জয়ধরখালী ২৬ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ২৬ || শেখ লুৎফর

উত্তরের বাড়ির বুড়ি বারান্দায় বসে বসে একলা-একলাই নানান জাতের আলাপ করে। কেউ শোনে কেউ শোনে না। এই যেমন, —

আসমানেতে লক্ষবাতি নাম তার তারা,
মানুষের সংসারে এই-যে মানুষ …
মানুষ আছ কারা কারা?

বুড়ির ত কাম নাই। নাতি-নাতনিদেরও সংসার হয়েছে। বালবাচ্চা আছে, সুখ-দুঃখ আছে, সবচে বড় কথা তুষের আগুনের মতো অভাবের গুসগুসানি আগুন আছে। বুড়ির তো কেউ নাই। নিজের বুড়াটা গেছে, পেটের পুতেরাও থুত্থুরা বুড়া হইছে। তাই ধরতে গেলে দুনিয়ার মতো প্রাচীন এই জীবনটা ছাড়া বুড়ির কিচ্ছু নাই। তাই পাড়ার গলির লাগোয়া বারান্দায় বসে ঘোলা চোখে সামনের দুনিয়াটা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে সারাদিন দেখে। যতটা সামনে দেখে, পেছনে দেখে তারচে অধিক। আটানব্বই বছর ধরে টেনে টেনে বয়ে চলা জীবনটা এখন আর ভালো লাগে না বলেই কথায় কথায় খোদার কাছে মরবার বায়না ধরে।

সামনের পথ দিয়ে কে জানি দুমদুম হেঁটে যাচ্ছিল, বুড়ি ডাক দেয়, —
ক্যাডা যায়?
— দাদি আমি শামছুল।
ব। অরে পাঁডা (পাঁঠা)! দাদির কাছে ব।
— না দাদি কাওরাইদ যাইয়াম।

বুড়ি হাতের লাঠিটা সামনে বাড়িয়ে ধরে শামছুলের পথ আটকে দেয়। শামছুল একটা আজব মানুষ। এত-যে গরিব তবু তার হাসিমুখ দেখলে একটুও মনে পড়ে না। তিনটা বিয়ে করেছিল একটা বউও টিকল না। একবার ঘর থেকে বেরোলে কখন ফিরবে, কবে ফিরবে শামছুলের কোনো ঠিকঠিকানা নাই। ঘরের ইঁদুর, তেলচুরা উপাস মরে; — বউ নামক দ্বিপদী প্রাণীটা বাঁচে কী করে? তাই ক্ষিধার জ্বালা সইতে না পেরে একে একে তিনটা বউ পালিয়ে গেছে। দুনিয়ার হেন কোনো কাম নাই যা শামছুল করেনি। কিন্তু কোনোটাতেই সুবিধা করতে না পেরে এখন সে ফুলটাইম ভেগাবন।

নিরুপায় শামছুল বুড়ির পাশে বসে একটা বিড়ি ধরায়, — কও দাদি কি কৈবা?
শামছুলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বুড়ি বলে, — আমার দাঁতগুলা দ্যাখছা নাতি।
বহুবার দেখেছে তবু শামছুল আরেক নজর দেখে, — একশ বছরের একটা জীবন চাবাইতে চাবাইতে দাদি তোমার দাঁত এক্কেবারে ক্ষইয়া (ক্ষয়ে) গ্যাছে!

নাতির কথা শুনে মনে মনে বুড়ি তৃপ্তি পায়। ঠোঁটে ঝিলিক দেয় নিষ্পাপ হাসি। তাহলে তার দাঁতগুলো ভাত চিবাতে চিবাতে ক্ষয় হয়ে মাড়ির সাথে লেগে গেছে। আর কত! একশটা বছর সে এই দুনিয়াটা দেখেছে। আজ বাঁকা পিঠটা সোজা করে কব্বরে ঘুমাইতে মন চায়। দুনিয়ার কোনো মানুষের সঙ্গ বেশিক্ষণ ভালো লাগে না, সব অবুঝ, সব অন্ধ। তাই বুড়ির কাছ থেকে শামছুলেরও সহজে ছুটি মিলে, — কৈ জানি যাইবে যাহ্।
— হ দাদি, দোয়া কৈর, আজকোয়া ছাত্রগর লগে মিছিলে যামু। আগরতলা মামলার বিরিদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল।
বুড়ি কান খাড়া করে, — শেখ মুজিবুরের মিছিল?
— হ।

