিছিল করে। জয়ধরখালীর যত সুদখোর আছে, লুচ্চা আছে, সবাই তাদের দুই চোখের বিষ। তাই বছর বছর শুয়র পিটানোটা তাদের কাছে শুধু হাতের সুখ মেটানোর নেশা নয়, মনের ঝাল মিটিয়ে নেবার একটা উৎসবও।

 রুছমত মিয়া জয়ধরখালীর একটা বিশেষ চরিত্র। ছোট ছোট গোটাতিনেক ক্ষেতের মালিক রুছমতের বাবা ছিল না-কামলা, না-চাষা। এইরকম একটা কেড়াবিজলা জীবনের শেষ বয়সে সে বাজারের গলিতে গলিতে কেরোসিনের টিন নিয়ে বসে থাকত। অধিকাংশই আধপোয়া-একপোয়া-তিনপোয়ার খরিদদার। নাকের হিৎ শুকানোর আগেই রুছমতও বাপের পাশে গলিতে বসে পয়সা গুনত। একআনা, তিনআনা, পাঁচআনা সর্বোচ্চ একটাকা। রুছমতের মন ভরতো না। সে ছিল সবার ছোট; বাপের নেওটা। তাই রাতে বুড়া বাপের পাশে শুয়ে শুয়ে দোকানদারির আলাপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ত। ঘুমের মাঝেও রুছমতের চোখভরা দশটাকা, বিশটাকা, একশটাকার নতুন নতুন নোটের স্বপ্ন।

পনেরো পেরোবার আগেই ছাইকালো খসখসে, রুক্ষ চেহারার রুছমতের গোঁফ উঠতে শুরু করে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে হাড়গিলা শরীরটা। যেমন শুকনা তেমনি লম্বা, ঢ্যাঙা। এত লম্বা যে হাঁটার সময় তার শরীরে একটা ঢ্যাংঢ্যাঙানি ঢেউ ওঠে। বেশি তাড়াতাড়ি হাঁটতে গেলে তার অসম্ভব লম্বা আর কাঠি কাঠি পা দুইটাতে প্যাঁচ লেগে প্রায়ই ধপ্পত করে পথের মাঝে পড়ে যায়। ছোট ছোট শীতল চোখদুইটাতে টাকার লোভ সবসময় লকলক করে। তাই মাত্র পঞ্চাশ টাকা তহবিল নিয়ে সে সেই বয়সেই জয়ধরখালীতে সুদের ব্যবসায় নেমেছিল; আজ মাঠে তার বিশ বিঘা ফসলের জমি, মোকামে মোকামে দশহাজার টাকা তহবিলের ধান-পাটের কারবার, সাথে রক্তচোষা ব্যবসাটা মজবুত শিকড়বাকড় নিয়ে দশদিকে অক্টোপাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সুদের জালে জড়িয়ে আশপাশের অনেক গরিব-দুক্কি, বিধবা, এতিমের ছোট ছোট ক্ষেতগুলা গিলে গিলে আজ রুছমতের একেকটা ক্ষেত বিশ-তিরিশ কাঠার। তাই জয়ধরখালীতে রুছমত একটা চরিত্র এবং জয়ধরখালীর ছাত্ররাও শুধু শুধু শুয়র পিটায় না।

জয়ধরখালীতে অনেক চেঁও লুচ্চা, পাতি লুচ্চা আছে কিন্তু ছাত্রদের ভাষায় মহর আলী হলো ‘লুচ্চা দি গ্রেট’। ছিমছিমা পাতলা গড়নের মানুষটার থুতনিতে কাঁচা-পাকা একমুঠ দাড়ি আছে। মাঠে কিছু ফসলের জমিন আছে। বাড়িটা বড় তাই আম-কাঁঠাল, কলা, আনারস আর সুপারির বাগিচা আছে; আর আছে মস্ত মস্ত কয়টা বাঁশঝাড়। নিঃসন্তান বুড়াটা বাঁজা বুড়িকে নিয়ে তাই কাপড়-লতা, খানা-খাদ্যে বেশ সুখেই আছে।

