জয়ধরখালী ১১ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ১১ || শেখ লুৎফর

দ্যাখতে দ্যাখতে ধানকাটা কাঁচির মতো শবেবরাতের বাঁকা চাঁদটা আকাশে গোল হয়ে উঠেছে। এই খবরে জয়ধরখালীর মুসলমানদের চলন-বলন আর আওবাওয়ে নিঃশব্দে এসে গেছে বিরাট একটা পরিবর্তন। এখন আর তারা ঘরে-বাইরে আগের মতো কথায় কথায় গালিগালাজ, চিৎকার চেঁচামেচি করে না। কোন্দল-কুটনামিটাও আপাতত বন্ধ রেখেছে। সংসারের শত ব্যস্ততার মাঝেও মহিলারা বাড়ির চারপাশে জমে-ওঠা আবর্জনা ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলেছে। মাটির ঘরগুলো ফলফলা পরিস্কার হয়ে উঠেছে নিপুণ হাতের লেপা-মোছায়। বউঝিরা ধান সিদ্ধ করার বড় ডেকচিতে মুঠি মুঠি কাপড়-কাচা সোডা ফেলে, কলস কলস পানি ঢেলে, উঠানের চুলাতে নেড়ার আগুন দিয়ে জ্বাল দিচ্ছে। সোডা-পানি ফুটতে শুরু করলেই ঘরের সব কাপড় এনে ডেকচিতে ভিজাবে। তারপর সারা দুপুর পুকুরঘাটে বসে খচে খচে সবগুলো কাপড় তকতকা পরিষ্কার করে ধোবে।

মাঝেরপাড়ার এলাহীর মা গরিব মানুষ। তারা কাপড় ধোয়ার জন্য সোডার মতো দামি জিনিস কৈ পাইবে? তাই গরিবরা কাপড় কাচে ক্ষার দিয়ে। এই ক্ষার হলো কাঁঠালের মজি (কাঁঠালগাছ থেকে ঝরে-পড়া অপুষ্ট শুকনা ফল পুড়িয়ে পাওয়া ছাই) পোড়া ছাই। এলাহী তিনবার এইটক্লাস ফেল করে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়েছে বছরতিনেক আগে। শুক্কুরবারে জুম্মার নামাজ পড়াতে বড়হুজুর এলে সে তার খায়খেদমত করে। বয়ানের সময় খুব মন দিয়ে আল্লা-রসুলের কথা শুনে আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজটা পড়ে ঠিক ঠিক টাইমে। এই দেখে এলাহীর বাপ ঘোষণা দেয়, এলাহীডা আল্লাখোদা চিনতাছে, চিনিক; হ্যারে আর কামেকাজে ডাহিছ না।

এই ঘোষণায় এলাহীর উৎসাহ আরো দ্বিগুণ হয়। তাই শার্ট ছেড়ে পাঞ্জাবি পরতে শুরু করে। ছুঁচুর মতো লম্বা টাইপের মুখটা ভরে গেছে ফ্যাঙলা ফ্যাঙলা দাড়িতে। আমাশয়ের রোগীর মতো চিমসা মুখে একটা রমরমা হাসি নিয়ে সে সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় টু টু করে ঘোরে। ছোট-বড় যার সাথেই দেখা হোউক সে সালাম দিয়ে মুসাফা করার জন্য দু-হাত এগিয়ে দিবে। মুখটাতে লেগে থাকবে এক চিলতা স্যাঁতস্যাঁতা হাসি। সামনের লোকটার দু-হাত ধরে সে জোরে জোরে ঝাঁকি দিতে দিতে বলবে, এক মুসমান আরেক মুসমানের ভাই; দেখা হইলে সালাম দিবা, হাতে হাত, বুকে বুক মিলাইবা; সগিরা-কবিরা গুনাগুলা সব কপালের ঘামের লাহান ঝরঝরাইয়া পইড়া যাইব।