কেউ তো আর গলা বাড়িয়ে এসে বুড়িকে জানায় না। চারপাশের হাবভাব আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো মানুষের গলার রবসব শুনে শুনে গত দশ বছরে বুড়ি শেখ মুজিবকে নিজের পেটের ছেলের মতো ভালোবেসে ফেলেছে। তাই আগরতলা মামলায় তার ফাঁসি হয়ে যাবে এই আতঙ্কে বুড়ি গতমাসে সাতটা রোজা রেখেছিল। রাতে উঠে তার সেহেরির জন্য কেউ কী আর রান্না করে দেয়? ডেক-ডেকচির তলায় পানি-পান্তা যা পড়ে থাকে তা-ই একমুঠ খেয়ে এক চুমুক পানি দিয়ে রোজাগুলো রেখেছিল। মুজিবের জন্য বুড়ির চোখ ভিজে উঠলে বুড়ি আরেকটু শুনতে চায়, —মিছিল কৈ ঢাহা, না গফরগাঁও কলেজে?

শামছুল বড় বড় পা ফেলে চলে যাচ্ছিল। তাই হাঁটার মাঝেই সে চেঁচায়, — সারাদেশে।

শামছুলের বাপটা ছিল দিনমজুর। কালাজ্বরে পড়ে অকালে মরে গেল। শামছুল না গেল গিরস্তের বাড়ি রাখালগিরি কামে, না ধরল সংসারের হাল। সে পাড়ায় পাড়ায় টো টো করে ঘোরে, মানুষের গাছতলার আম-জাম কুড়িয়ে খায়, আজিলফাজিলদের গপ্পো শুনে, দুনিয়ার রঙতামশা দেখে। শমছুলের মা অলসের শেষ। গিরস্তের বাড়ির কামে হাড়ভাঙা খাটুনি তাই সে বুড়ি হওয়ার আগেই ভিক্ষা করতে শুরু করে। গিরস্তের উঠানে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চাইলে বাড়ির বুড়িরা খেঁকিয়ে ওঠে — আইলস্যা জোয়ান মাগী, কামের ডরে ভিক্ষাৎ বারইছে, ভিক্ষা দ্যাইছ না।

এইসব কারণে শামছুলের মায়ের কপালে ভিক্ষা জুটে কম। বাড়ি বাড়ি হাঁটতে হাঁটতে দুপুরের দিকে যখন পেটের ক্ষিধায় আর চরণ চলে না তখন সামনে যা পায় শামছুলের মা তা-ই খায়। হয়তো কেউ পাকঘরে বসে লাউ কাটছে, শামছুলের মা লাউয়ের খোসাটুকু ধুয়ে কাঁচাই কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। তাই দেখে বুড়িরা অবাক হয়, — এইডা কি করছ লো মাগী?
শামছুলের মা হেসে জানায়, — চাচি আমি সব খাই।

এখন বেশিরভাগদিন সকালটা শামছুলের কাটে কাওরাইদ রেলস্টেশনে। এইসময় উত্তর-দক্ষিণ থেকে তিন-চারটা ট্রেন যাওয়া-আসা করে। স্টেশানে ছাত্রদের ভিড় থাকে। কলেজের ছাত্রদের সাথে শাছুলের সম্পর্কটা সবচে ভালো। তার কোমরসমান বয়েসী ছাত্রগুলার সাথে মিছিলে যায়, হোটেলে বসে রাজনীতির গপ্পোতে দিন কাটায়। দরকারমতো পাঁচ মাইল হেঁটে এক ছাত্রভাইয়ের খবর নিয়ে আরেক ছাত্রভাইয়ের বাড়ি যায়। পিছনে পিছনে হাঁটে, ভালো-মন্দ গপ্পো করে, ম্যাচটা, সিগারেটটা কিনে আনতে ছাত্ররা তাকে টংদোকানে পাঠায়। ট্রেন একটু লেইট করলে ছাত্ররা দল বেঁধে স্টেশানের পাশের স্টলে যায়, শামছুলও তাদের সাথে আলাপ করতে করতে সামনাসামনি বেঞ্চে বসে। ছেলেরা পোয়ারুটা, ডাল-ভাজির অর্ডার দিলে শামছুলের সামনেও একটা প্লেট আসে। ছাত্ররাই বিলটিল দেয়; সিগারেট কিনে। তখন শামছুলের কপালেও একটা রমনা সিগারেট জোটে। ট্রেন ছেড়ে দিলে সিগারেট টানতে টানতে শামছুল বাজারের দিকে চলে আসে। অষুদের, কাপড়ের দোকানগুলা খুলতে শুরু করেছে। এখন ঘণ্টাখানেক সে খুব ব্যস্ত থাকবে। দোকানের সামনে দিয়ে যেতে দেখে রফিক ডাক্তার হয়তো নরম গলায় ডাক দিয়ে বলবে, — দোকানটা একটু ঝাড়ু দিয়ে দাও ত।

