জয়ধরখালী ৩ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ৩ || শেখ লুৎফর

পুবে-পশ্চিমে মাটির দেওয়ালের একটামাত্র লম্বা ঘর। টিনে-ছাওয়া ঘরটার মাটির দেওয়ালটা ছিল খাউদা খাউদা আর ফাটাফুটা। সেই ফাটলগুলোতে বসত করত হাজারে-বিজারে চড়াই পাখি। তারা সবসময় ফুড়ৎ যাচ্ছে আবার মুখে খড়কুটা নিয়ে ফুড়ৎ আসছে। ইশকুলের পিছনের জংলার কোনো অন্ধকার কুঠুরি থেকে একটা হুতুম পেঁচা ‘ভূভ…ভূভ’ বলে বুক-কাঁপানো স্বরে ডেকে উঠল। আর ক্লাসের বালকদের কেউ কেউ ডাকটা ভালো করে শুনবার জন্য কান খাড়া করে।

ইশকুলের তিনদিকে জংলা। অধিকাংশই বড় বড় বাঁশঝাড়। মাঝে মাঝে অনেক উঁচু উঁচু আমগাছ। মাঝে মাঝে বেতগাছের ঘন ঝোপ। ঝোপে কুমারি-লতায় ঝুলছে আজদাহা সাপ। মুখে খরগোশের ছানাপোনা। পশ্চিমে গাঙ। ইশকুলের পাশেই গাঙের ঘাট। নাম তার বেপারির ঘাট। মাঝে মাঝে ঘাটে এসে তিনশ-চারশমনি নাও নোঙর করে। পাটবোঝাই নাওয়ের মাঝিদের হাঁকডাক, ভারী ভারী বস্তা কিংবা পাটের গাট্টি মাথায় নিয়ে তড়িৎবেগে তাদের আনাগোনা চলে তিন-চারদিন। তাদের সকলের ভাব-ভাষা আর-দশজনের মতো না। পাটের ফড়িয়ারা পান-খাওয়া লাল দাঁত বের করে হেসে হেসে বাজারের দরদস্তুর নিয়ে কথা বলছে। আশপাশের বাজারগুলো থেকে তারা পাট কিনে এনে এখানে সিযিল-মিসিল করে। তাবাদে গয়েশপুরের পাটকল অফিসে চালান পাঠায়। সবার আগে তারা কৃষকের কাছ থেকে কিনে-আনা এলোমেলো পাটের গাট্টিগুলো একে একে নাও থেকে নাবাবে। তারপর গাট্টি খুলে, একহাতা পাট একজন চাতালে মেলে ধরবে; আরেকজন শুকনা পাটের হাতার আগাগোড়া বদনা থেকে খুব মিহি করে পানি ছিটিয়ে দিবে। পানি দেওয়া শেষ হলে আরেকজন বস্তা থেকে একমুঠি ধুলা নিয়ে পানি-ছিটানো পাটের হাতায় ছড়িয়ে দিবে। তাবাদে মেয়েদের লম্বা চুলে চিরুনি চালানোর মতো করে তারা পাটে আঙুল চালিয়ে মিসিল করে। এইভাবে আঁচড়ানো শেষ হলে পাটের লম্বা হাতাটাকে মেয়েদের বিনুনি বাঁধার মতো করে পাক দিয়ে পাক দিয়ে দশহাত লম্বা হাতাটা আড়াই-তিনহাত লম্বা একটা বান্ডিলের মতো করে প্যাঁচিয়ে রাখবে। এইভাবে তারা তিন-চারদিনের সিযিল-মিসিলে চারশ মন পাট চালানের সময় চারশ চল্লিশ মন বানাবে।

একটু দূরে বসে গেরামের অনেকেই এই কাজ খুব মন দিয়ে পরখ করে। মাঝে মাঝে বিড়ি কিংবা হুক্কা খাওয়া চলে। এক হাত থেকে অন্যদের হাতে হাতে হুক্কাটা ঘুরতে থাকে। অলস দুপুরের এই মজমাতে কেউ আসে, কেউ যায় কিন্তু আসর খালি হয় না একবারও। হয়তো রহিমদ্দিন চলে গেল, ‘অহন যাই রে; গরুগুলান ক্ষেতের বাতরে বান্দা’।

কলিমদ্দিন আসে। তার বয়সও হয়েছে। ছেলেরাই এখন হালচাষ করে। ধান কাটে পাট বোনে। সে পেটের ব্যথার রোগী। দিনে তিনবার সোডা খায়। আর সকাল-বিকাল পাড়ায় পাড়ায় হাঁটে। তো কলিমদ্দিন বসতে বসতে বলবে, ‘সফর আলীর বাড়িত দ্যাইখ্যা আইছি খুব কাইজ্জ্যা চলতাছে’।

পাটের ফড়িয়া এই গেরামের মানুষ। মাঝিরাও। সকলেই সকলকে হাড়ে-গোস্তে চিনে। তাই আলাপটা জমতে দেরি হয় না। তাবাদে একটা একটা করে প্রত্যেকেই ঝগড়া বিষয়ে আলাপ জোড়ে। কোনখানে কোন ঝগড়ায় কয়টা মাথা ফেটেছে। আলাপ জমবে বউ কিলানো বিষয়ে। জমি নিয়ে উত্তরপাড়ার শাহেদরা গত বছর যে ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তারক্তি করেছে সেই বিষয়েও আলাপ গড়ায়।