সকাল-বিকাল সে পান চিবাতে চিবাতে পাড়ায় পাড়ায় কামুক চোখে হাঁটে। জয়ধরখালীর মানুষ যখন মাঠে মাঠে ধান-পাটের চাষ নিয়ে ব্যস্ত তখন সে বিশেষ বিশেষ বাড়িগুলার বারান্দায় বসে হুক্কা টানতে টানতে লুচ্চামির জাল বিস্তার করে। তার প্রেমিকাদের মাঝে গরিবের পনেরো বছরের মেয়ে থেকে চল্লিশ বছরের মা-ও আছে। মাঝে মাঝে কারো সাথে কথার টক্কর লাগলে তেল-চিক্কন দেহটায় একটা ঢেউ দিয়ে সে চেঁচিয়ে ওঠে, এই মহর আলী কি না জানে; আসমানের তারা আর পাতালের বালু, সব ভাঁইজজ্যা খাইয়া আমি পানি আইগগ্যা দিছে।

ভোর ভোর ডোমেরা খেয়েদেয়ে, সিদ্ধির কল্কিতে  লম্বা লম্বা দম দিয়ে, লাঠি হাতে শুয়রের বাতান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাড়িঘর, পুকুর আর ফসলের মাঠ বাদে সব জঙ্গল আর জঙ্গল। জয়ধরখালীর ছেলেরা হাতে হাতে লাঠি নিয়ে জংলার বড় বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। ঘোঁৎ ঘোঁৎ আর মড়মড় করে জঙ্গল চষে যাচ্ছে শুয়রের পাল। আদিম উন্মাদনায় খেতে খেতে দলছুট দুই-একটা ডোমের চোখের আড়ালে চলে আসতেই ছেলেরাও গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। যে শুয়রটা তাদের নাগালে এল সেটা মহর আলীর মতো একটা মাগীবাজ বয়ার। প্যাক-পানিতে লুডোবুডো জন্তুটার থুতনির ফ্যাংলা ফ্যাংলা লোমগুলা জট পাকিয়ে মহর আলীর একগোছা দাড়ির মতো ঝুলছে। ছেলেরা লাঠি উঁচিয়ে সর্বশক্তিতে ছুটে আসে; মার, লুচ্চা মহর আলীরে মার…।

লাঠির প্রচণ্ড আঘাতে ছায়া ছায়া জঙ্গলের গভীর থেকে ধুপ্পুত ধুপ্পুত শব্দ আর শুয়রের ঘোঁৎ ঘোঁৎ চিৎকার ভেসে আসে। ছেলেরা দৌড়ে আরো সামেন এগিয়ে যায়। সামনে পড়ে আরেকটা বিশাল বুড়ো বয়ার। বিষকচুর একটা বড় ছোপায় সে হানা দিয়েছে। তার পাশেই ছিল কম বয়েসী আরেকটা। ওটাকে সে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে তাড়িয়ে দিয়ে কচু খাওয়ায় মন দেয়। ছেলেরা আবার লাঠি হাতে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে; মার, সুদখোর রুছমতরে মার…।

এইবার লাঠির ধুপ্পুত ধুপ্পুত শব্দ হয় আরো বেশি জোরে। জন্তুটা দিশাবিশা না পেয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ আর্তচিৎকারে ঝাড়-জংলা ভেঙে ছুটে পালায়। ছেলেদের তৃপ্ত হাসিতে সারা জংলা গমগম করে ওঠে।

জয়ধরখালীর ছেলেদের এই আচাভুয়া হল্লা-আনন্দে হয়তো বিধাতার গাঢ় ঘুম ভেঙে যায়। তিনি বিরক্ত হয়ে চৌথাই আসমান থেকে দাঁত কিড়িমিড়ি করতেই শ্রাবণের মেঘঘন আকাশের ফাঁকফোক দিয়ে বিকালের সুরুজটা উঁকি মারে। তখন ক্ষণিকের জন্য হলেও জংলার ভেতরটা ঝলমল করে ওঠে।

প্রিভিয়াসলি অন জয়ধরখালী

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you