রফিক ডাক্তারের দোকান ঝাড়ু দেওয়া শেষ হলে ওপাশের কাপড়ের দোকান থেকে বিপিন সাহা ডেকে বলবে, — শামছুল আমার বাজারটা বাসায় দ্যায়া আওছা।

বাজার নিয়ে বাসায় গেলে কেউ কেউ গুড় দিয়ে চিড়া-মুড়ি খেতে দেয়; কপাল ভালো থাকলে গরম গরম ভাতও জুটে যায়।

ডাক দিলেই হাতের কাছে পাওয়া যায়। একটাকিছু করে দিতে বললে হাসিমুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই শামছুলকে কেউ বেগার খাটায় না; দুইআনা-তিনআনা, মন ভালো থাকলে কেউ কেউ আস্ত একটা সিকিও দেয়। কিন্তু এই দুই-চারআনা পয়সায় শামছুলের না ভরে পেট, না ঢাকে পিঠ।

কাওরাইদ বাজারে কোনো মসজিদ নাই তাই বাজার কমিটি মসজিদের দালান তুলতে শুরু করেছে; অনেক টাকার দরকার। বিশ্বস্ত একজন মানুষকে দিয়ে স্টেশানে দাঁড়ানো ট্রেনে ট্রেনে আর বাজারের দোকানদার-খরিদদারদের কাছ থেকে চাঁদার পয়সা তুলতে চায়। যা উঠবে তার তিনভাগের একভাগ তার; এই শর্তে বাজার কমিটি এই মহৎ দায়িত্ব শামছুলকেই দেয়। বাজার কমিটিই তালামারা একটা বাকশো দেয় আর একটা পুরান টুপি-পাঞ্জাবি দেয়। টুপিটা মাথায় দিয়ে, লম্বা আর বড় পাঞ্জাবিটা পরে, তালামার বাকশোটা উঁচিয়ে ধরে শামছুল ট্রেনের পাশে পাশে উটপাখির মতো হাঁটে, —
আল্লার ঘরে এক পৈসা দিলে গো ভাই,
পরকালে সত্তর পৈসা পাই।

শামছুলের গলা ভালো, বলার ভঙ্গিটাও ভালো তাই লোকজনে একপয়সা, দুইপয়সা কেউ কেউ পাঁচপয়সা বাকশে ফেলে।

এশার নামাজের পর মসজিদের ইমাম-মুতল্লির কাছে সব বুঝিয়ে দিয়ে, নিজেরটা বুঝে নিয়ে তবে মুক্তি। নিজের ভাগে কোনোদিন পড়ে একটাকা, কোনোদিন বারোআনা! শামছুলের জন্য অনেক পয়সা। তবু মন ভরে না; দিনটা যে কীভাবে যায়, কী কষ্টে যায় শুধু সে-ই জানে। সে বুঝি কী-এক জালে আটকে গেল! এইসব ভাবতে ভাবতে বুকটা খাঁ খাঁ করে। তাই হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চঘাটে চলে আসে। লঞ্চের খালাসিদের সাথে তার গোস্তে গোস্তে ভাব। তাই বিনা খরচে লঞ্চের ডেকে শুয়ে রাতে ঘুমাতে পারে। সন্ধ্যাটা অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেলে আশপাশের ছাত্ররা নিরালা ঘাটে বসে গাঙের হাওয়া খায়, বিড়ি-সিগারেট খায়। কেউ কেউ সিদ্ধিও টানে। শেষ-হয় শেষ-হয় স্টিকের মোথাটা এগিয়ে দিয়ে কেউ কেউ বলে, — নেও শামছুলভাই, একটান খাও।