পাটের নাও চলে গেলে আসে ধানের নাও। ধানের বেপারি চলে গেলে খুলনা থেকে আসে নারিকেলের নাও। নারিকেলের কারবারিরা তিনচারদিন খুব বিকিসিকি করে চলে গেলে জাহাজের মতো একটা নাওয়ে করে বিরাট বিরাট ঝালা-মুটকি সহ ফরিদপুর থেকে আসে পাতিলের বেপারি। তারা চলে গেলে ভাটির দেশ থেকে খালি নাও নিয়ে আসে আম-কাঁঠালের বেপারি। তারপর নোয়াখালি থেকে আসে বাঁশের বেপারিরা। তারা নাও আনে না। তাদের ছোট ছোট বোচকায় লুঙ্গি-গামছা আর বাঁশকাটার জন্য চকচকে ধারালো ভারী দা।  তারা এসে বেদেবহর থেকে একটু দূরে পশ্চিমপাশের চাতালে ছোট ছোট তাঁবু করে চুলা খোদে। সকাল-বিকাল ইশকুলের মাঠ আর গাঙপাড়ের বাতাস ঝাল ছালুনের গন্ধে ম ম করে।

বাঁশের বেপারিরা অত সহজে যায় না। মাসখানেক ধরে আশপাশের জংলাগুলোতে বাঁশকাটা চলে। গাঙপাড়ে বাঁশের মজুদ জমতে জমতে একদিন পাহাড়সমান হয়। তখন সাত-আটজন নেংটি কষে কোমরপানিতে নামে আর বাকিরা হাতে হাতে বাঁশ গাঙে নামায়। হাজার হাজার বাঁশ দিয়ে গাঙের পানিতে বাঁধা হয় চালি। একটা-দুইটা করে আট-দশটা চালি বাঁধা হয়ে গেলে গাঙের বুকে শ-খানেক হাত লম্বা, উঁচু একটা বাঁশের সড়ক জেগে ওঠে। তখন চাতালের তাঁবুগুলো হাতে হাতে বাঁশের চালিতে চলে যায়। একদিন সকালে গিয়ে দেখা যায় ঘাট খালি। চুলাটা ভাঙা। আশপাশে পড়ে আছে শুধু ছাইভস্ম।

বেপারির ঘাটে সবাই দরকারে আসে, দরকার শেষ হলে চলে যায়। কিন্তু ঘাটের বেদেবহরটা কোনোদিন যায় না। কেউ কেউ যায়, তবে বেপারির ঘাট খালি করে না। হয়তো পরশুদিন সকালে এই বহরের তিনটা নাও চলে গেল উজানে। আবার তরশুদিন বিকালে ভাটি থেকে চারটা নতুন আসে। ছৈওয়ালা ছোট ছোট আট-দশটা নাও কোমরসমান পানির মাঝে লগিতে বাঁধা।

কালু ঠাকুর এই বহরের সর্দার। কাঁচা-পাকা বাবরি আর দেড়হাত চওড়া কালো চকচকে সিনা। তার একটা ডাকুমার্কা কুকুর আছে। সে এখন সর্দারের কোমরের পিছে বসে আছে। সর্দার চাতালের পাশে গাছের ছায়ায় বসে ঝাঁকিজাল বুনছে। তার চারপাশেও জনাকয় মানুষ বসে বসে জালবোনা দেখছে। আলাপ করছে। সর্দার কথা বলে না। শুনে। তার চোখ জালের ঘড়ার দিকে। হাতের সুতাজড়ানো কাঠিটা মাকুর মতো বেগে জালে ঢুকছে, বেরিয়ে আসছে। বহরের একটা নাওয়ের পিছা গলুইয়ে, খাঁচায় বন্দি একটা মোরগ আছে। নিঃসঙ্গতায় বিরক্ত মোরগটা হঠাৎ ডেকে উঠল, কুক্কুরু…কুক্।

সর্দারের কোমরের কাছে চোখ বুজে পড়ে-থাকা কুকুরটা লাফ দিয়ে ওঠে, ঘেউ…উ।

কুকুরের এই আচমকা রোয়াবে গাঙপারের নীরবতা খানখান হয়ে ভেঙে পড়ে। কালু ঠাকুরের হাত থেমে যায়। তার ঘুমজড়ানো নেশা-নেশা চোখদুটো ধক করে জ্বলে ওঠে। বহরটা এখন মানুষশূন্য। কাচের থালাবাসন, চুড়ি-জড়ি নিয়ে মেয়েরা গেরামে গেছে বেসাত করতে। পুরুষেরা কেউ কেউ গেছে বাঁদরের খেলা দেখাতে।  কেউ কেউ ছিপডিঙি বেয়ে চলে গেছে মাছশিকারে। সখিনদাররা ফাঁদ নিয়ে বেরিয়েছে পাখিশিকারে। মোরগের ডাকে কুকুরটা অস্থিরভাবে টহর-মহর করে। তার লাল জিবটা আধহাত তক বেরিয়ে ল্যাচড়-প্যাচড় করছে। চকচকা কালো চোখ দুটো বহরের দিকে কী-যেন-একটা খুঁজছে। কালু ঠাকুর সেইদিকে একনজর তাকিয়ে ফের জাল বোনায় মন দেয়।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you