এলাহীর দিলটা নরম। বর্তমানে তার চলন-বলন ও জবান-তরিফতে পরহেজগারি ভাব দেখা যায়। শবেবরাত হলো হাজার রাতের এক রাত। এই রাতে বনের পশুপাখি, হায়ান জানোয়ার, গাছবিরিক্ষ অর্থাৎ আঠারো হাজার মাকলুকাত খোদার পায়ে সেজদা দিবে রহমত লাভের আশায়। তাই এলাহী আজ খুব ব্যস্ত। সে গরু-বাঁধার মোটা আর লম্বা লম্বা তিনটা দড়ি দিয়ে তাদের উঠানের কাঁঠালগাছটাকে ঘরের চালের বর্গার সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে। এই নিয়ে তাদের উঠানজুড়ে পাড়ার চেংড়াদের মহা উত্তেজনা। সকলেই ভয়ে আছে, গাছ সেজদা দিতে গেলেই টান খেয়ে এলাহীদের ঘরটাও ভেঙে পড়বে! এলাহীর মুখে অবশ্য অন্য কথা : গাছ সেজদা দিবার গেলেই দড়ির টান খেয়ে ঘরে শব্দ হবে। সেই শব্দে সে-ও ঘর থেকে ছুটে এসে আল্লার উদ্দেশ্যে গাছের সাথে সেজদায় পড়বে। সেজদার মতো সেজদা একটা দিতে পাড়লে জিন্দিগির সব সগিরা-কবিরা গুনা মাফ হয়ে যাবে।

শবেবরাতের সুবাদে ছোটরা আজ ষোলোআনা স্বাধীন। বড়দের পিছে পিছে ঝাঁক বেঁধে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল আর পয়সা উঠাবে। পাড়ার জোয়ান কৃষকেরা পুকুর থেকে জাল দিয়ে তুলবে বড় বড় রুই-কাতল, মসজিদের সামনে খাসিও জবাই হবে একটা। পাড়ার সব মরুব্বিরা মসজিদে আল্লাবিল্লা করে রাত কাটাবে। পুকুরপাড়ে চুলা কেটে, মস্ত বড় তামার ডেকচিতে পাক বসাবে তাগড়া তাগড়া উজ্জোগী-কৃষকেরা। চারপাশ থেকে তাদেরকে ঘিরে বসবে গপ্পোবাজ আরো অনেকেই। সকলেই খোদার প্রতি অসীম ভক্তি নিয়ে এখানে আসবে। কোনো প্রকার হাঁকডাক থাকবে না। খুব দরকার হলে ফিসফিস করে কথা বলবে। তাদের বিশ্বাস, আল্লার ঘরের সামনে পাকপবিত্র মন-গতরে বসে থাকাটাও ইবাদতের শামিল। বিড়ি টানার টাইম হইলে কেউ কেউ খোদার ভয়ে মুঠির আড়ালে পাতা-কাগজের জ্বলন্ত বিড়ি নিয়ে, ইঁচড়েপাকা বালকের মতো চুপে চুপে টানবে। যাদের মাথায় টুপি নাই তারা আল্লার ডরে, বিসমিল্লা বলে কাঁধের গামছাটাই টুপির মতো করে পরে নিবে। আজ খোদার ফেরেশতারা তার পিয়ারের বান্দাদের ভাগ্যে আসছে বছরের দানাপানি, জোৎসম্পত্তি বরাদ্দ দিবে। দয়া হলে সারা জিন্দিগির গুনাও মাফ করে দিবে।

মরুব্বিদের অনুপস্থিতিতে সারাপাড়া মাথায় তুলেছে এ্যাবাড্যাবা ছেলেগুলো। এশার পরে নারিকেল চুরি করে একদফা চিবিয়েছে। এখন গিয়াসউদ্দীর গাছের সৈয়দি পেয়ারা চুরির তক্কে আছে। দবদবা সাদা জোছনায় দমকা বাতাসের মতো একপাড়া থেকে বেরিয়ে বিচ্ছুগুলো আরেক পাড়ার দিকে হুড়মুড় করে ছুটে যায়। মাঝে মাঝে মসজিদের সামনে ফিরে আসে। মস্ত চুলাটার দাউ দাউ আগুনের লাল আভায় তাদের খুশিভরা চোখগুলো তখন চকচক করে।