রাত একটু বাড়লে বাজারের বড় ব্যবসায়ী আর ঘাগু মাতব্বরদের কেউ কেউ বোতল নিয়ে বসে। সেখানেও শামছুলকে দেখা যায়। তার দায়িত্ব হলো পান-পানি, সিগারেট আর তপনের হোটেল থেকে খাসির ভুনা মাংস যোগান দেওয়া। এবং এইসব উজ্জ্বল প্রেরণায় একসপ্তাহের মধ্যেই তালা না খুলে বাকশের পয়সা উদ্ধারের পথ আবিষ্কার করে নেয় শামছুল। এশার পরে সব বুঝিয়ে দিয়ে সে সোজা মদের দোকানে চলে আসে। তারপর ছ’আনা দিয়ে একগ্লাস মেরে নদীর ঘাটে গিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে।

পরের সপ্তাহেই শামছুলকে নিয়ে বাজার কমিটি বিচারে বসে; — গ্যাছেকাইল কয় ট্যাহার মদ খাইছস, ক?

শামছুল নির্বিকার। এখানে যারা বিচারে বসেছে, কাল রাতেও তারা পাঁচজনে মিলে একশটাকার বোতল টেনেছে, তপনের হোটেলের ভুনা মুরগির হাড় মড়মড় করে চিবিয়েছে। সব তার সামনেই। তাই সে ভয়-ডর না রেখেই বলে, — ছয়আনার।

মসজিদের পয়সায় মদ কিনে খায় আবার স্বীকারও করে! এই নিয়ে সবাই হাসতে হাসতে মরে। তাই বিচার-টিচার তেমন জমে না। শুধু বাজার কমিটির সভাপতি কিছু তর্জন-গর্জন করে বলে দেয়, — কাইল থাইক্যা তুই আর আইছ না।

শামছুল আবার ফুলটাইম ভেগাবন। তাই ব্যস্ততা আগেরচে বহুগুণ বেশি। সকাল সকাল পথে নামতে হয়।

গাছের পৌখপাখালির মতো বুড়িও চিরকাল সকাল সকাল বারান্দায় এসে পাশে লাঠিটা রেখে, আখড়ার বটগাছটার মতো অনেক উপর থেকে দুনিয়াটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পোকামাকড়ের মতো সেই একইরকম ভনভনানি, ঘ্যানঘ্যানানি! বুড়ি সামনের দিকে লাঠিটা বাড়িয়ে দেয়, — ক্যাডা যায়?
— গরিব শামছুল! অদম শামছুল!

বুড়ি শিশুর মতো খিলখিল করে হাসে, — অতদিনে বুচ্ছস?

সেই বিচারের পর থেকে শামছুল বড় মনের কষ্টে ভুগছে। বিচারিদের রায়টা সে মেনে নিতে পারেনি। তাদের টাকা আছে তাই তারা রোজ রোজ শ’টাকার মদ খায়। আর তারাই শামছুলের ছয়আনার মদ খাওয়ার জন্য চেয়ারে বসে আসামীর প্রাণদণ্ড ঘোষণা করে!

শামছুলের নীরবতায় বুড়ি আবার জিগায়, — অতদিনে মর্ম পাইছস?
— হ দাদি এট্টু এট্টু।

দাদির সাথে সরল মনের শামছুলের একটু একটু করে অনেক দিনে একটা ভাব গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক মানুষের মতো শামছুলেরও একটা শিশুমন আছে। সংসারের ফের-ফাক্করে পড়ে অনেকেরটা মরে যায়। শামছুলের মরেনি। তাই শিশুর সাথে শিশুর ভাবের বলেই শামছুল দাদির পাশে বসতে বসতে নিচু গলায় বলে, — মরছিদের পৈসায় ছয় আনার মদ খাইছলাম কৈয়া আমারে তারা দুষি করল!

বুড়ি ঠোঁটের দুইপাশ দিয়ে নেমে আসা পানের রস মুছতে মুছতে বলে, — পৈসার মরজিদ-মন্দির কী রে পাঁডা? ব্যাডিমাইনশ্যের মতন যহন যার তহন তার।

শামছুল বিড়ি ধরায়। বুড়ি ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে অনেক উপর থেকে দুনিয়াটা দেখে, অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেঁচে থাকার অবসাদে, তিক্ততায় খোদার প্রতি সে মহাবিরক্ত। তাই শামছুলকে বলে, — খুব ছোডু থাকতে একবার নাও দ্যায়া বাপের লগে মেলায় যাইতাছি। নাওয়ের সামনের দিকে পুরুষেরা। পিছনে ব্যাইট্ট্যাইন (মহিলারা)। এক সুন্দরী আধাবুড়ি ছিল এক্কেবারে পিছনে। পিছা গলইয়ে হালের মাঝিডা আছিন রসিক-বুড়া। মাঝি নাও বোয়ায় আর ব্যাডির লগে ঢংঢাং করে। তে ব্যাডির উডছে রাগ। তাই মাঝিরে হুনায়া হুনায় কয় :

