জয়ধরখালী ২ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ২ || শেখ লুৎফর

গ্রামে কোনো ঝগড়া লাগলে একপক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য শত্রুপক্ষের কোনো গোপন দোষের কথা চিৎকার করে ফাঁস করে দিত। পরে এই নিয়ে কথা চালাচালির সময় অনেককেই বলতে শুনতাম, এই কতা নুরুর বাপের ঢেঁকিত্তে উঠছে।

আলাপেসালাপে কিংবা ঝগড়াঝাটি থেকেই হোক ‘নুরুর বাপের ঢেঁকি’ কথাটা শুনতে শুনতে অনুমান করি, এই জিনিসটা বিরাট একটাকিছু। প্রাইমারি স্কুলে পড়তে গিয়ে হঠাৎ একদিন নুরুর বাপের ঢেঁকির তালাশ পেয়ে যাই। বাড়ি থেকে স্কুলটা একদম কাছে। উত্তরদিকে তিনটা বাড়ি পেরোলেই অনেক লম্বা মাটির দেওয়ালের উপর টিনের দোচালা ঘর। লেপা-মোছাহীন দেওয়ালটায় অসংখ্য ফাটল। সামনে একটা বিরাট মাঠ। মাঠের তিন পাশেই মস্ত মস্ত জঙ্গল। বড় বড় বাঁশঝাড়ঘেরা মাঠের পশ্চিম দিকে নদী। গ্রামের মানুষ নদীটাকে বলে গাঙ। গাঙের ঘাটে বেদেদের একটা বিরাট বহর থাকে সারাবছর। দশ-বারোটা নাও ঘাট থেকে একটু দূরে লগিতে বাঁধা। কোনো-কোনোটার পিছন-গলুইয়ে পোষা বাঁদরের খাঁচা।

বাড়ি থেকে ইস্কুলে যাওয়ার পথ দুটো। ঘরের পিছনের সড়ক দিয়ে যাওয়া সবচে সহজ ছিল। কিন্তু অসুবিধাও বিরাট। পথের দুই পাশে শুধু বাঁশঝাড়। প্রায় অন্ধকার সেই পথে মানুষের চে’ বাঁদরেই বেশি চরাট করে। কেউ কেউ নাতিপুতি নিয়ে ঘন বাঁশবন থেকে নেমে এসে পথের মাঝে হাঁটাহাঁটি করে, শরীর চুলকায়। কেউ কেউ আবার পথের মাঝে বসে বসে একে অন্যের শরীরের উকুন বেছে বেছে খায়। তাই তারা ফাঁকমতো ছোটদেরকে পেলে ভেংচি কেটে ভয় দেখায়। বাচ্চা বাঁদরেরা তাড়া করে। ধরতে পারলে বইটই কেড়ে নেয়। মাঝে মাঝে খামচাও মারে।

বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে কবর। নিরিবিলি সেই পথে বাঁদরের চে’ শয়তানের ভয় অনেক বেশি। ঠিক দুপুরে কাউকে একলা পেলে নাকি ঘাড় মটকে দেয়। তাই পাড়ার ভিতর দিয়ে স্কুলে যাওয়াটা বেশি নিরাপদ। এই বাড়ির সামনে দিয়ে, সেই বাড়ির পিছন দিয়ে যেতে যেতে তুমি গিয়ে পড়বে নুরুর বাপের উঠানে। উঠানের পুবদিকে মাটির দেওয়ালের উপর টিনের দোচালা। উত্তরদিকে পাটখড়ির বেড়ার উপর ছনে-ছাওয়া একটা পাকঘর। ঘরের ভিতরে একজন সাদা চুলের বুড়া মানুষ; মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। চুলার সামনে বসে রান্না করছে। তার পেছনদিকে উত্তরের বেড়ার কাছে একটা ঢেঁকি। ঢেঁকিতে বসে আছে দুই-তিনজন মানুষ। তারা বিড়ি টানছে আর কথা বলছে। দুপুরে ফিরে আসার সময় দেখি সেই বুড়ো মানুষটা পাকঘরে মাছ কুটছে। তার আশপাশে আরো দুই-তিনজন। ঢেঁকিতেও বসা আছে একজন। ঢেঁকিতে বসা লোকটা কীসব বলছে আর অন্যরা হাসছে।

অনেকদিনের আসা-যাওয়ায় দেখলাম, বাড়িটাতে কোনো মহিলা নাই।  একদিন খেতে বসে মাকে জিজ্ঞেস করি, নুরুর মা নাই?

মা বড়আপার পাতে ডাবর (নারিকেলের মালাইচাকি দিয়ে বানানো বড় চামিচ) দিয়ে দুধ দিচ্ছিল, আমার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, এই কয়দিনেই নুরুর বাপের বাড়ি চিন্ন্যা ফালাইছস?

বাবা হেসে ফেলেন, অহন নুরুর বাপের বাড়ি চিনছে; কয়দিন পরে নুরুর বাপের ঢেঁকিও চিনবে।

বাবার এই কথায় বড়ভাই খাওয়ার মাঝে মাথা আরেকটু নুয়ে ফেলে। সে শহরে থেকে কলেজে পড়ে। ছুটিছাটায় বাড়ি এলে কোনো কোনো দিন বিকালগুলো নুরুর বাপের বাড়িতে কাটায়। পাড়ার বড়আপারা দল বেঁধে এবাড়ি-সেবাড়ি ঘুরতে ঘুরতে নুরুর বাপের উঠানের উপর দিয়ে পশ্চিমের বাড়ির দিকে যায়।

বাবার কথায় মা আর কিছু বলে না। তবে মায়ের মুখ কালো দেখে আমি ডরে মরে যাই। ভাইবোনদের ওপর মায়ের দাপটই বেশি। অন্যায়টন্যায় করে ফেললে দরকারমতো মা চড়থাপ্পড়ও লাগায়। বাবা আবার মায়ের ঠিক উল্টা। পড়তে বলে না। স্কুলে না গেলে খেতে এলে বকে না। নুরুর বাপের বাড়ি কেন বেটিমানুষ নাই, এইটার কারণ কিন্তু মা বলল না। আমিও ভয়ে সে-বিষয়টা চেপে যাই।

বড়ভাই বাড়ি থাকলে সন্ধ্যায় পড়াতে বসে। আর আমি পড়ার জন্য তার হাতে নিত-নিত মার খাই। একদিন আমার ভেউ-ভেউ কান্না শুনে বাবা দুমদাম ঘরে এসে ঢোকে, — তর পড়ার দরকার নাই। আমার লগে ল।

বড়ভাইকে কিছু না বলে বাবা আমাকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে আসে।

বাইরে ফুরফুরা জোছনা। পালপাড়ার দিক থেকে কর্তালের টুনটুনানির সাথে কীর্তনের সুরও ভেসে আসছে। বারান্দার টুলে বাবা আমাকে তার পাশে বসিয়ে, কাঁধের গামছা দিয়ে আমার চোখ-মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, —
নুরুর মা নাই। নুরুর বাপ নিজেই রান্নাবান্না করে, সংসার চালায়। বাড়িতে বেটিমানুষ নাই দেখে গেরামের সব আজিলফাজিল মানুষ সারাদিন বিড়ি টানে আর আড্ডা মারে।

বাবার কথা শেষ হলে কীর্তনের সুর যেন উঠানের জোছনার সাথে মিলেমিশে আরো গভীর ব্যাপ্তি পায়।

প্রচ্ছদচিত্র / সত্যজিৎ রাজন

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you