খাসির গোস্ত কষানো হচ্ছে। তাই চারদিকে ওমোম সুবাস। একজন ভরত্-করে একটা পাদ মারে। বড়দের মাঝ থেকে একজন চাপা-গলায় ধমকে ওঠে, এই ক্যাডারে পাদ মারবার গ্যায়া আইগ্গ্যা দিছে, হ্যারে ক দিঘির ঘাডেত্তে পুটকি ধুইয়া আইত।
এই কথায় ছোট-বড় সকলেই চাপা গলায় ফেক ফেক করে হাসে।

মসজিদের বুড়ারা মরণের ভয়ে শেষরাতে খুব কান্নাকাটি করে বিরাট লম্বা একটা দোয়া করবে। মসজিদের ভিতরে যত মানুষ তারচে অনেক বেশি বাইরে। নিভে-আসা চুলার লাল আগুন আর বড় বড় ডেকচির চারপাশে বসে তারাও মোনাজাতে শরিক হবে। বুকভর্তি কালো কালো লোম আর শালকাঠের মুগোরের মতো হাত-পায়ে গোছাগাছার জোয়ানরা মসজিদের মানুষগুলোর সাথে আমিন!-আমিন! বলে নরম গলায় শুধু কঁকিয়ে ওঠে।

মোনাজাত শেষ হলে দশ-বারোজন মরুব্বি গামছায় চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে। বাইরে আরো চল্লিশ-পঞ্চাশজন। বছর বছর কলেরা আসে, বসন্ত আসে; আমাশয়, হুপিংকাশি, ডিপথেরিয়া সহ হাজারটা বালাই সারাবছর লেগেই আছে। দশমাইলের মাঝে কোনো ডাক্তার নাই। কাঁওরাইদ বাজারে অষুধের দোকান আছে মাত্র একটা। সারা জিন্দিগিতে কারো ডাক্তারের বিশেষ দরকার পড়ে না। আর যদি কাউকে চাঙ্গারিতে করে কিংবা নৌকায় চড়িয়ে নিয়েও যায় তারও অষুধের বিশেষ দরকার পড়ে না। কারণ লোকটা ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে এসে দুই-চারদিনের মাঝেই মরে যায়। তারপরেও যে এই কয়টা ছেলেছোকরা টিকে আছে, আল্লার এই আচান্নক মহিমায় বুড়াদের কেউ কেউ খোদার কাছে শুকরিয়া জানাতে গিয়ে ফের আল্লা!-আল্লা! বলে ডুকরে ওঠে।

এবার সকলে মসজিদের বিরাট চাতালটা ঘিরে বসবে। সবার সামনে কলাপাতার পাতে বিরুই চালের স্তূপ স্তূপ চিকন ভাত দিবে; আলু আর কড়া ঝাল দিয়ে পাকানো খাসির গোস্তের পাতলা ঝোল দিবে। আলু-বেগুন আর প্রচুর মাছ দিয়ে পাকানো ‘লাবড়া’ নামের সুস্বাদু ছালুনটা প্রত্যেকের পাতে দিবে বাটি বাটি। তারপর ডাল। স্তূপ স্তূপ ভাতের সাথে মাছের মাথা দিয়ে পাকানো মাসকলাইয়ের ডাল, ছোট-বড় সকলেই অনেকক্ষণ ধরে হাপুত-হুপুত শব্দে খাবে। সবশেষে শুকনা বড়ই আর লাল গুড় দিয়ে ‘মিডুরি’ নামের পাতিল পাতিল মিষ্টান্ন খেয়ে, পরের দিন রোজা রাখার নিয়তে ছোট-বড় সকলেই উদরটা ভরে নেবে গলা পর্যন্ত।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you