আগের আল্লা নাই,
হক্কলের মরে বাপ,
আমার মরছে হাই (স্বামী)।
আগের আল্লা নাই।

বুড়ি হাসে, শামছুলও হাসে। খুব হাসাহাসি চলে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে আবার হাঁটা দেয়। সেই রেলস্টেশান, দোকানদারদের ফুট-ফরমায়েশ। কয়দিন পরেই ঈদ তাই কাপড়ের দোকানগুলাতে ভিড়। কবিরদ্দি একা মানুষ। সে খরিদদারদের সাথে কথা বলবে, না ভিড়ের দিকে চোখ রাখবে! তাই তার দোকান থেকে প্রতিদিন শাড়ি চুরি হয়। পরেরদিন সকালেই সে শামছুলকে চেপে ধরল, — তরে ত আর কম চিনি না; বতুল-টতুল ছাড়। গদির হেই কোনাৎ বইয়া বইয়া কাস্টমারগর উপর চৌখ রাখবে। যদি চুরি বন্ধ অয় বেতন বিশ ট্যাহা, দুই বেলা ভাত।

মানুষে পাগল-ছাগল যা-ই বলুক তলে তলে দুনিয়াটা সে কম দেখেনি। তাই শামছুল আকাশ থেকে পড়ে না। নির্বিকার গলায় বলে, — তিনদিন সময় দেইন আম্মারে অনেকদিন দ্যাহি না।

বাড়িৎ এসে শামছুল দেখে তার মা জ্বরে পড়েছে; বুকে কফের গড়গড়ানি। শামছুলের ডাকে হাড়-জিরজিরে মা চোখ খোলে না, খালি বিড়বিড় করে কীসব বলে। শেষরাতের দিকে ঘুমে শামছুল মায়ের পাশেই ঢলে পড়ে ছিল। বুড়ি উঠে বসে। জ্বর-টর নাই। কফের গেড়গেড়ানিও কম। তাই বুড়ি শামছুলকে ডেকে তোলে, — উডঅ বাজান, আমার যাইবার টাইম অইছে।

শামছুল ধড়ফড়িয়ে ওঠে। এই বড় বড় চোখ করে মা তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাত দিয়ে ইশারা করে পানি চাইছে। একচুমুকে একগেলাস পানি খেয়েই বুড়ি ঢলে পড়ে।

শামছুলের ডাকাডাকিতে ভোরেই দুই-চারজন এগিয়ে আসে। তারা বলাবলি করছে, — শামছুইল্ল্যার মা মৈর‌্যা গ্যাছে।

বিশ-কুড়িজন গরিব-দরিব মানুষের উপস্থিতিতে সকাল-সকাল শামছুলের মায়ের দাফন-কাফন হয়ে গেল। হুজুর মাইয়াতে…মাইয়াতে করে মিনিটখানেকের মাঝে মোনাজাতটাও শেষ করে দিলো। এই ঘটনা শামছুলকে খুব কষ্ট দেয়। টাকাওয়ালা মানুষের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে হুজুররা নাক টেনে টেনে কত কাঁদে, কবরবাসী মানুষটার জন্য বেহেস্ত চেয়ে খোদার কাছে কত ইনাই-বিনাই আবেদন-নিবেদন পেশ করে।

শামছুলের মুখের সেই হাসি নাই। সে খালি মনে মনে জপে, — ধনীরা মরলে অয় মরহুম আর গরিব মরলে হিয়াল-কুত্তা।

গম্ভীর, টানটান গতরের শামছুলকে যদি কেউ জিগায়, — তর মা নাকি মৈর‌্যা গ্যাছে?
শামছুল আর হাসে না; মুখবিষ করে বলে, — গরিব ত মরে না ভাইয়ো, খালি চৌখ দুইডা বন্ধ কৈর‌্যা একটা টানা মারে।

সেই টুপি-পাঞ্জাবি আর নাই। সেটা সে ঘরের পিছনের পাগারে ফেলে দিয়েছে। আগের সেই শার্টটা পরেই শামছুল কাওরাইদ রওনা দেয়। কবিরদ্দির দোকানের চাকরিটা সে করবে। বারান্দা থেকে বুড়ি লাঠি তোলে, — ক্যাডা যায়?
— আমি।
শামছুল না?
— হ।
ব।

শামছুল বুড়ির পাশে বসে। ত্যানা ত্যানা একটুকরা কাপড়পরা বুড়ি কচ্ছপের মতো হাড়ের পিঞ্জরের ভিতর থেকে দুনিয়াটা দেখে, — মরবার সময় তর মা-র মুহে পানি দিছলে?
— হ। টিনের গেলাস দ্যায়া আস্তা একগেলাস পানি খায়া ঢইল্যা পরছিন।
কানের কাছে মুখ ন্যায়া কলিমা কৈছলে?
— হ। জুরে জুরে অন্তত দশবার কৈছি।

অনেকক্ষণ বুড়ি আর কিচ্ছু বলে না। শামছুলও না। তারা দুই পৃথিবীর দুই বাসিন্দা হলেও মনের দিক থেকে মাঝে মাঝে একদুনিয়ায় বিরাজ করে তাই তাদের কথা না কওয়াটাই অনেক কথা। লোভ-কাম-কুটিলতাহীন মুহূর্তগুলো দিয়ে তারা দুইজন পরস্পরের সঙ্গটুকু ভোগ করে।
— আইলস্যা হইলেও তর মা-র মনডা ভালা আছিন।
এই কথা বলে বুড়ি ছোট্ট একটা দম ফেলে।
শামছুল নীরবে চোখ মোছে, — আমি ত কোরান-কালাম কিচ্ছু চিনি না, দাদি তুমি আম্মার লাগি দোয়া কৈর।
— হ। করাম। ভাই তুমিও আমার লাইগ্গ্যা দোয়া করবা, ঈমানে ঈমানে যেন খুব শিঘ্র মরতারি।

শামছুল উঠে পড়ে। তার মনে মরাটরার কথা বেশিক্ষণ টিকে না। গরম গরম ছানার ডাল আর পোয়ারুটির গন্ধ তার খুব প্রিয়। মাঝে মাঝে ছয়আনার এক গ্লাস মদে গোঁফ ভেজাতে কী অসম্ভব ভালো লাগে!

পথে দেখা হয় কুদরত সাহেবের সাথে। রেলের বড় কন্ট্রাক্টর। ময়মনসিং শহরে বাসা-টাসা আছে। প্যান্ট-শার্ট পরে, চামড়ার জুতায় মচমচ শব্দ তুলে হাঁটে। শিক্ষিত মানুষের সাথে ইংরেজিতে আলাপ করে। বাড়িতে বুড়া মা-বাপ থাকে, আরস্তি-গিরস্তিও আছে। তাই মাঝে মাঝে এদিকে আসতে হয়। তার সাথে চামড়ার একটা ভারী ব্যাগও থাকে। শামছুল কতদিন নিজ থেকেই ব্যাগটা বয়ে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। শামছুলকে দেখেই কুদরত সাহেব দাঁড়িয়ে পড়ে, — ভালো আছো?

শামছুল আর আগের মতো হাসে না। এই একমতো আছি, — বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আজ আর বলে না, — দ্যাইন ভাইয়ো, ব্যাগটা আমারে দ্যাইন।
তাই অস্বস্তি কাটাতে কুদরত সাহেব বলে, — শুনলাম তোমার মা নাকি মারা গেছে?
বিষণœ-ভারী গলায় শামছুল বলে, — জি, গতপরশু বাদ ফজর আমার আম্মা ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন।
কুদরত সাহেব শামছুলের ভাষা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে, শামছুল হনহন করে কাওরাইদ বাজারের দিকে হাঁটছে। কুদরত সাহেব বিড়বিড় করে বলে, — ছেলেটা বেয়াদপ হয়ে গেছে।

সামনের বাঁকটা পেরিয়েই শামছুল শার্টের পকেট থেকে কুকড়া-মুকড়া একটা সিগারেট বের করে ধরায়। মাথার চুল, শার্টের কলার ঠিকঠাক করে সিগারেটে আরামছে দম দেয়। এই ধুলামাটির পচা সংসারটা এখন তার কাছে খুব স্বস্তির লাগছে, তকতকে তাজা লাগছে। এখন নিজেকে একটু মানুষ-মানুষ ভাবতে শামছুলের বড় ভালো লাগছে।

প্রিভিয়াসলি অন জয়ধরখালী

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you